আমাদের পথ
বুরহানউদ্দিন আজাদপ্রকাশিত : মে ১৯, ২০১৯
হযরত ইব্রাহীম (আ) আগুনে পুড়েননি, আগুন আল্লাহ তালার ইশারায় তার জন্য বাগানে পরিণত হয়েছিল, অপরদিকে আসহাবে উখদুদ এর সেই কাহিনী যখন আমরা সুরা বুরুজে পড়ে থাকি তখন দেখতে পাই তারা সকলেই পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছিলেন। এখানে কে সফল আর কে ব্যর্থ?
কোরআন আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলেছে, তারা উভয়েই সফল। ইসমাইল (আ) এর গলা ছুড়ি দিয়ে কাটেনি কিন্তু জাকারিয়া (আঃ) দ্বি খণ্ডিত হয়েছিলেন এখানে কে সফল? এরকম হাজারো উদাহরণ মানব জাতির ইতিহাসে রয়েছে। কুরআনে সফলতার সংজ্ঞায় কি বলা হয়েছে? আল্লাহ তায়ালা সুরা আলে ইমরানে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সফলতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন,
﴿كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۖ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ﴾
অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে মরতে হবে এবং তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন নিজেদের পূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে। একমাত্র সেই ব্যক্তিই সফলকাম হবে, যে সেখানে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে এবং যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর এ দুনিয়াটা তো নিছক একটা বাহ্যিক প্রতারণার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। (আল বাকারা, ২-৫; আল ইমরান, ১০৩, ১৩০ ও ২০০; আল মায়েদাহ, ৩৫ ও ৯০; আল আন`আম, ২১; আল আরাফ, ৭-৮ ও ১৫৭; আত তাওবাহ, ৮৮; ইউনুস, ১৭; আন নাহল, ১১৬; আল হাজ্জ, ৭৭; আল মু`মিনুন, ১ ও ১১৭; আন নূর, ৫১; এবং আর রূম, ৪৮ আয়াত) এই আয়াত সমূহতেও আসল সফলতা কি সেটার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
আজ কেন যেন দুনিয়াবী সফলতাকেই সকলেই বড় করে দেখেন। সমাজের চাহিদার আলোকে কেঊ সফল হতে না পারলে, তার পথ যতই সঠিক হোন না কেন তাকে ব্যর্থ হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। আজ আমরা যারা নিজেদেরকে ইসলাম পন্থী বলে বিবেচনা করি তারাও কেমন জানি, শক্তির কাছে, সফলদের কাছে (যেভাবেই সফল হোক না কেন) মাথা নত করি। কিন্তু ইসলামী দাওয়াতের ধারক ও বাহক নবী রাসুলদের পথ কি এমন ছিল? তারা তো সমাজের প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধেই লড়াই করেছিলেন।
হযরত মুসা (আঃ)তার সময়ের রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক মহা শক্তিধর শাসক ফিরাউনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তার সময়ের সবচেয়ে ধনী, পুঁজিবাদের প্রতীক কারুনের কাছ থেকে যাকাত চেয়েছেন, আল্লাহ তালার পথে ব্যয় করতে বলেছেন। মুরশিকী ধর্মের সব চেয়ে বড় আলেম বেলাম বারায়ুয়িকে সত্য ধর্মকে গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, পাশ্চাত্য সভ্যতায় যেটা ‘’অধিকার’’ বলে বিবেচিত হয় সেটাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১। শক্তি
২। সংখ্যা গরিষ্ঠতা।
৩। শ্রেষ্ঠত্ব। আমি তোমার চেয়ে সুন্দর, আমার চামড়া সাদা, আমার ডিগ্রী বেশি, আমি উচ্চ বংশের সন্তান এসকল বিষয়কে শ্রেষ্ঠত্ব বলে বিবেচনা করা।
৪। স্বার্থবাদিতা
আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা মুলত এই ভিত্তি সমূহের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। বুশ যখন ইরাকে আক্রমন করেছিল তিনি বলেননি যে, আমি যে কাজসমূহ করতেছি এগুলা জুলুম ’আমি তোমাদের উপর জুলুম করতেছি।‘ বরং তিনি বলেছিলেন আমার শক্তি আছে ,আমার সেনাবাহিনী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী, তাই আমার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যা করা দরকার তাই করব। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে এর সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষাই দিয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো কক্ষনোই ‘’অধিকার’’ বলে বিবেচিত হতে পারে না। যদি একজন মানুষও সত্য কথা বলে আর দুনিয়ায় সকল মানুষ সেটার বিরোধীতা করে তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে সেই একজন মানুষই সঠিক পথে, আর সকলেই ভুল পথে।
কুরআন আমাদেরকে এই কথাই বলেছে। ইসলামের ইতিহাস এই কথা প্রমান করেছে যে শক্তি, সংখ্যাধিক্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং স্বার্থবাদীতা কক্ষনোই সত্যকে সত্যায়িত করতে পারেনা। সত্য তার নিজের আলোতেই আলোকিত কোন ধার করা আলো নিয়ে তাকে চলতে হয় না। সাময়িক ভাবে সত্যের পরাজয় হলেও একটা সময় সত্য আপন শক্তিতে উদ্ভাসিত হয় এবং সত্যের যে কোন পরাজয় নেই, সত্য যে পরাভুত হয় না এটা সকলের সামনে প্রদীপ্ত সূর্যের মত প্রকাশিত হয়। এই পথ হল সেই পথ যখন হাবিল তার ভাই কাবিলকে বলেছিলেন, ﴿لَئِن بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ ۖ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ﴾ তুমি আমাকে মেরে ফেলার জন্য হাত উঠালেও আমি তোমাকে মেরে ফেলার জন্য হাত উঠাবো না। আমি বিশ্ব জাহানের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি।
