আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৩৬
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
মনে পড়ছে চঙ-ঘুড্ডির কথা। আমাদের গ্রামের কাঁঠাল গাছ, আমগাছ, খেঁজুর গাছ, তাল গাছের ছাদ মাড়িয়ে নীল-সাদা আকাশের বুকে চৌকোণা বাক্সের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে চিকন চিকন করে কাটা বাঁশের খাঁচার মধ্যে বাদামি কাগজমোড়ানো ঢাউস সাইজের ঘুড্ডিটা। একটা দুইটা তিনটা ঘুড্ডির সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে আকাশময়। যেন একগুচ্ছ হেলিকপ্টারের ঝাঁক পাড়া থেকে পাড়ায় পাড়ায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর নাটাই হাতে ছেলে-বুড়োর দল ক্ষেত থেকে ক্ষেতে দৌড়াচ্ছে চঙ-ঘুড্ডিটাকে হাওয়ায় মাতার অযাচিত উস্কানি যুগিয়ে। নাটাই ছেলে-বুড়োদের হাতে থাকলে কী হবে, এসব চঙ-ঘুড্ডির নেপথ্যের ডন ছিলেন একজনই, সে হলেন আমাদের পাশের বাড়ির আরমান ভাই। আরমান ভাইয়ের একটা পা ছিল খর্বাকৃতি, লেংচিয়ে লেংচিয়ে হাঁটতেন। তা হলে কী হবে, তিনি ছিলেন একজন এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা। না, জ্ঞান রাজত্বের নন, হরফোন মৌলা, সকল কাজের কাজী। রেডিও, ঘড়ি, সাইকেল ঠিকঠাক করতে হবে তো চলে যাও আরমান ভাইয়ের কাছে। নাট বল্টু স্ক্রুপ বের করে লেগে যাবেন তখন তখনই। একটা কাঠের টেবিল, চেয়ার বা খানাডুলি বা আলমিরা বানাতে হবে সেজন্যও ডেকে আনতে পারো মানুষটাকে, জেলেপাড়ার দূর্গাপুজার প্রতিমাটা কে বানিয়েছে? খোঁজ নিয়ে দেখো, সেখানেও আরমান ভাইয়ের হাত রয়েছে! দেবদেবী আঁকা বা নির্মাণে তার ছিল অদ্ভুত নিখুঁত পারঙ্গমতা। গ্রামের কোনো বাড়ির বিয়ে তার করিৎকর্মা হাতের স্পর্শ ছাড়া কোনোমতেই সম্পন্ন হতো না। বাজার থেকে নানা রঙের কাগজ এনে নকশি কেটে সেগুলো ঘরে লাগানো থেকে শুরু করে বিয়েবাড়ির গেট সবকিছু বানাতেই ভারি ওস্তাদ ছিলেন মানুষটা। আচ্ছা, সেসব রঙিন কাগজগুলো কি এখনো পাওয়া যায় কাশিমপুর বাজারে? লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সাদা... সব রঙের, একটু পাতলা-মতোন! ধনঞ্জয়খালিমুখো রাস্তার দিকে বটগাছের ছায়ার নিচে একটা দোকানই ছিল, যেখানে এসব রঙিন কাগজ, আতশবাজি, পটকা এসব পাওয়া যেত।
আরমান ভাইকে নিয়ে গল্পকাহিনির শেষ ছিল না। মেট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে সুদূর সেই টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। তখন, আমাদের সেই শৈশবে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দিনগুলোতে সাভার থানার অন্তর্গত জরুন গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের মেট্রিক পরীক্ষা দিতে হতো করটিয়ার সাদত কলেজে গিয়ে। যতদিন পরীক্ষা হতো ততদিন সেখানকারই কোনো বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হতো। আটকাতো না। জুটেই যেত কোনো না কোনো বাড়ি। তখন বাড়িগুলোতে জোয়ানমর্দ মানুষের অতি সহজেই আশ্রয় মিলতো, লজিং থাকার প্রচলনও ছিল বাড়ি বাড়ি। তো, আরমান ভাই করটিয়ায় পৌঁছেই তার বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন পরীক্ষার জন্য শ্যাম্পু কিনতে হবে, টাকা পাঠাও অতো! বাবা তো আর জানতেন না যে শ্যাম্পু নামের জিনসিটা আসলে কী, কেইবা জানতো তখন। বাজারে কেবল নতুন এসেছে। নাম না শুনলে কী হবে, আমাদের সে-দাদা ছেলের চিঠি পড়ে অন্তত এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, শ্যাম্পুর সঙ্গে বোধ হয় মেট্রিক পরীক্ষার কোনো নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একে তো বাড়ির ছোট ছেলে, তার ওপর আবার মেট্রিক পরীক্ষার ব্যাপার, মানুষ বিয়ে করার সময়ও বাড়ি থেকে এত আয়োজন করে বেরুত না! সাত রাজ্যের মানুষ আসতো বিদায় জানাতে! আত্মীয়স্বজন এসেও থাকত। তো, আমাদের সেই দাদা চট-জলদি টাকা-পয়সা ম্যানেজ করে শ্যাম্পু কেনার জন্য তা তুলে দিয়েছিলেন কোনো মাস্টারের হাতে ছেলের কাছে সাত-তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে। সে-সময়ে শ্যাম্পুর একটা আভিজাত্য ছিল, কৌলিন্য ছিল। এতোটা খেলো হয়ে যায়নি ওর পরিচয়। যত্রতত্র যেমন পাওয়া যেত না, এমন সস্তা প্রকৃতির স্যাশে প্যাকেও ছিল না। বাহারি বোতলে এমন জৌলুসের সঙ্গে থাকত যে, শ্যাম্পু ব্যবহার করলে প্রেস্টিজও হয়ে উঠতো বাড়বাড়ন্ত। ওরে বাবা! দ্যাখ চেয়ে দ্যাখ! অমুকের ছেলে মাথায় শ্যাম্পু দেয়। চুল কেমন শাদা ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। অবশ্য তখন শ্যাম্পুটা মেয়েদের প্রোডাক্ট হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শ্যাম্পুর কারণে আরমান ভাইয়ের চুলই শুধু ঝলমলে রেশমি কোমল হয়ে ওঠেনি, করটিয়ার প্রায় মাসখানেকের সময়কালটাও পেয়েছিল আলাদা জেল্লাই, তবে সেটা যে মেট্রিক পরীক্ষার জন্য কোনোভাবেই ভালো ফলাফল বয়ে আনার অনুকূল হবে না, সেটাতো সহজেই অনুমেয়। শ্যাম্পু কি আর কেউ পরীক্ষার হলে বসে থাকার জন্য ব্যবহার করে? তাহলে হাওয়ায় চুলের ঘোড়দৌড় কে সামলাবে? তিনমাস পর পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলে দেখা গেল, তিনি যথারীতি আন্ডার মেট্রিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তখনকার সে সময়ে আন্ডার মেট্রিকেরও একটা ভালো সম্মান ছিল। বিয়ে করতে গিয়ে বর পক্ষ কণে পক্ষের কাছে গর্বের সঙ্গেই পরিচয় দিতে পারতো, আমার ছেলে মাশআল্লাহ আন্ডার মেট্রিক! কনেপক্ষও আশ্বস্ত হতো, যাক! ছেলে অন্তত একটা দুটা ইংরেজি হলেও বলতে পারবে! ইয়েস নো ভেরি গুড এক্সকিউজ মি এসব আর কী!
সেই আন্ডার মেট্রিক আরমান ভাই যে কত রকমের ঘুড্ডি বানাতে জানতেন, তার কোনো হিসেব ছিল না। চঙ-ঘুড্ডি, মানুষ ঘুড্ডি, সাপ ঘুড্ডি, সাধারণ ঘুড্ডি, আরো কত রকমের ঘুড্ডি যে দেখেছি তার সুবাদে! একবার চকের ভেতর আরমান ভাইয়ের কাগুজে মানুষ ঘুড্ডির কারণে একজন বয়স্ক জীবন্ত মানুষকে কিনা দাঁতকপাটি পর্যন্ত খেতে হয়েছে। দুপুর-রোদে চকের ভেতর দিয়ে মুরুব্বি মানুষটা মেয়ের বাড়ি না কোথা থেকে হনহনিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন! এমনিতেই ও জায়গাটার, যাকে বলা হতো পাবর, খুব বদনাম ছিল। দুপুরবেলা চৈত্রের রোদে ওখান দিয়ে একা একা আসা-যাওয়া করলে নাকি খকশোর পাল্লায় পড়তে হতো! তো, সেদিন সেই মুরুব্বিও হঠাৎ দেখতে পেলেন যে, তার সামনে মানুষের মতো যেন কিসের একটা ছায়া নড়েচড়ে উঠলো। ব্যাপার কি রে ভাই! তিনি একটু হতচকিত হয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন! সত্যিই তো, মানুষের মতোই তো কিছু একটা। ওটা ফলো করে আকাশের দিকে তাকাতেই ভিড়মি খাওয়ার জো! ওরে বাপরে! আকাশ থেকে নাচতে নাচতে যে মর্ত্যধামে আবির্ভূত হচ্ছে অশরীরী এক আত্মা! মাঝে মধ্যেই ওটা ওপর-নীচ করতে করতে গোত্তা খাচ্ছে আর যেন ধমকের সুরে সুরে তেড়ে আসতে চাইছে উনার দিকেই। কিছুতেই আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। দাঁত কপাটি খেয়ে সেখানেই পড়ে থাকলেন। শেষে সব কাজের কাজী আরমান ভাই-ই তাকে সেবাশ্মশ্রুষা দিয়ে মাথায় পানিটানি ঢেলে দিব্যি সুস্থ করে তুললেন।
চলবে