আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৩৮
প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
একবার সে-রকমেরই এক জ্বর-আক্রান্ত দিনে সাতসকালেই অধীর ডাক্তার এসে হাজির হলেন বাড়িতে। আমার বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। আব্বার সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথাটথা বললেন, তখনো বঙ্গবন্ধু আছেন, ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে, তারা রক্ষাবাহিনী শান্তিবাহিনী জাসদ এসব নিয়ে বলছিলেন আর কথা বলতে বলতেই ডাক্তারবাবু স্টেথিসকোপ দিয়ে আমার পেট দেখছিলেন, বুক দেখছিলেন। তারপর থার্মোমিটারে জিভে লাগিয়ে জ্বর মাপলেন। এরপর এলো সেই গিলোটিনে গলা ঢোকানোর চরম বিভীষিকাময় মুহূর্ত। তিনি তার সাপের ঝুড়ি থেকে ইনজেকশন বের করলেন, ওষুধের কাঁচের ছোট্ট বোতলটা বের করলেন। তারপর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ইনজেকশনের সুইটা কেবল কাঁচের সেই বোতলটার প্লাস্টিকের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে সিরিঞ্জে টেনে নিচ্ছেন ওষুধ। আমি আর নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারলাম না। বিছানা থেকে নেমে দিলাম ভো দৌড়। এমন দৌড় যে, মাপলে হয়তো উসাইন বোল্টের গতি ফেল হয়ে যেত। ঘরের দরোজা পেরিয়ে রান্নাঘরের প্রান্ত ছাড়িয়ে কলতলার সীমানা অতিক্রম করে বাড়ির পেছনমুখি গেট দিয়ে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি— প্রাণপণ, কোনো দিকেই খেয়াল নেই; কিন্তু এত দৌড়িয়েও কী সেদিন বাড়ির সীমানা কিছুতেই পার হতে পেরেছি?
দিশেহারা আতংকে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাঁইয়ের ঢিবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তখন কেবল সকালের রান্নার ছাঁই গরম গরম চুলা থেকে তুলে এনে ফেলা হয়েছে সেখানে। আগুনের চাকতি ও গোলাও ছিল সেই ছাঁইয়ের নিচে লুকিয়ে। পা পড়ামাত্রই জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। ছাই থেকে পা উঠিয়ে পাশেই কোনোমতো বসে পড়লাম।
চাচাতো ভাইবোনেরা ছুটে এসেছিল। মাও ছুটে এলেন। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। একে তো জ্বর মাথাব্যথা, তার ওপর পা-পোড়ার জ্বলুনি যন্ত্রণা! আমার তখন মরণ হবার জো। তবুও কী অধীর ডাক্তারের হাত থেকে রেহাই মিললো? শুরু হয়ে গেল ডাবল চিকিৎসা, জ্বর আর পা-পোড়ার! ইনজেকশনও বুঝি জুটেছিল ডাবল ডাবল।
বলতে দ্বিধা নেই, যে অধীর ডাক্তার-নিধু ডাক্তারকে ভয় পেতাম, তারা বাড়ি এলেই দৌড়ে পালাতাম, তাদেরকেই আমার এখন খুব মনে পড়ে। দেখতে ইচ্ছে করে। তারা যে আমার শৈশবের থৈ। এমনি আরো একজন অথৈই নদীর কথা বলে শেষ করবো আমার ভ্রমণিয়া দিন। তবে সে আমার দাদাবাড়ির কেউ নয়, সে আমার নানাবাড়িরও কেউ নয়— সে যে আসলে কোথাকার, কোন গ্রহে থাকে, কোন নক্ষত্রের আলোয় ডানা— এখনো তার কোনোই হদিস করতে পারিনি! একটা জনম চলে গেল আমার! তাকে যে আমি কত খুঁজেছি মনে মনে, এখনো খোঁজা শেষ হলো না।
তখন বোধ হয় ফোর থেকে কেবল ফাইভে উঠেছি। প্রেমট্রেম বোঝার বয়স নয়, আমিও বুঝি না। তবুও সে-বয়সে কী যে হতো আমার! সুন্দর মুখের মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। শুধু কী সুন্দর মুখের মেয়ে, নাকি যা কিছুই সুন্দর মায়াময়, তার প্রতিই ছিল আমার এই মোহবিষ্টতা! বিশেষ করে ক্লাসের একটা মেয়েকে ঘিরে ভালো লাগার তীব্র এক ঘোর তৈরি হয়েছিল। মেয়েটির কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই নানা কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়াতাম। পরির দেশের পুলক জাগত, ফুলের বেশের বেদনার অনুভব পেতাম। তাছাড়া সেই শৈশব থেকেই অসম্ভব যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমাকে জীবনের পথটা পাড়ি দিতে হয়েছে। সে-কারণেও বোধ হয় ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ক্ষরণ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। অতৃপ্তি বোধের আছড়ানিতে খুঁজে বেড়াতাম ভালোবাসার খড়কুটো। না-পেয়ে হতাশার অন্ধকারে নিজের ভেতরেই নিজে খাবি খেয়ে খেয়ে মরতাম। এমনি এক মনোবিক্ষেপের দিনে যথারীতি রোজার ঈদে নানাবাড়ি যাওয়ার সময় এলো।
