আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২৭
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মে ২৪, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
তখন, সেই একাত্তরে একটা পোস্টারও দেখেছিলাম, ঠিক কোথায় কোন বাড়ির দেয়ালে... ঝাপসা হয়ে আসছে স্মৃতি! তজু ভাইদের বাংলাঘরে কি? বড় সুদৃশ্য ছিল সেই বাংলাঘরটার। পুরোটাই মাটির ঘর। ভালোমতো লেপাপোছা। আমাদের বাড়ির সব ঘরই তো মাটিরই ছিল, তবে কিছু ঘর এমন চমৎকারভাবে লেপে রাখা হতো যে, সেটা একটা আলাদা মর্যাদা পেত। তারমধ্যে সেই বাংলাঘরটার সামনে ছিল একটা ছোটখাটো বাগান। কামিনী, হাস্নাহেনা ফুটে থাকত। পাতাবাহারের বেশ আধিক্য ছিল। বাগানটা চারপাশ থেকে বাঁশের পাতলা পাতলা লম্বা টুকরো দিয়ে ডিজাইনকৃত দেয়ালে ঢাকা থাকত।
সুদৃশ্য সেই বাংলাঘরে থাকতেন মোস্তফা স্যার। তখন আমাদের গ্রামে লজিং সিস্টেম খুব চালু ছিল। কোনো ছাত্র অথবা শিক্ষক একটা বাড়িতে থাকবেন, খাবেন; বিনিময়ে সে-বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজটা তাকে করতে হবে। মোস্তফা স্যার ছিলেন আব্বার হাতে গড়া হাতীমারা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ভীষণ রাগী। বেত ছাড়া কোনো কথাই বলতেন না। বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল। পরবর্তী জীবনে যখন অভিনেতা খালেদ খানের সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয়, তিনি আমার বাড়ি কোথায় জেনে জানিয়েছিলেন, আরে তোমাদের গোলাম মোহাম্মদ স্যারতো আমার মামা। আমার আপন মামা। তো, সেই গোলাম মোহাম্মদ বা মোস্তফা স্যারের কথা মনে পড়লেই আমার কেবল আমাদের বাড়ির জামগাছ দুটোর কথা মনে পড়ে। বেশ বড় বড় দুটো জামগাছ ছিল আমাদের বাড়িতে। শুধু কি জামগাছ! মস্ত বড় ঝাঁকড়া একটা কামরাঙা গাছও ছিল। কামরাঙা গাছ, সফেটা গাছ। আর আম কাঁঠাল গাছের ছড়াছড়ি তো ছিলই। আম গাছের কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতরে একটা হাহাকার বোধ জাগে। বেশ কয়েকটি বিরল স্বাদ ও জাতের আমগাছ ছিল। একেকটা যেন আলাদা ব্রক্ষ্মাণ্ড। গোল আমগাছ, বৈশাখী আমগাছ। আরো তিনটে জাতের আমগাছের নাম ভুলে গেছি। গোল আর বৈশাখী আম গাছের কথা কখনো ভোলা সম্ভব হবে না। সেই স্বাদ আর কোথায় মিলবে? কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে না সেই পৃথিবী।
দুটো জামগাছের মধ্যে একটা ছিল পশ্চিম দিকে রাস্তার পাশে, আরেকটা ছিল বাড়ির বিশাল খোলা প্রান্তর পেরিয়ে উন্মুক্ত মাঠ যেখানে শেষ হয়েছে নালার ধারে এসে, তারই কাছের মসজিদ-সংলগ্ন একটা টিউবয়েলের ওপর। সেই টিউববয়েলটা ছিল যেন এক মিলনমেলার কেন্দ্রভূমি। পাড়ার সব বাড়ি থেকে নারী-পুরুষ হামলে পড়তো এখানে। নারীরা কলসি নিয়ে আসতো পানি নিতে। এত সুমিষ্ট ছিল এই