আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ২৬

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
কলাবাগান, ১১০ নাম্বার বশিরউদ্দিন রোডের সেই বাড়িটা ছিল একতলা। দক্ষিণে সুপরিসর বারান্দা। তারপর বাগান। বাগান দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পুরোটা জুড়েই। সে বাগানে ফুটে থাকত ছোট ছোট সব গোলাপ। কী স্নিগ্ধতা ছড়ানো ছিল সেই সুঘ্রাণে। সৌরভ পেলেই মন ভালো হয়ে যেত। আজকের মতো গন্ধহীন কাঠখোট্টা গোলাপের অস্তিত্ব তখন ছিল না। বাগানের পরই বাইরের উঁচু সীমান্ত দেয়াল। কিন্তু তাতে কী, গেট দিয়ে বাইরের সড়ক থেকে এ-বাড়ির ড্রয়িং রুমটা স্পষ্ট চোখে পড়ত। ড্রয়িং রুমের বড় বড় জানালাগুলো ছিল সব কাঁচের। বিকেল পড়তে না পড়তেই সেইসব জানালা সব ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা হতো, পর্দা টেনে দেয়া হতো সুচারুভাবে। যেন বাইরে থেকে সামান্যও চোখে না পড়ে ঘরের কাউকে। তারপরও কি ঘরের মানুষগুলোর মন থেকে শংকা কেটেছে? একদমই কাটেনি। রাতে কেউ একা ঘুমানোর সাহস পেত না। এমনকি এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতেও ভয়ে বুক ঢিপঢিপ কাঁপত। আমরা ছোটবড় সবাই একসঙ্গে ড্রয়িং রুমে ফ্লোরিং করে শুয়ে থাকতাম। ড্রয়িং রুমটা ছিল বিশাল বড়। সেটা কি শীতের সময় ছিল? হ্যাঁ, শীত ছিল তখন। বেশ বড় একটা কম্বলের ভেতর একসঙ্গে অনেকেই থেকেছি আটোসাটো হয়ে, এটা খুব মনে আছে।

রাতে মাঝে মধ্যেই ভেসে আসতো নানা রকমের বিস্ফোরণের শব্দ। পুরনো এয়ারপোর্ট কাছে ছিল বলে ফাইটারের তীব্র গর্জনে সারাবাড়ি প্রকম্পিত হয়ে থরথর কাঁপত। সে কী কাঁপুনি! আজ কল্পনাও করা যাবে না। জানালার কাঁচের পাল্লাগুলো কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল, যেন সেই সুতীব্র শব্দে ঝনঝন করে ভেঙে না পড়ে! মাঝে মধ্যে কি সাইরেনও বেজে উঠত? বোধ হয়। আমরা যেদিন ঢাকা ছেড়ে রাজাবাড়ি চলে যাই নানাবাড়িতে, মনে আছে তার আগের রাতগুলো ফাইটারের শব্দের তোড়ে একটুও ঘুমাতে পারিনি। শুধু কি ফাইটার বা প্লেনের শব্দ? বোমা বিস্ফোরণ বা গোলাগুলির শব্দও আসতো মনে হয়। তবে আমার মায়ের জ্যাঠিমা অর্থাৎ আমার বড়নানির বুকফাটা কান্না এখনো কানে বাজে! মায়ের জ্যাঠা এনায়েতউল্লাহ খান ছিলেন ডাক্তার। তিনি আগেই গত হয়েছিলেন। তাদের চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বড়জন কর্নেল মুজিবর রহমান এবং তার কনিষ্ঠ কর্নেল মতিউর রহমান কর্মসূত্রে আটকা পড়েছিলেন করাচিতে। তারা কোনোক্রমেই ঢাকা ফিরতে পারেননি। যুদ্ধাবস্থায় করাচিতে একরকম বন্দিজীবনই কাটাচ্ছিলেন। আমার বড়নানি সারাক্ষণ ছেলেদের দুশ্চিন্তায় কান্নাকাটি করতেন। একটি মুহূর্তও তিনি শান্ত থাকতে পারতেন না।

সারা পরিবেশকে বিষাদগ্রস্ত করে ছেলে দুটোর জন্য ছড়িয়ে দিতেন শোকের মাতম। তার ধারণা ছিল, পাকিস্তান থেকে উনার দুই ছেলে আর কখনো জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরতে পারবে না। তা সত্ত্বেও তিনি ছেলে দুটোর জন্য আশায় আশায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন এবং অবশেষে তার প্রতীক্ষার সফল অবসানও ঘটেছিল। দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর ১৯৭৩ সালে আমার দুই মামাই একসঙ্গে দেশে ফেরত এসেছিলেন। তাদেরকে নাকি দুর্গম খাইবার পাস অতিক্রম করে পালিয়ে আসতে হয়েছে। যেখানে একমাত্র বাহন ছিল খচ্চর। সেই খচ্চরের পিঠে চেপে দুর্গম পথ তাদেরকে পাড়ি দিতে হয়েছিল পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। দেশে ফিরে দুজনই আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কর্নেল মুজিবর রহমান পরে কেন্দ্রিয় কারাগারের ডিজির দায়িত্বও পালন করেছেন।

