‘আমরা হেঁটেছি যারা’ মূলত জাহান্নামের ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি
কামরুল আহসানপ্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২০
ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসটি পড়লে মনে হবে, আপনি জাহান্নামের ওপর দিয়ে হাঁটছেন। এবং এই জাহান্নানের নাম, বলার অপেক্ষা রাখে না, নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছেন বাংলাদেশ।
রাত হলেই রাত বাহিনী আসে। ‘তারা আসে নিঃশব্দে, ঠোঁটটা ঢেকে রাখে খুব ভালো করে গামছা দিয়ে যাতে গলার স্বর কেউ চিনতে না পারে। হঠাৎ গুলির আওয়াজে আশপাশের মানুষজন বুঝতে পারে কেউ আবারও মারা গেল আর হননযজ্ঞ শেষে নিশ্চয়ই রাত বাহিনী চলে গেল। কোনও কোনও সময় ওরা গুলির আওয়াজও যাতে অষ্পষ্ট হয়ে যায় আর নিজেরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে সেজন্যে শিকার করা মানুষটাকে নিয়ে যায় খোলা মাঠে, চাষবাসের খেতে। হাত-মুখ-পা বাঁধা শিকার, যাকে ওরা বলে শ্রেণিশত্রু, সে হয়তো আকাশমুখী, কিন্তু আকাশটাকেও দেখে যেতে পারে না মরার আগে। কিংবা কখনও তারা গ্রামবাসীদেরও ডেকে আনে। বোঝানোর চেষ্টা করে, শ্রেণিবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, এবার তবে শ্রেণিশত্রু খতম করার পালা।
তারপর আসে রক্ষী বাহিনী। ‘রাত বাহিনীর সঙ্গে রক্ষী বাহিনীর আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাদের কোনও দিনরাত নেই। নেই এত সাবধানতা। যেকোনোও মুহূর্তে তারা বুটের গমগম আওয়াজ তুলে যেতে পারে যেকোনো স্থানে। বুটের তলায় রাস্তার অমসৃণ খানাখন্দে জমে থাকা পানিও ভয় পায় ছিটকে উঠতে। এই বারো তেরো বছর বয়সেই আমি এতকিছু জেনে গেছি খুব ভালোভাবে, জেনে গেছি রক্ষী বাহিনীর জামার হাতায় তর্জুনি তোলা কাটা কব্জি আঁকা থাকে। বড় চুল মোটেই পছন্দ করে না তারা। অবশ্য তারা কী পছন্দ করে তাও বোঝা যায় না ভালো করে। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরের স্কুলঘরে ক্যাম্প পেতেছে তারা, রাত বাহিনীর লোকেরা এক রাতে এসে সোবহান খানের গলা কেটে রেখে যাওয়ার পরে। মাঝে মাঝে বাবার খোঁজেও আসে তারা। যেমন আজ এসেছে। কড় নাড়ছে ঘটঘট আওয়াজ তুলে। আমি দরজা ভাঙার আগেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি দরজাটা খুলে দিতে। মা-ও উঠে বসে হুড়মুড় করে। মনীষা ভয়ার্ত চোখের মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর দরজা খুলতেই রক্ষীর দল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে, ‘কনে, কনে হারামজাদা’ বলতে বলতে।
আমার ঠোঁট দপদপ করে কাঁপতে থাকে। জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তুলি বারে বারে। ওদের বলা সেই হারামজাদা মানে আমার বাবার খবর আমরাও জানি না কতদিন হয়ে গেল। কিন্তু বারবার বলার পরেও বিশ্বাস করানো যায়নি ওদের এই সত্য। এখন আর কিছু বলি না আমরা কেউই, শুধু না বলা কথাগুলো নীরবে আমাদের ঠোঁটের ওপর কম্পন তুলতে থাকে। নীরবে আমরা দেখি ওদের খানা-তল্লাশি, দেখি ভেঙে ফেলল মাচার ওপর রাখা হাঁড়ি-কোলা, ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ল আসন্ন খন্দের জন্যে সযত্নে রেখে দেয়া ফসলের বীজ। কিংবা কখনও ওরা ভেঙে ফেলে গরুদের খড় ভিজিয়ে খাওয়ানার নান্দা, একটা ষাড় খুলে নিয়ে যায় অনেকদিন পর ভালোমন্দ খাবে বলে। রক্ষীদের অনেকদিন মানেই প্রতিদিন তা এতদিনে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি আমি। প্রতিদিনই ওরা হানা দেয় কারও না কারও ঘরে, গরু-ছাগল না হলে মোরগ-মুরগি ধরে নিয়ে যায়। আর বিকৃত দেঁতো হাসি ছুঁড়ে প্রতিবারই বলে,‘ অনেকদিন ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া হয় না, কিছু মনে কইরেন না।
গল্পের বয়ানকারীর নাম তথাগত। তথাগতর বাবার নাম উপন্যাসে উল্লেখ ছিল কিনা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। বইটা আমি মার্চ মাসে পড়েছিলাম। এখন অনেক ঘেঁটেও তার বাবার নাম কোথাও চোখে পড়ল না। যতদূর বুঝতে পারছি পরিবারটা মুসলমান। মূল চরিত্রের নাম তথাগত রাখার পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে। বুদ্ধকে তথাগত বলা হয়। তথাগত শব্দের অনেকগুলোর অর্থের একটা হচ্ছে ‘এভাবে যিনি অধিগমন করেন’। আমাদের এ-উপন্যাসের নায়কও অনেকগুলো পরিস্থিতি বা সংকটের মধ্য দিয়ে অধিগমন করেন।