পানি, দূরের বাড়ির লোকজনও এই টিউবয়েলের পানি খেত। পুরুষরা তো আর কলসি ভরে পানি নিতে আসতো না, সেটা হতো বেইজ্জতের কাজ। তারা আসতো গোসল সারতে। তবে দুপুরবেলা গোসল সারাই হোক আর কলসি ভরে পানি নেয়াই হোক, দীর্ঘ এক লাইন দিতে হতো। পথচারীদের জন্যও এই টিউবয়েল ছিল ছায়াশীতল আশ্রয়। সবাই যে শুধু পানি পানের জন্য থামত এখানে, তা নয়, ঝাঁকড়া জামগাছের ঘনছায়ার আশ্রয়ে বসে জিরিয়েও নিত খানিকক্ষণ। সুদূর আশুলিয়া থেকে কাঁধে বাঁশের বাঁকেতে দই নিয়ে নরসিংহপুর-বাগবাড়ি-সুরাবাড়ি-কাশিমপুর-নয়াপাড়া-জরুন-বাইমাইল হয়ে কড্ডাবাজারের দিকে যেত যেসব গোয়ালা, তারা সবাই সুদীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি জুড়াতে এখানে এসেই বিশ্রাম নিত দু’দণ্ড। কলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে, টিউবয়েলের মুখে হাতটা বিশেষ কায়দায় লাগিয়ে সেই আজলা ভরেই ঢোক ঢোক করে গিলত পানি। তারপর দু’হাঁটু মুড়ে জামগাছের ছায়াতলে বসে নিত অনেকক্ষণ। যারা সিগারেট বিড়ি টানার, রসিয়ে রসিয়ে টেনে নিত। তারপর আবার দুই পাশের চাঙারিতে সাজানো দইয়ের পাত্রসমেত বাঁকেটা কাঁধে নিয়ে হাঁটা দিত কড্ডা বাজারের পথে। প্রতিদিন যেত না তারা, যেদিন কড্ডাবাজারে হাঁট বসতো, শুধু সেদিনই ছিল তাদের এই দুঃসহ পরিশ্রামের অভিযাত্রা। দই ছাড়াও থাকত মাঠার পাত্র। সে মাঠার মধ্যে ভাসত টুকরো টুকরো মাখনের দলা। এক গ্লাস মাঠা কেনার পর জুটত এক চিমটে মাখন। সে মাখনটুকুর জন্য যে একেকজনের কী নাদানেপনা। কাহা! আরেকটু দেন না। ধুতিপরা খালি গায়ের সে কাহা ঝামটা দিয়ে উঠতো, না! না! দেওন যাইত না! তার যেন সব মস্তানি ওইটুকু মাখন নিয়ে! গরমের মধ্যে মাঠা খেয়ে আমরা পরাণ শীতল করতাম। এক দু’জনের বাঁকেতে থাকত ঘি-ও।
আমার এক আত্মীয়, যে কিনা শৈশবে ছিল ভীষণ দুরন্ত! ওর বাবা যদি দই কিনে না দিত, সে করতো কী হঠাৎই এক দইয়ের পাতিলায় হাত ডুবিয়ে দিত। সে দই কি আর গোয়ালার পক্ষে হাটে নেয়া সম্ভব হবে। সে রাগে জ্বলে গোস্বা করে পাতিলটা রেখে যেত বাড়ির গেটে। পরে জুতমতো সময়ে এসে দামটা নিয়ে যেত। এই গোয়ালার দলই কি বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন কাঁচা আম খাওয়ার সময় হতো, তখন কাসুন্দি নিয়ে আসতেন? নাকি সেটা অন্য দল নিয়ে আসতো। আহা! কী যে সরসতার ঝাঁঝ ছিল সে কাসুন্দিতে, পরাণ ভইরা যাইত গা! মোস্তফা স্যার প্রতিদিন এই কলতলায় এসে গোসল সারতেন। বড় দীর্ঘ আর প্রলম্বিত ছিল সেই গোসল। তিনি ছোবা দিয়ে গামছা দিয়ে শরীর ঘষে চলেছেন তো চলেছেনই, থামবার আর নাম নেই। মধ্য জীবনের দিকে তার শরীর বেশ ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। বৃথা যায়নি সাধনা। স্যারের ছিল হিন্দি গান শোনার ব্যাপক নেশা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তজু ভাইদের বাংলাঘরের সামনের বাগান-সংলগ্ন টুলে বসে তিনি রেডিও আগরতলা ধরে হিন্দি গানের সমাহার শুনতেন। কোনোদিন তাকে গান গাইতে শুনিনি, এমনকি গুনগুনও করতেও না। কিন্তু গান শোনা ছাড়া দিন যাপনের কথা বোধ হয় ভাবতে পারতেন না। স্যারের সেই বাংলাঘরের দেয়ালেই দেখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সেই পোস্টারটা। জলপাই রঙের আধিক্যে ঘেরা সেই পোস্টারের একপাশে বঙ্গবন্ধু আরেকপাশে ইন্দিরা গান্ধীর বিশাল ছবি ছিল, জেনারেল অরোরা আর পাক বাহিনীর সেনাপতির কী যেন নামটা, নিয়াজি, দুজনের চুক্তি স্বাক্ষরের দৃশ্য ছিল নিচের দিকে। আর মাঝখানে বেশ কম্পোজিশনের ছন্দ মেনে ছিল যুদ্ধের ছবি, ট্যাংকের, গোলাবারুদের, ফাইটারের। জল, স্থল এবং আকাশপথ, সব যুদ্ধেরই ছবি ছিল। সেই পোস্টার কি কোথাও কারো কাছে সংরক্ষিত আছে? সময়ের, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল বলেই তো আমার কাছে বিবেচিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে একদিন যেতে হবে! সেখানে হয়তো থাকলে থাকতেও পারে! আমার শৈশবের এক চিলতে স্মৃতিকে নেড়ে আসব!
মুক্তিযুদ্ধ যে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা দিয়ে গিয়েছিল আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রকে, তা আজকের বাংলাদেশ দেখে কিছুতেই বোধগম্য হবে না। নানাবাড়িতে মতি পাগলি বলে এক পাগলি আসত কাজীবাড়ির দিক থেকে। নানাবাড়িতে এই রকম নাম ছিল, কোনও বাড়িকে ডাকা হতো কাজীবাড়ি, কোনও বাড়িকে মোল্লাবাড়ি, ব্যাপারিবাড়ি, খাঁ-বাড়ি। শিয়ালবাড়ি বলেও একটা বাড়ি ছিল, জানি না ও-বাড়িতে শিয়াল নিয়ে কোনও কাণ্ড ঘটেছিল কিনা। তো, সেই কাজীবাড়ির দিক থেকে উন্নায় অনেক পথ হেঁটে নানাবাড়ির পুকুরে গোসল করতে আসত মতি পাগলি। সেই পাগলির দিকে কেউ আঙুল দিয়ে গুলি করার ভঙ্গিমা দেখালেই হলো সে ভয়ে আতংকে জুড়ে দিত কান্না। কোথায় পালাবে কোনোদিকে দিশে খুঁজে পেত না। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি নারায়ণগঞ্জের দিকে কোথায় তার সামনেই তার বাবা-মাকে পাকবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। সে কীভাবে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু ভুলতে পারেনি চোখের সামনে ঘটা চরম নারকীয় দৃশ্যের বীভৎসতা! পরে মাথাটা তার কোনোদিনই ঠিক হলো না। কিন্তু মতি পাগলিকে ঘিরে মানুষের নিষ্ঠুরতাও কম দেখিনি। সে আঙুলে অস্ত্র তাক করলেই ভয় পায় বলে একশ্রেণির মানুষ তাকে দেখলেই হলো আঙুলে অস্ত্র তাক করে তামাশায় মেতে উঠতো। ভীত সন্ত্রস্ত মতি পাগলিকে দেখে তারা বিকৃত আনন্দে হো হো অট্টহাসিতে আকাশ বাতাস ভরিয়ে তুলতো। সেই হাসিসমগ্রের অন্তরালে চাপা পড়ে যেত মতি পাগলির আতংক মেশানো ভয়গ্রস্ত কান্না।
চলবে