
আমার বন্ধু শবনম
পর্ব ৭
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১০, ২০২০
সন্ধ্যা নামতেই এখন কুয়াশা জমতে শুরু করে। রাজধানীর এই অঞ্চলের বাতিগুলো খুবই শক্তিশালী। দোকানপাট থেকেও আলো আসে অনেক। কিন্তু তবু দশ-বারোহাত দূরে গিয়ে কুয়াশায় দুর্বল হয়ে পড়ে আলো। তারপরে তো পুরোটাই ঝাপসা।
বোরকা পরা এক যুবতী হেঁটে আসছে আমার দিকে। আরেকটু কাছে এলে দেখা যায়, মুখটাও নাক পর্যন্ত নেকাবে ঢাকা। কিন্তু আমি ঠিকই চিনে ফেলি শবনমকে। বোরকা-নেকাবে সর্বাঙ্গ ঢাকা থাকলেও কীভাবে চেনা যায় একজন মানুষকে? আলো-আঁধারি পরিবেশেও? সম্ভবত দীর্ঘদিনের দেখার অভ্যাসে একজনের হাঁটার ভঙ্গি, শারীরিক কাঠামো, কিছু মুদ্রাদোষ মুখস্ত হয়ে যায়। তাই মুখ না দেখেও চিনে ফেলা সম্ভব হয় কখনো কখনো।
আমাকে চমক দিতে না পেরে কিছুটা হতাশ শবনম। পাশে বসতে বসতে বলে, আমারে চিনলেন ক্যামনে? বোরকা পইরা মাইয়ারা হাঁইটা গেলে বাপ-মায়েরাও তো চিনবার পারে না শুনছি। আপনের চোখরে তো দেহি এই বয়সেও ফাঁকি দেওন যায় না।
আমি হাসি। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিগ্যেস করি, তোমার হঠাৎ এই সাজ কেন? বোরকা-নেকাব পরেছ কেন?
শবনম দুইহাত পেছনে নিয়ে শরীরটা কিছুটা উল্টা করে ভর ছেড়ে দেয় হাতের ওপর। ক্লান্তির চিহ্ন। তবে উত্তর দিতে দেরি করে না, দিনের বেলাত কুনো মরদের ফেলাটে যাওনের সুমায় বোরকা পরা লাগে। সুবিদার ব্যাপার আর কী!
বুঝলাম। আসলে জানতামও। সবাই জানে। বলি, আজ দুপুরে গিয়েছিলে খদ্দেরের কাছে?
শবনমের এক শব্দের উত্তর, হ।
তাহলে তো তুমি খুব ক্লান্ত। বিশ্রাম দরকার। বাসায় ফিরে যাবে?
শবনম এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে, আপনের লগে গল্প করলে বরং বেশি আরাম লাগে।
হেসে বলি, তাহলে বলো গল্প।
আমার গল্প-কিচ্ছা তো রোজই কই। কিন্তু আপনে নিজের কথা কিছুই কন না। আইজ আপনের কথা শুনমু।
আমি আবার হাসি, আমার কোনো গল্প নাই।
এবার শবনমের কণ্ঠে কৃত্রিম উষ্মা, কইলেই হইল? এত বয়স পার করছেন, আর আমারে কন কুনো গল্প নাই?
আজ আমার বয়সের কথা দুইবার উল্লেখ করল শবনম। অথচ এর আগে কখনো করেছে বলে মনে পড়ে না। বয়সের কথা যখন উঠল তখন বয়স দিয়েই কথা শুরু করি। বলি, আমি এখন খুব বিপজ্জনক বয়সে আছি শবনম। এই বয়সেই পুরুষ মানুষ নষ্ট হয় বেশি। মানে মেয়েঘটিত ব্যাপারে আর কী।
খিলখিল করে হেসে ওঠে শবনম, মনে হইতাছে আপনে কেবল ভোগাল হয়্যা উঠা একখান মাইয়া। মাইয়াগো সেই বয়সে চোখে রঙ আহে। শরীলেও রঙ লাগে। বুক উঁচা হইতে শুরু করে। আর মাইয়ার মা ডরে মরে, এই বুঝি মাইয়া নষ্ট হইব! আপনের এখন সেই বয়স নাকি?