সেদিন হয়ত হযরত হাবিল পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন কিন্তু আজ ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে সেদিন কে পরাজিত হয়েছিল? হযরত দাউদ আ যখন তার সেনাদল নিয়ে জালুত এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِالْجُنُودِ قَالَ إِنَّ اللَّهَ مُبْتَلِيكُم بِنَهَرٍ فَمَن شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَن لَّمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّي إِلَّا مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ ۚ فَشَرِبُوا مِنْهُ إِلَّا قَلِيلًا مِّنْهُمْ ۚ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لَا طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ ۚ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَاقُو اللَّهِ كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾
``তারপর তালুত যখন সেনাবিহনী নিয়ে এগিয়ে চললো, সে বললোঃ “ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নদীতে তোমাদের পরীক্ষা হবে। যে তার পানি পান করবে সে আমার সহযোগী নয় ৷ একমাত্র সে-ই আমার সহযোগী যে তার পানি থেকে নিজের পিপাসা নিবৃ্ত্ত করবে না ৷ তবে এক আধ আজঁলা কেউ পান করতে চাইলে করতে পারে ৷ কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া বাকি সবাই সেই নদীর পানি আকন্ঠ পান করলো ৷ অতপর তালুত ও তার সাথী মুসলমানরা যখন নদী পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তখন তারা তালুতকে বলে দিল, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যারা একথা মনে করছিল যে, তাদের একদিন আল্লাহর সাথে মোলাকাত হবে,তারা বললোঃ “ অনেক বারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের ওপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথি ৷”
সেদিন যারা তৃপ্তির সাথে পানি পান করে বসে বসে যুদ্ধ দেখতেছিল তারা নিশ্চয় নিজেদেরকে অনেক বুদ্ধিমান মনে করেছিল। কারন তারা সংখায় বেশী ছিল। অপরদিকে স্বল্প সংখ্যক লোকের সেই খুদ্র দলটিই সেদিন আল্লাহর রহমতে বিজয় লাভ করেছিল।
হযরত ইব্রাহীম (আ) যখন তার পিতাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ﴿وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً ۖ إِنِّي أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾ ``ইবরাহীমের ঘটনা স্মরণ করো যখন সে তার পিতা আযরকে বলেছিল, তুমি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করছো? আমি তো দেখছি, তুমি ও তোমার জাতি প্রকাশ্য গোমরাহীতে লিপ্ত৷``
তার পিতা সহ তার সমগ্র জাতি গোমরাহীতে লিপ্ত থাকার পরও এত বিশাল জনবশতিকে তিনি গোমরাহ বলতে দ্বিধা করেননি। কারণ তিনি জানতেন সংখ্যাধিক্য কক্ষনো সত্যের উৎস হতে পারেনা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা কক্ষনো ন্যায়-অন্যায়ের পথ নির্দেশ করতে পারে না। ইউসুফ (আ) যখন তার ভাইদেরকে বলেছিলেন, ﴿قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ ۖ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ ۖ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ﴾ সে জবাব দিল, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন৷ তিনি সবার প্রতি অনুগ্রহকারী।`
তিনি তার বিজয়ে অহংকারী হননি, তার মনে তার ভাইদের প্রতি প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেনি। তিনি জানতেন তার পথ কি? তিনি এর মাধ্যমে সকল বিজয়ীদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন দুনিয়ার বিজয় আসলে কোন বিজয় নয়। এটা আল্লাহর একটি পরীক্ষা মাত্র। আসহাবে কাহাফের যুবকগন যখন মুশিরিকী ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল তখন তারা সেই অসীম শক্তির নিকট মাথা নত করেনি তখন তারা দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেছিল, فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَٰهًا ۖ لَّقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا﴾) তারা বলে উঠলো এবং ঘোষণা করলোঃ “আমাদের রব তো কেবল তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব। আমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কোনো মাবুদকে ডাকবো না। যদি আমরা তাই করি তাহলে তা হবে একেবারেই অনর্থক।”
তারা সেই সময়ের পরাক্রমশালী বাদশাদের কোন পরওয়া করেনি। তারা সেই দিন গুহায় আশ্রয় নিয়ে হয়ত সাময়িক ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির জন্য এক নিদর্শন করেছেন এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ সত্য দ্বীন গ্রহন করেছিল। আল্লাহ তাদেরকে এক মহাসত্যের প্রতীক হিসাবে মানব জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। তাই আজকের পরাশক্তিসমূহকে ভয় করে নয়, কুরআন আর সুন্নাহকে বুকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি আমাদের বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সকল প্রকার লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সাময়িক সফলতার ঘোরে বিভোর না হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে মানবতা আজ যে সংকটময় অবস্থায় আছে সেখান থেকে মুক্তি পাবে।
এমন একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে যেমন ইতি পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মদিনায়, শামে, বাগদাদে, আন্দালুসিয়াতে, মাওয়ারাউন নাহরে, দিল্লিতে, গজনিতে এবং ইস্তানবুলে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ যে সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজ পর্যন্ত কেউ তা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, আর পারবেও না কারণ কোরআননের শিক্ষা ছাড়া কক্ষনো একটি ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না। আল্লাহ আমাদেরকে সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অটল থাকার তওফিক দান করুন।