বিদ্যা বালান
আমাদের লজ্জা করে না
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯
বিদ্যা বালানের ‘বডি শেমিং’য়ের নতুন ভিডিওটা দেখলাম। নতুন কিছু নাই, সেই একই পুরানো কথাবার্তা। কিন্তু ঘুরেফিরে এই কথাগুলো বারবার আমাদের বলতেই হবে, তাতে করে যদি আমাদের সমাজের মানুষদের কিছুটা চিন্তার পরিবর্তন হয়।
আমাদের সহজাত স্বভাব হলো মানুষের খুঁত খুঁজে বের করা। কারণ আমরা এমন এক জাতি যারা নিজের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যের খামতিকে বড় করে দেখাই। অথচ জীবনে একদিনও চিন্তা করি না, আমাদের নিজেদের কি কি ঘাটতি রয়েছে। কিছু ঘাটতি আমরা চাইলেই খুব সহজে পূরণ করতে পারি, কিন্তু সেটা আমরা করি না। কারণ আমাদের সামনে সহজ পথ খোলা রয়েছে, অন্যের খামতিকে সামনে এনে তাতে চলে যাওয়াটাই আমরা সোজা বলে ধরে নিই। আমাদের লজ্জা করে না।
আমার প্রথম চাকরির সময় বেশ ঢিলেঢালা অফিস করতাম আমরা, কোনো টাইমটেবল নাই। একদিন যুগ্ম সম্পাদক এসে দেখলেন, আমি ছাড়া কেউ নেই অফিসে। উনি আমাকে ডেকে বেশ বকা দিলেন কারণ আমি নিজেও আধাঘণ্টা দেরিতে এসেছিলাম ওইদিন। আমার খুব রাগ হলো। বললাম, আমিতো তবু এসেছি, যারা আসেনি আপনি তাদের ধরুন। উনি বললেন, মারিয়া কে কি করল, সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে তুমি জীবনেও সামনে এগুতে পারবে না, তোমাকে সবার পিছেই পড়ে থাকতে হবে। মাহমুদ ভাই মারা গেছেন আজ অনেক বছর। কিন্তু আমাকে যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তার সুফল আমি সবসময় ভোগ করি। ওইদিনের পরে আর কারো দিকে দেখার দরকার হয়নি আমার, আমি নিজের মতো করে নিজের পথে চলেছি।
তবে হাজার চেষ্টা করেও আমরা অনেকেই একটা বিষয়ে নিজেদের বদলাতে পারি না, তা হলো আমাদের স্বাস্থ্য। আমরা কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ মোটা, কেউ পাতলা, কেউ কালো, কেউ ফর্সা। পৃথিবীর কোনো মানুষই অন্যকোনো মানুষের মতো নয়। সব মানুষ আলাদা। আমি চাইলেই দুইইঞ্চি লম্বা হতে পারবো না বা একজন কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষ স্বাভাবিকভাবে রাতারাতি ফর্সা হয়ে যেতে পারবে না। একেক মানুষের শরীরের গড়ন একেক রকম। কেউ হ্যাংলা পাতলা, কেউ বেশ গোলগাল। রাতারাতি চাইলেই সেটা বদলে আমরা হলিউড বা বলিউডের অভিনেতাদের মতো সুন্দর-সুঠাম হয়ে উঠতে পারি না। এই চরম সত্য কথাটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না বলেই, অন্যদের নিয়ে বডি শেমিং করি।
বডি শেমিংয়ের বড় শিকার আমাদের সামাজের নারীরা। আমরা লম্বা, ফর্সা আর মোটামুটি মাঝারি গড়নের মেয়েদের সুন্দরী বলে ধরে নিয়েছি। আমাদের তৈরি মাপকাঠির বাইরে এক ইঞ্চি এদিক সেদিক হলেই সে মেয়ে সুন্দর নয়। এই ধারণা এমনভাবে আমাদের মনেপ্রাণে গেঁথে গিয়েছে, আমরা এই মাপকাঠির বাইরের মেয়ে দেখলেই লেগে পড়ি তার পিছে। আমার নিজেরই হয়তো বিশাল একটা ভুড়ি, আমি অন্য এক জনকে বলে বসি, আল্লাহ তুমি আরো মোটা হয়ে গেছ। বা আমার নিজের গায়ের রঙ মলিন, আমি আরেকজনকে বলি, তুমি তো বেশ কালো হয়ে গেছ।