হাসি থামতেই চায় না শবনমের। হাসতে হাসতে প্রায় ঢলে পড়ে আমার গায়ের ওপর।
আমি বলি, পুরুষ মানুষের বেলায় ব্যাপারটা আলাদা।
ক্যান? আলাদা হইবো ক্যান? দেখছি না পুলারা জুয়ান হইতে শুরু করলেই মাইয়াগো পিছনে ছোঁক ছোঁক করে। কত্ত কিছুই না করে হ্যারা একটা মাইয়্যার লাইগা।
তোমার দেখাটাকে ভুল বলছি না। তখন প্রেমে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে ছেলেরা। হয়তো মেয়েরাও। অনেক ঝুঁকি নেয় একজন তরুণ যুবক। দুনিয়া তখনো বেশি দেখা হয়নি তার। তাই ভাবে, এই মেয়েটাকে না পেলে জীবনটাই বৃথা। সেই বয়সের ছেলেরা প্রেমবোধ থেকে এই রকম করে। হয়তো গভীরভাবে বোঝেই না প্রেম কী জিনিস। তবু তারা তাদের মনের সেই সময়কার অবস্থাকেই চূড়ান্ত প্রেম মনে করে। এক ধরনের সরলতা থাকে। রোমান্টিকতা থাকে। একজনের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার মনোবল থাকে। কিন্তু আমার মতো পড়ন্ত যৌবনের মানুষ নষ্ট হয় প্রেম ছাড়াই।
শবনমের কাছে বোধহয় কঠিন মনে হয় কথাগুলো। তবু সে বিরক্তি প্রকাশ না করে শুধু বলে, পুরাপুরি বুজলাম না।
কীভাবে বোঝাই! আমিও কিছুক্ষণ শব্দ হাতড়াই। তারপরে বলি, তরুণ যুবকরা প্রেম চায়। তারা হয় প্রেমিক। আর আমার বয়সের পুরুষরা হয় লম্পট।
হ! কইলেন একখান কথা! অনেক জুয়ান ব্যাডারে আমি দেখছি, হ্যারা লুইচ্চার লুইচ্চা।
সায় দিই, হতে পারে। কিছু তো ব্যতিক্রম হয়ই। তবে তারা বেশিদিন এইভাবে চলতে পারে না। লেখাপড়া চালাতে হয়, নানা রকম চাকরির পরীক্ষায় বসতে হয়। যারা লেখাপড়া বা চাকরি না করে ব্যবসা করতে চায়, তারা সেদিকে মনোযোগ পুরোপুরি ঢেলে দেয়। কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। যুদ্ধ করতে হয় প্রতিদিন। কারণ তারা বুঝে যায়, ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে না পারলে বাকি জীবন কাটবে অনিশ্চয়তার মধ্যে। তাদের কেউ কেউ প্রেমিকাকে বিয়ে করে। কেউ কেউ অন্য কোনো মেয়েকে। বিয়ে করে। ঘর-সংসার করে। চাকরি বা ব্যবসা করে। সন্তানকে নিয়ে ভাবে। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি। না করারই কথা। কারণ ঐ জীবনের সাথে তোমার পরিচয় নেই। বেশিরভাগ লোক বাসা ছেড়ে বের হয় সকাল সাতটায়। আর বাসায় ফেরে রাত দশটা-এগারোটায়। তারা কখন অন্যকিছু নিয়ে ভাববে বলো? হ্যাঁ, এদের মধ্যেও কারো কারো পরকীয়া হয়। একই অফিসে চাকরি করছে এমন নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু তাদের দুইজনকেই তো দিনশেষে নিজের নিজের সংসারেই ফিরতে হয়। তাই বেশিরভাগ পরকীয়া সম্পর্ক শেষও হয় খুব কুৎসিত নোংরা অবস্থার মধ্য দিয়ে।
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে শবনম, আমার বুবু তো বাসাবাড়িত বুয়ার কাম করে। হ্যায় কয় সোয়ামি আর বউয়ের মইদ্যে মাঝে মাঝে মারামারিও হয়। বউ কয়, তুমি অন্য মাইয়ার লগে পিরিত করো ক্যান? সোয়ামি কয়, তুই মাগি অন্য লোকের লগে ঢলাঢলি করিস ক্যান? কিন্তুক কয়দিন পরে আবার দেহা যায়, তারা তারাই দিব্যি সংসার করতাছে।
আমি মাথা ঝাকাই, না করে তো উপায় নেই। যুদ্ধটা বেঁচে থাকার। সন্তানদের বড় করার। তাই একজন আরেকজনকে মাফ করে দেয়। ফাঁটা কাচ আঁঠা দিয়ে জোড়া লাগানোর মতো করে সংসারটাকে জোড়াতালি দিয়ে এগিয়ে নেয়। কোনো কোনো সংসার ভেঙেও যায়।
শবনমকে একটু অসহিষ্ণু দেখায়, আপনে তো কইতাছিলেন এই যারা বুইড়া হওনের পথে তাগোর কথা।
আমি হাসি, হ্যাঁ। আমার মতো যারা বুড়ো হতে চলেছে তাদের কথাই বলছিলাম।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে শবনম, খবদ্দার আপনে নিজেরে বুইড়া কইবেন না! কেডায় কইছে আপনে বুইড়া? এই যে চাইরপাশে যতগুলান মরদ বইসা আছে আপনে হগলডির চায়্যা বেশি ইয়ং।
এবার শব্দ করেই হেসে ফেলি আমি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে মধ্যবিত্তের মতো শবনমও ইংরেজি শব্দকেই লাগসই মনে করেছে।
আমার হাসি দেখে চোখ পাকায় শবনম, খবদ্দার আর কুনোদিন আমার সামনে নিজেরে বুইড়্যা কইবেন না কইলাম!