রোজার ঈদগুলো তখন আমরা নানাবাড়িতেই করতাম। এই ঈদের কথাটাও একটু আলাদাভাবে না বললেই নয়। এই ঈদ না থাকলে বোধ করি জীবনের আনন্দের মানেটাই জানা হতো না। আমার বেড়ে ওঠার দিনে আর আমার পৃথিবীর ভ্রমণযাত্রায় ঈদ প্রজাপতির রঙিন পাখনা, সঙ্গীতের পাখোয়াজ ধ্বনি! সেই রমজানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হতো ঈদের দিনের জন্য উদগ্র এক প্রতীক্ষা। ঈদের দিনের আগের বিকেলটা আস্ত রঙধনু হয়ে যেত। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য শেষ বিকেল থেকেই পশ্চিম আকাশপানে কী যে কাঙালের মতো অধীর তাকিয়ে থাকতাম। সবার আগে কে চাঁদ দেখবে তা নিয়ে যেন ভেতরে ভেতরে আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা লেগে থাকত। যে আগে দেখল চাঁদ, সে যেন বিশেষভাবে জিতে গেল, যেন কী একটা লাভ করল অলৌকিকী! আমি কি কখনো সবার আগে সেই কাঁচির মতো সরু ফালি চাঁদ দেখেছিলাম? বোধ হয় দেখিনি। নাকি দেখেছি! যে আগে দেখতো জগৎ জয় করা আনন্দের চিৎকার গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতো তার কণ্ঠ থেকে। তারপর আর সবাইকে দেখানোর ব্যাকুলতা, অই যে অই যে দ্যাখ! আরে গাধা আরেকটু ডাইনে তাকা, আরে আরে আরেকটু বাঁয়ে! কোনো কোনো জন্মকানা ছিল, কিছুতেই তাদের চোখে পড়তে চাইত না চাঁদ! তারপর আরেকটু যখন অন্ধকার ঘন হতো, কাঁচির মতো ফালি চাঁদটা তখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠতো, তখন আর সেই চাঁদে চোখ ভিজিয়ে নিতে কারো আর এক মুহূর্তও বিলম্ব হতো না।
চাঁদ দেখা পর্ব সারা হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত হাতে মেহেদি দেয়া পর্ব। মেহেদি যে শুধু মেয়েদের ব্যবহারের জন্য, এটা আমি বড়বেলায় এসে জেনেছি। শৈশবে ঈদের আগের দিন হাতে মেহেদি দেয়াটা ছিল আমাদের জন্য রীতিমতো রেওয়াজ! ছোট খালাম্মা বাটতো মেহেদি। তারপর একজনের পর একজন রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে হাতেরর মধ্যে মেহেদি লাগাতাম। হাতের মাঝখানে সূর্যের মতো একটা বিশাল গোল আকৃতি দিতাম। প্রতিটি নখ ডুবিয়ে রাখতাম মেহেদিতে। মেয়েরা নানা রকম কারুকাজ আঁকতো হাতের মধ্যে। তারপর দেড় কী দু’ঘণ্টা পর হাত ধুয়ে ফেলে দেখো— কার চেয়ে বেশি লাল হয়েছে কার হাত! আমার কখনোই অতক্ষণ হাত মেহেদিতে ভিজিয়ে রাখার ধৈর্য থাকতো না। এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই ধুয়ে ফেলতাম। তারপর রাঙা হাতটার ঘ্রাণ নিতে থাকতাম, যেন ওখানে সব ঈদের আনন্দ ধরে রাখা হয়েছে।
সন্ধ্যা যত গাঢ় হচ্ছে, ততই দেখো ঈদের খোশবু বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। নানির রান্নার হাত ছিল খুবই ভালো। আর রান্না করতেও ভালবাসতেন ভীষণ। ঈদের দিনের সকালের রান্না তার আগের রাতেই শুরু করে দিতেন। সেটা বুঝি প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত চলতো, পুরো মাসটাই তো কেটে যেত এভাবে— সেহরির জন্য। ঈদসকালের জন্য রাঁধতেন সেমাই, ফিরনি, খিঁচুড়ি, জর্দা। খিঁচুড়ির সঙ্গে থাকত দেশি বড় মোরগের গোশত বড় বড় আলুর চাক সহযোগে! এ-খাবার কখনোই রাতের বেলা দেয়া হতো না। হাজার মাথা কুটে মরলেও না। পরদিন উঠতে হতো খুব সকালে। সকাল-সকাল জেগে উঠেই ছুটে যেতাম নানাবাড়ির পুকুর ঘাটলায়। চার-পাঁচটা ডুব দিয়ে এসে গায়ে মাখতাম কসকো গ্লিসারিন সাবান। ঈদের দিনের বিশেষ যত্ন। আজো ঈদ যেন কসকোর ঘ্রাণ। তারপর নতুন সাদা গেঞ্জি! নতুন লুঙি বা প্যান্ট! বাড়িতে এসে হাজির হলেই মা গায়ে পরিয়ে দিতেন নতুন পোশাক। ঈদের দিন মানে মা, মায়ের হাতে পরা নতুন পোশাক। এবার ব্যস জোড়াসন হয়ে বসে পড়ো পাটিতে। সেমাই খাও ফিরনি খাও জর্দা খাও খিচুড়ি খাও। তারপর বাবার হাত ধরে ছুটে যাও ঈদগায়!
তেমনি এক ঈদ উৎসবের পর, যখন আনন্দের ভাঙা হাট— তখন বর্ষা, ওদের নৌকাটা এসে ভিড়েছিল নানাবাড়ির বাইরের ঘাটলায়।
চলবে