আমার মুক্তিযুদ্ধের যেটুকু স্মৃতি সে ওই দুই নানাবাড়িকে কেন্দ্র করে। মনে আছে, ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়ার আবছা দৃশ্য। পথেঘাটে সন্ত্রস্ত মানুষ, পুলিশ, মিলিটারি, খাকি রঙ। ব্যস, অতটুকুনই। আর কিচ্ছু মনে নেই। পুলিশ-মিলিটারি দেখেছি, কিন্তু তারা কী করছে সেটা বলতে পারব না। মনে নেই কীভাবে নৌকা পার হয়েছিলাম সে কথাও। তবে জিনজিরা পার হয়ে যখন খোলা প্রান্তরের পথে পৌঁছেছিলাম তখনই অদূরে চোখে পড়ছিল একটা ফাইটার প্লেন ক্র্যাশ করে বিস্ফোরিত হয়ে জ্বলছে। তার আগুন দাউদাউ ছড়িয়ে পড়েছে অনেক উচ্চতায়। সম্ভবত ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানের ফাইটার প্লেন বিস্ফোরিত হয়েছিল সেদিন। পরে যেতে যেতে রোহিতপুর নাকি দিদপুর থেকে আরো অনেক দূরে আরেকটা ফাইটার প্লেন বিস্ফোরণের লেলিহান শিখা লক্ষ্য করেছি। এমনিতেই নানাবাড়ির হাঁটা পথ আমাদের কাছে দীর্ঘ মনে হতো, সেদিন আতংক তাড়ানিয়ার কারণে পথ যেন সহজে ফুরাতেই চাইছিল না।

এই নানাবাড়িতেই আমি প্রথম কাছ থেকে অস্ত্র দেখার সুযোগ পাই। কাটা রাইফেল। মুক্তিযোদ্ধারা এ বাড়িতে নিয়মিত আসতেন। অস্ত্র রেখে খাওয়াদাওয়া সারতেন। তাদেরই একজনের হাতে দেখেছিলাম অস্ত্রটা। বিছানার ওপর রেখে ভাত খাচ্ছিলেন। আমাকে কৌতূহল নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাতে ধরিয়েও দিয়েছিলেন। আমি বলতে হবে বেশ সাহস করেই অনেকক্ষণ হাতের মধ্যে ধরে রেখেছিলাম সেই ওজনদার জিনিসটা। সে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র কিন্তু আমিও ধরেছি, একেবারে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গৌরবজনক। একদিন শুনলাম, রাজাকার ধরে কাচারিঘরে আটকে রাখা হয়েছে। রাজাকার শব্দটি কি সেদিনই আমি প্রথম শুনেছিলাম, নাকি আরো আগেও শুনেছি! তবে রাজাকার ঠিক কী তখনো জানা ছিল না। তাই কৌতূহলী হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম দেখার জন্য। ভারি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম দেখে যে, আমাদের মতোই একজন মানুষ গাছের সঙ্গে বাঁধা। সবাই মিলে সেই মানুষটিকে ধিক্কার দিচ্ছে, থুতু ছিটিয়ে উগরে দিচ্ছে ঘৃণা। কেউ কেউ কিল-ঘুষিও মারছিল। আমার শিশুমনে লোকটির জন্য জেগে ওঠেছিল সহানুভূতি। বোধ হয় সেটাই স্বাভাবিক। সবাই মিলে কেন একজন মানুষকে মারবে! লোকটার জন্য বেশ কয়েকদিন সমবেদনায় মন আচ্ছন্ন হয়েছিল। পরে অবশ্য যখন মুক্তিযুদ্ধকে ভালোভাবে বুঝতে শিখলাম, রাজাকার শব্দটি শুনলে আমার মনেও জাগ্রত হতে শুরু করলো তীব্র ঘৃণা বা ধিক্কার।

পরে সেই রাজাকারের কী হয়েছিল জানি না, একেবারেই মনে নেই। মেরে ফেলা হয়েছিল নাকি গণপিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, কে জানে? যতদূর মনে আছে, সম্ভবত মেরেই ফেলা হয়েছিল। তখন সেই উত্তপ্ত আগুনে-দিনে রাজাকার পেলে তাকে কিছুতেই ছেড়ে দেয়া হতো না, মৃত্যুই ছিল অনিবার্য পরিণতি! কিন্তু সেদিন কি কেউ কল্পনাও করেছিল, মাত্র চার কী পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্বাধীনতা বিরোধী সে-চক্রটি দ্রুতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং একসময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও দখল করে ফেলবে! সত্যি আমরা বড় হতভাগা জাতি! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কত দ্রুত আর কী সহজেই ভূলুণ্ঠিত হলো! এখন একদল মানুষ যেমন সগৌরবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে নিজের পরিচয় জানাতে কুণ্ঠা বোধ করে না; আরেকদল মানুষ মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে আসল মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা।

মুক্তিযুদ্ধের যে-টুকু স্মৃতির কথা আমি বলতে পারলাম, সেটা যে মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ের দিনগুলি সন্দেহ নেই, কিন্তু বিজয়ের কোনও দৃশ্য বা মুহূর্তের কথা আমার সামান্যও মনে নেই। তাহলে প্রাপ্তি বা আনন্দের স্মৃতি কি আমরা সহজেই ভুলে যাই? তবে আব্বা বেশ বড়সড় একটা বই কিনেছিলেন, যুদ্ধের ছবি, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্যাবলি সম্বলিত, সেই বইটির কথা মনে আছে। মনে আছে, বইটা হাতড়িয়ে আমার বেশকিছু সময় কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। পরে যে ঠিক কী হলো সে বইটার, কে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে, কে জানে? কত বই যে নিল মানুষ, বই নিয়ে আর ফেরত দেয় না, আজ অব্দি! নিজেও যদি ভালো করে পড়তো, তবু না হয় একটা সান্ত্বনার জায়গা থাকত যে, অন্তত আমার বইয়ের মাধ্যমে আরেকজন মানুষ আলোকপ্রাপ্ত হলো!

চলবে