আচ্ছা আর বলব না।
তো যা বলছিলাম। এইসব সংসারী মানুষের মধ্যেও অনেকসময় বিকৃতি ঢুকতে শুরু করে। জীবনে তো নতুনত্ব বলতে তাদের কিছু নেই। তাই সব একঘেয়ে লাগে। বউটাও পুরনো হয়ে গেছে। তার শরীরও তেমন টানে না আর। আর সংসার-সন্তান দেখতে গিয়ে নিজের দিকে নজর দেবার অবকাশও কম পায় বউরা। হয়তো দরকারও মনে করে না। পুরুষ তখন মনে মনে নতুন খোঁজে। এমনও দেখা যায় পাশে সুন্দরী বউ শুয়ে আছে কিন্তু তার প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণই বোধ করছে না স্বামী। কিন্তু যে বুয়া উবু হয়ে মেঝে মুছছে তার বুকের দোলানি দেখেই লোকটার মধ্যে জেগে ওঠে তীব্র কামনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শবনম, হায়রে পুরুষ মানুষ!
আমারও একটু ছোট দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আমাদের দেশে পুরুষ মানুষ বোধহয় এই রকমই।
ঠিকই কইছেন। শবনম বলে, আমার বুবুরে কতজন ফুসলায়। বুবুও গাঁইথা নেয় দুই-একজনারে। তখন তার মুখ বন্ধ রাখনের লাইগা বেলাউজের মইদ্যে ট্যাকা গুঁইজা দেয় বাড়ির কত্তা।
এবার এসো আমার বয়সীদের কথায়। তাদের তখন সংসারজীবনের দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে আসে। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখানো হয়ে গেছে। যে যার মতো পেশা বেছে নিয়েছে। বিয়ে-শাদিও হয়তো করেছে। সংসারের ঘানি আগের মতো তাকে হয়তো আর টানতে হয় না। এদিকে একটু বয়স হলে বউরা নামাজ-কালাম ধর্ম-কর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। তখন ৫০-৫৫ বছরের পুরুষের শুরু হয় নতুন ছোঁকছোঁকানি। কারো কারো আবার পেচ্ছাপের রাস্তা ঘিরে রাখা প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বেড়ে যায়। সেই গ্ল্যান্ড থেকে বেশি রস বের হয়। রসের কারণে তখন সেই ছোঁকছোঁকানি ডবল হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো যুবতী তো আর তার প্রেমে পড়বে না। সে-ও প্রেম খোঁজে না। খোঁজে শুধু মেয়েদের ভোগ করার সুযোগ। অফিসের বস হলে বাধ্য করতে চেষ্টা করে যুবতী পিএ বা সেক্রেটারিকে বা অন্য কোনো নিচের পদের মেয়েকে। ব্যবসায়ী হলে নিজের ব্যবসার বিভিন্ন কাজ করতে থাকা মেয়েদের। এই যে চাওয়া, এর মধ্যে কোনো প্রেম নেই, কোনো রোমান্টিকতা নেই, কোনো মানসিক নিবেদন নেই, আছে শুধু শারীরিক মিলন। এটাই লাম্পট্য। এই ধরনের লোককেই লম্পট বলতে হয়।
ঝিম ধরে বসে থাকে শবনম। বোঝা যায়, আমার কথাগুলো নিজের ভেতরে যাচাই-বাছাই করছে। শবনম ফেসবুক চালানো নারী নয়। কোনো মেয়ে দুষ্কর্ম করলেও ফেসবুকের নারীবাদীরা তারস্বরে চ্যাঁচাতে থাকে অন্যায়কারী মেয়েটির পক্ষ নিয়ে। শবনমের ওসব বালাই নেই। তাছাড়া ভদ্দরলোকদের প্রতি, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, তার ঘৃণা সবসময়ই। তাই সে বলে ওঠে, ব্যাডা মানুষগো কথা তো কইলেন। মাইয়া মানুষ কি খালি ধর্মই করে? হ্যারা তো দেহি বিউটি পার্লার ভইরা রাখে। হ্যারা কি সুযোগ পাইলে লুচ্চামি করে না?
আমি হাসি। বলি, তাদেরও কেউ কেউ কামনা করে, কেউ আসুক। তাকে নষ্ট করুক। তবে তারা চায়, মিথ্যা হলেও একটা প্রেমের মোড়ক থাকুক। চলবে