তথাগতর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পার্টি করতেন। একদিন রাত বাহিনী তার কাছে চাঁদা দাবি করে। ২৫ হাজার টাকা। রাত বাহিনী তাকে জোতদার মনে করে। যদি উপন্যাসের এক জায়গায় উল্লেখ আছে তার খুব সামন্যই জমি ছিল। যা তার দাদা বিলের মাঝখানে দিয়ে গেছে। আর সেখানেই বাড়ি বানিয়ে তিনি থাকতে শুরু করেছেন। তথাগত মা মারা যাবার ফলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে একটা মেয়ে আছে। সেই মেয়ের নাম মনীষা। গ্রামের সবাই তথাগতর পিতাকে মাস্টার সাহেব বলে ডাকেন। যদিও কোনো স্কুলে তিনি পড়ান না। উপন্যাসের ৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, তথাগত মুখ দিয়েই সেটা বলানো হয়, তাদের পনের-বিশঘর বর্গাদার আছে। অর্থাৎ তারা তথাগতদের জমি চষে খায়। এখানে আবার বোঝা যায় তাদের জমি-জিরাত ভালোই ছিল।
রাত বাহিনী চাঁদা চেয়ে চিঠি লেখার পর তথাগতর বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী, মনীষার মা, বলেন, তুমি এতদিন হলো পার্টি করছ, মুক্তিযুদ্ধ করলে, এ থানার সবাই মানে তোমাকে, রক্ষী বাহিনী কিছুই করবে না তোমার জন্যে?
এ-প্রশ্ন আমাদেরও। এ-প্রশ্নের উত্তর তথাগতার পিতা দেন, যেটা তথাগত শুনে নির্ঘুম রাতে, এই প্রথম সে বাবাকে মায়ের নাম বলতে শুনে, হাতি পাঁকে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে তনু। মোস্তফা ভাই তো অনেক আগে থেকেই আমার পিছে লেগে আছে। আর রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার সব শুনে হাসতে হাসতে কী বলেছে জান? বলছে, তো ওদের যদি ২৫ হাজার টাকা না দিতে চান আমাদের তো কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে, না কি বলেন?
এরপর তথাগতর পিতা রক্ষী বাহিনীর কিছু সমালোচনা করেন। স্ত্রীকে বলা সেইসব কথা তথাগত শুনে। ‘বাবার আত্মমগ্ন কথা শুনি, এদের দিয়ে মুজিব ভাই দেশ গড়বে? হবে না, কিচ্ছুই হবে না দেখ। মুজিব ভাই যদি মনি ভাইদের কথা না শুনে তাজ ভাইদের কথা শুনত, নিদেনপক্ষে দাদাভাইকেও সাথে রাখতে পারত তাহলে কি আর এই দশা হয় আওয়ামী লীগের!’
কথা শুনে আন্দাজ করা যায় এই ভদ্রলোক পার্টির প্রথম শ্রেণির নেতাই। শেখ মুজিবকে মুজিব ভাই বলছেন, সিরাজুল আলম খানকে দাদাভাই বলছেন, মনে হচ্ছে সিরাজুল আলম খানের সাথে তার পরিচয়ও ছিল; কিন্তু, এই ভদ্রলোক পরবর্তীতে যে-সব কাজ করেন সেগুলো কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। রাত বাহিনী ও রক্ষী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি জাসদে যোগ দেন, এবং গৃহত্যাগ করেন। গৃহত্যাগের আগে ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে তিনি অডিসিউসের গল্প শুনিয়ে যান। প্রায়ই সকালে তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন এবং অনেক অদ্ভুত কথা শুনাতেন।
একটি অপূর্ব পরিচ্ছেদের বর্ণনা এরকম: ‘তখনও আমার পায়ে ভোরবেলার শিশির লেগে আছে। অথবা আমি সখ করে একটা চোরকাঁটা তুলেছিলাম, তখনও তা দাঁতের ফাঁকে পিষ্ট হচ্ছে। হয়তো-বা হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে গিয়েছি দূরে, বহুদূরে। বাবা ডান হাতের তর্জনি তুলে আমাকে বলছে, ওই যে দূরে পশ্চিমদিকে যে গ্রামটা দেখছ ওটার নাম আলোক দিয়ার। আর ওর পাশেই যে দেবদারু গাছওয়ালা বাড়িঘরগুলো দেখা যাচ্ছে ওটার নাম পাথারপাড়া। আর ওই যে রেলব্রিজ ওটার নিচেই পায়রা নদী। এক শরতের ভোরবেলার কথা এখনও জীবন্ত আমার কাছে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি, রাস্তার পাশের শিউলি গাছ থেকে ফুল ঝরে রাস্তা ঢেকে গেছে। বাবা সেখানে গিয়ে থমকে গেল, আমার দিকে তাকিয়ে মুখে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, তুমি কি তোমার গায়ে হালকা বাতাসের ছোঁয়া পাচ্ছ?’
