আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৩৩
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
কাশিমপুর-হাতীমারা হাইস্কুলের ফুটবল প্রতিযোগিতাকে ঘিরে যেমন আমাদের দাদাবাড়ির এলাকায় আলাদা আলাদা সমর্থক গোষ্ঠী ছিল, তেমনি সেই বিভাজন ছিল জাতীয় দুটি দল আবাহনি-মোহামেডানকে ঘিরেও। একদল আবাহনিকে কড়াভাবে সাপোর্ট করতো তো, আরেকদল মোহামেডানের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত!
সারা দেশেই ছিল দু’পক্ষের তীব্র সমর্থক গোষ্ঠী! ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন প্রতিবছর নিয়মিত দলগুলোর মধ্যে টুর্নামেন্ট হতো, আর তার শাসরুদ্ধকর আগুনে তাপের আঁচ ছড়িয়ে পড়তো আমাদের গ্রামটিতেও। আব্বা জরুন গ্রাম থেকেই চলে যেতেন ঢাকার স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখার জন্য। ছিলেন মোহামেডানের ঘোর সাপোর্টার। একবার রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে। ভুলক্রমে মোহামেডানের সাপোর্টার হয়ে বসেছিলেন কীনা আবাহনির গ্যালারিতে।
খেলার উত্তেজনা তখন মাঠের চেয়ে বেশি গ্যালারিতে ছড়াত। আজ যেমন ক্রিকেট ঘিরে এত উচ্ছ্বাস, দেশপ্রেমের এত প্রগাঢ়তা, তখন সেটা ছিল কেবল ফুটবলকে কেন্দ্র করে! তবে সেই ফুটবল প্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমের এমন সঘন উপস্থিতি মোটেই ছিল না। সেটার কারণ বোধহয়, ক্রিকেটের মতো ফুটবল আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে তেমন নাড়িয়ে দিতে পারেনি। দেশের বাইরে থেকে ফুটবল অর্জন করে আনতে পারেনি তেমন কোনো বিশেষ সম্মান। দিনের পর দিন ফুটবলাররা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করেছে আর একটু একটু করে হৃদয়ের সমর্থন হারিয়েছে, যার জায়গা পুরোই দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট। অথচ তখন ক্রিকেটের কথা কেউ ভাবতেই পারত না। বাংলাদেশও যে এক সময় পৃথিবীর বাঘা বাঘা ক্রিকেট টিমকে দাবড়িয়ে বেড়াবে, সেটা ছিল কল্পনার বাইরে। ফুটবলের হই হুল্লোড়ে তখন সময়ই ছিল না ভারত পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচে কী হচ্ছে না হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ সিরিজে কে খেললো না খেললো সেইসব খবর রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজ রাখার!
আমাদের হাফপ্যান্ট পরুয়াদের মধ্যে তখন পেলে হওয়ার স্বপ্ন ছিল দুর্মর! অলিতে গলিতে চলত ফুটবল নিয়ে কাটাকুটি। সালাউদ্দিন তখন সিনেমার যে কোনো হিরোর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়! আমরা স্কুল থেকে ফিরেই পেলে আর সালাউদ্দিনকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম মাঠ খুঁজতে। তখন জরুন গ্রামে ফাঁকা মাঠের অভাব ছিল না। সমান মসৃণ কোনো একটা ফসলহীন ক্ষেত বেছে নিয়ে দু’দল তৈরি করে লেগে যেতাম মুখোমুখি লড়াইয়ে। মনে পড়ে, বল হাতে সেই বেরিয়ে পড়বার দিনগুলো। বলে পাম্প দেয়া হয়েছে কীনা, পাম্প না থাকলে যাদের বাড়িতে সাইকেলে পাম্প দেয়ার যন্ত্র থাকত, তাদের বাড়িতে ছুটে যাওয়া, কাজের কোন শেষ ছিল না। সেই মাঠ, বলের পিছনে পিছনে দৌড়ানো, কে হবে গোলকিপার, কে হবে স্ট্রাইকার, কে হবে ক্যাপ্টেন— সেসব নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে এসেই আমরা ছেলেরা ঘোর উত্তেজনায় মেতে থাকতাম!
চলতো নানামুখী সমীকরণ। আজ যিনি আমার একজন ফেসবুকের পরম বন্ধু মো. মতিউর রহমান মৃধা, আমরা তখন তাকে ডাকতাম মতু ভাই বলে, তিনি যেন কীভাবে কীভাবে তার মোহিনী ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বছরের পর বছর ক্যাপটেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাকে আজো আমি ক্যাপটেন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। কৌতূহলী চোখে আজো আমি তাকে ফেসবুকের পাতায় অনুসরণ করি, দেখি তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। মিছিলের সারির প্রথম দিকে দেখে ভালোই লাগে।
ছোটবেলায় এই ফুটবল খেলতে গিয়েই কীনা, সন্ধ্যার সঙ্গে আমার একটা আড়ির সম্পর্ক হয়েছিল। পড়ালেখা, স্কুল, কড়া শাসন-শোষণের বাইরে বিকেলের এই এতটুকু সময়ই যেন ছিল দল বেঁধে হৈ চৈ করার। সন্ধ্যা এসে রোজ রোজ আমার সেই আনন্দের ভুবনটিকে চুরি করে নিয়ে যেত। খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতাম। এই যে বাড়ি ফিরবার পথটুকু, কীভাবে কীভাবে প্রকৃতির আলো অবশেষে সবটুকু একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু টেরই পেতাম না। সেই আঁধারেও সাহারা ফুফু আর মনসুরদের বাড়ির মাঝখানের বাঁশছোপায় সাদা সাদা বকগুলোকে চোখে পড়ত। ওরা রাতে চোখে দেখতে পেত না। বিকেল গাঢ় হতে না হতেই কোথা থেকে সব বকের দল এসে এই বাঁশছোপাতেই আশ্রয় নিত। ওদের অলস ক্লান্ত ডাক মাঝে মধ্যেই থেকে থেকে ভেসে উঠতো।
চলবে