কেন করি এইসব? উত্তর খুব সহজ, আমরা নিজেদের অতৃপ্তি নিয়েই নিজেদের মধ্যে গুমরে মরি আর স্বভাবজাতভাবেই তা লুকাতে অন্যকে হেয় করি বা অন্যের খামতি সামনে এনে সান্ত্বনা নেয়ার চেষ্টা করি। আমরা মুখে আল্লাহ-খোদার নাম নিয়ে ফেনা তুলে ফেলি। আমাদের ধারণা পাঁচওয়াক্ত নামাজ, রোজা, পর্দা করা, এই হলেই হবে, আর বাকি কিছুর প্রয়োজন নাই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের পূর্বশর্তই হচ্ছে, তার সৃষ্টিকে ভালোবাসা, সেটা আমরা বুঝি না, মানে ঐটুকু বুঝার মতো আমাদের মানসিক বিকাশ হয় নি।
আমরা বুঝি না, সৃষ্টিকর্তা যাকে যেভাবে বানিয়েছেন, পরম যত্ন করে আর ভালোবাসা দিয়ে বানিয়েছেন। আর যে যেমন, তাকে সেভাবেই দেখাটা আমাদের বন্দনার মধ্যে পড়ে। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ধুয়ে পানি খাওয়া কাজের কাজ না, বরং একটা মানুষ আসলেই সেই অর্থে কতটা মানুষ তা নির্ধারণ করে তার ভেতরের রূপ। আমরা নিজেদের বাহ্যিক ত্রুটি নিয়ে এতই চিন্তায় থাকি যে, আমাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা থাকে একদম শূন্যের কোটায়। এই অবস্থা নিয়ে আমরা নিজেদের স্বাভাবিক কাজগুলাই ভালোভাবে করতে পারি না, মহৎ কাজ কিভাবে হবে আমাদের দ্বারা? এই হীনমন্যতায় বেশি ভুগে আমাদের নারীরা। কারণ, একজন পুরুষ অন্য পুরুষের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েই এনিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়।
আমাদের সমাজে পুরুষের চোখে নারী ভোগের বস্তু, ব্যতিক্রম আছে। আর আমরা নারীরা নিজেদের পুরুষের চোখে দেখেই অভ্যস্ত, তাই নিজেরাই সারাদিন নিজেদের বডি শেমিং করে নিজেদের হীনমন্যতা কাটাই। আমাদের এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। কাউকে কাউকে কারো থেকে বেশি সুন্দর লাগতেই পারে বা নিজেকে একটু ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেতেই পারে, তাতে দোষের কিছু নাই। বা সুস্থতার জন্য নিয়মিত কিছু শরীর চর্চা করা উচিত সবার, তারমানে এই না যে আমাকে সবসময় ক্যাটরিনা কাইফের মতো দেখতে লাগবে। আমিও স্বাভাবিক মানুষ, আমারও বয়স হবে, বয়স আর পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে আমারও পরিবর্তন হবে। তাতে চিন্তারও কিছু নাই বা অন্যকে বাজে দেখতে লাগছে বলে আত্মতৃপ্তিরও কিছু নাই।
মূল বিষয় হচ্ছে, শারীরিক আর মানসিকভাবে সুস্থ থাকা। নিজের কাজ সুন্দরমতো সম্পন্ন করা। কে দেখতে কেমন তা দিয়ে কী হয়? নিজেদের ভোগের সামগ্রী না ভেবে আমাদের উচিত, সৃষ্টিশীল কাজে মন দেয়া। নিজেরা হীনমন্যতা থেকে বের হয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করি আর অন্যদের ছোট না করি, সেটাই আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী