আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৩৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি  
বাংলা মদপানের সঙ্গে বউ মারার যেমন একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে, গোঁফেরও যেন কেমন একটা ভারি সংলগ্নতা টের পেতাম। বানেশ্বরের ছিল ইয়া বড় বড় মোটা গোঁফ। সে গোঁফের জন্য বোধহয় গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে কোনো ভাতা পেত সে। নাকি এটা কানকথা! শুনেছিলাম বোধহয়।

 

বানেশ্বর ছিল মেথর। ডোম মেথর। থাকত মুচিপাড়ায়। কাশিমপুরের পাশেই, কী যেন নাম গ্রামটার! কাশিমপুর আর বারেন্ডার মাঝখানে, লালদিঘি? লালদিঘির রাজমোহন। কাশিমপুর মাঠে ফুটবল খেলতো। যাই হোক, সে-মুচিপাড়াতেই তৈরি হতো বাংলা মদ। মদের পর মদ খেয়ে দিশেহারা হয়ে যেতেন এক-সময় মানুষটা। বউতো পেটাতেনই। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কোথাকার মাল যে কোথায় গড়াতেন, তার কোনো হুঁশ থাকত না।

আমি কতবার দেখেছি আমাদের বাড়ির খলার মধ্যে যে ক্ষেরের পালা ছিল, সেখানে সে বেঁহুশ হয়ে শুয়ে আছে। একজন মানুষ মদ খেয়ে টাল হয়ে এভাবে জায়গা-বেজায়গায় শুয়ে আছে দেখে, আমার কোমল মনে ভীষণ ঘা লাগতো। মদ নামক জিনিসটার ওপর রাগ হতো খুব, সে এত বেত্তমিজ কেন, কেন মানুষকে  এমন বেহুঁশ বানিয়ে জায়গা-বেজায়গায় শুইয়ে রাখে!

পরবর্তী-জীবনে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে পড়ার সময় এসএম হলের এক মুচিকে নিয়ে একটি গল্প লিখে ফেলি, সে গল্পটির নাম রেখেছিলাম চেতনাচেতনে বানেশ্বর! শুধু নামে নয়, চরিত্রের ভেতরেও চলে এসেছিল আমার দেখা শৈশবের সেই মানুষটি। শৈশবের সেই রুশ রুশ চেহারার আমোদে মানুষ। আমার লেখা গল্পগুলোর মধ্যে এটিকেই অনেক লেখক-সমালোচক সেরা বলে থাকেন। প্রকৃতির সঙ্গে একজন মানুষের আন্তঃসম্পর্ক খুব সাবলীলতায় উঠে এসেছে এ-গল্পে! শৈশবে দেখা দীর্ঘদিনের একজন মানুষ আমার ভেতরে লালিত হয়ে যৌবনের অভিজ্ঞতার চোখে গল্পের চরিত্রের মাধ্যমে লাভ করেছে পূর্ণতা!

যারা চৌকিদার দফাদার ছিলেন, তাদেরও ছিল বাংলা মদের তীব্র নেশা। আর তারাও বাহারি গোঁফ রাখতেন, মানে গোঁফ দুই পাশের প্রান্তে পৌঁছে ওপরদিকে ঝাঁড়ি মেরে উঠতো! সে গোঁফ দিয়ে হয়তো বানেশ্বরের মতো ভাতা পাওয়া যেত না, কিন্তু বেশ জোরেশোরেই তা দেয়া যেত! কাদু, আমীর খান— এমন কত মানুষের মুখ যে এ প্রসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাংলা মদের নেশা কোনো কোনো পরিবারের জন্য অভিশাপও বয়ে এনেছে! এমন এমন মানুষকেও দেখেছি, মদ খাওয়ার জন্য জমিটমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছে, পচিয়েছে লিভার। এখন অবশ্য বাংলা মদের প্রকোপ নেই ততটা। কিন্তু অন্য সব নতুন নতুন নেশায় ঠিকই অনেক পরিবারের সুখ-শান্তি-স্বস্তি সবই লোপ পাবার উপক্রম।

আবদুল পাঠান ছিলেন গ্রামের আরেক বর্ণাঢ্য চরিত্র। সত্যিকার অর্থেই এক রঙিন মানুষ। একমুখ সাদা দাঁড়ি-গোঁফ, সারাক্ষণই হাতে থাকত সিগারেট। গ্রামের যত খেলাধুলা হতো ফুটবল, কাবাডি— সবটারই রেফারির দায়িত্ব পালন করতে হতো তাকে। রান্নার হাত ছিল অসম্ভব ভালো। গ্রামে আগে বাড়ি বাড়ি খরচ হতো। কারো বাপ-দাদা মারা গেলে কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে বিয়ে কী মুসলমানি— খাওয়া-দাওয়ার রীতিমতো মচ্ছব বয়ে যেত। গ্রামের প্রায় সব লোককেই দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হতো ইচ্ছেমতো। আর, অনিবার্যভাবেই সে-বাড়িতে রান্নার জন্য ডাক পড়তো আবদুল পাঠানের। তার হাতের যে কী গুণ ছিল রান্নার! বড় ড্যাগের মধ্যে রান্না করা সেই গরুর মাংসের স্বাদ আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না এই পৃথিবীতে। আমি কত খুঁজি! নিয়তই খুঁজে বেড়াই। গ্রাম-গঞ্জ যেখানেই যাই, মুরুব্বি মানুষ দেখলেই জিজ্ঞেস করি, খরচের খাওয়া কি হয় আপনাদের এখানে? হয়। কেউ কেউ জানায় হয়। তবে অধিকাংশ জায়গায় রান্না হয় বিরিয়ানি অথবা পোলাও মাংস। সাদা ভাতের সঙ্গে সেই গরুর মাংস আর মাসকলুইয়ের ডাল খাওয়ার রীতি কবেই উঠে গেছে। যারা গরুর মাংশ খেত না, তাদের জন্য থাকত খাশির মাংস। খেতে হতো কলাপাতায়। যেখানে মাসকলুইয়ের ডাল গড়াগড়ি খেত, ছুটে যেতে চাইত এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত!

ওহ! আরেকটি কথা, রান্না করার সময়, বিশেষ করে গরুর মাংস রান্নার সময় মশলার সঙ্গে তেজপাতা, তেলের যখন বিবাহ সংযোগ ঘটতো, তখন যে কী এক অদ্ভতু ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো চতুর্দিক, সেই অভিজ্ঞতা কি কারোর মনে আছে? আমি আজো কোনো বিয়েবাড়িতে দাওয়াত পেলে রান্নার সেই মুহূর্তটুকুতে সামনে থাকার চেষ্টা করি এবং বরাবরই হতাশ হই। সেই ঘ্রাণ নেই, সেই মনের ভেতর অদ্ভুত ভালো লাগার মন্ত্রণা ছড়িয়ে দেয়া ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ হারিয়ে গিয়েছে কীভাবে কীভাবে, যেমন হারিয়ে গিয়েছে গোলাপের ঘ্রাণ, চালের ঘ্রাণ, বাতাসের সতেজতা— অবিকল তেমন!

চলবে
সিদ্ধেশ্বরী বা কড্ডার মেলা থেকে আনা কাঠের বাটযুক্ত চাকুটার কথা কি কোনোদিনও ভোলা যাবে? নাকি ভোলা সম্ভব? ওটা দিয়ে কাঁচা আম কেমন কুঁচি কঁচি করে কেটে খাওয়া হতো আমার। কাঁচা আমের সেই ঘ্রাণ এখনো লাগছে নাকে আর জিভে চলে আসছে জল। সরস কাসুন্দি দিয়ে কখনো কখনো আমের ভর্তাও বানানো হতো। আমের ভর্তা জামের ভর্তা। জামের ভর্তা বানানোর ব্যাপারটা ছিল দারুণ এক খেলা। দুটো বাটির মধ্যে জামগুলো কাঁচামরিচ আর লবণের মাঝে আটকিয়ে মারো ঘোটা। যত ইচ্ছে তত। জামগুলো যত ঝাঝরা হয়ে যেত, ছিড়েখুঁড়ে যেত, তত মজা! ওমমম! সব শেষে ঝোলটুকু খাওয়ার জন্য একেকজনের মধ্যে সে কী কাড়াকাড়ি!

চলবে