তথাগতর বাবা তথাগতকে অনেক জ্ঞানের কথা বলেন। যার কোনোটা তথাগত বুঝতে পারে, কোনটা পারে না। তথাগত তখন মাত্র প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে বাবা তার জীবনের পথ তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু, এহেন বাবা যখন একদিন, ছেলেমেয়েদের অনিরাপদ রেখে দূরে কোথাও চলে যান তখন তার জ্ঞানগর্মি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়। লোকটাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে হয়। তিনি চলে যাবার পর বাড়িতে রাত বাহিনী আসে। তাকে খুঁজে না পেয়ে তার বইয়ের আলমারিটা ভেঙে ফেলে। বইগুলো উঠানে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বাবার বই সংগ্রহ ও লাইব্রেরি বানানো নিয়ে দুপৃষ্ঠাব্যাপী ফেনানো বর্ণনা আছে, শীতের রাতে দুই ভাইবোন বহ্নুৎসবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, এই দৃশ্যটাকে যথাসম্ভব বেদনার্ত করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখান থেকে লেখক হঠাৎ করে চলে গেছেন ভবিষ্যতের এক দৃশ্যে। ‘অনেকদিন পরে আবারও মনে হবে এই দিনের কথা। তখন কিন্তু সত্যি সত্যি শীত। আমি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, পুরানো অভ্যাসে হাঁটতেই বেশি ভাল লাগে জনে। হঠাৎ একটি রিকশা ব্রেক কষে আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে যাবে। রিকশা থেকে লাফিয়ে মারিয়া নেমে আসবে...’
অনেক কথা। ছ-সাতপৃষ্ঠা মারিয়ার কথা বলে লেখক আবার আগের জায়গায় আসেন, ‘সেই সকালেই রক্ষী আসে।’ রক্ষীরা এসে তথাগত বাবার খোঁজ করে, পোড়া বই মাড়ায়। তথাগত মাকে দুচারটা কূটকথা শুনিয়ে আবার আসবে বলে চলে যায়। ‘বিকেল পার হয় না, তার আগেই রক্ষীরা আবার আসে। এবার তারা উদ্যত, রুক্ষ, চোখেমুখে লকলক করছে জিঘাংসা আর তীব্র ঘৃণা। আমাদের তার কারণ বুঝবার সুযোগ না দেয় না তারা। আসার পথেই গরুকে পানি খাওয়ানোর বড় নান্দাটা লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে তারা। চিৎকার করতে থাকে, কনে গিয়েছে হারামজাদা? শুয়ারের বাচ্চা জাসদে যোগ দিয়েছে? ভাবছে জাসদে যায়ে পার পাবে? অর জাসদ করা বা’র করব’।
রাত বাহিনীর মতোই তাণ্ডবে মেতে উঠে রক্ষীর দল। যাবার সময় ষাঁড়টাকে খুলে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একরাতেই তথাগত ভীষণ বড় হয়ে যায়। আর এই সময় ভাইবোন আরো বেশি বেশি কাছে আসে। সেই বেশি কাছে আসাটা কতোদূর পর্যন্ত হতে পারে তা পরে বলব। বাবার অনুপস্থিতে তথাগতর খাতির জমে ওঠে স্কুলবন্ধু সোলায়মান আর হালিম নানার সঙ্গে। তখন তথাগতদের দিন যাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। একবেলাও পেট ভ’রে খাবার জুটে না। (অথচ তাদের পনের-বিশঘর বর্গাদার আছে এটা কিন্তু উপন্যাসে উল্লেখ আছে)। হালিম নানার সঙ্গে তথাগত বহুপথ হাঁটে। হালিম নানা তাকে কখনো এটাসেটা খেতে দেন। তথাগত হালিমকে নানা বললেও হালিম তাকে বলে বাজান। হয়তো সেটা ছাপার ভুল। হালিম তথাগতকে জীবনের পাঠ দেন ঘাস চিনিয়ে, ধান চিনিয়ে, বীজ চিনিয়ে। গ্রামে রক্ষী বাহিনীর তা-ব থেমে থাকে না। নানা মানুষের ওপর তারা নানারকম অত্যাচার চালায়। এর মধ্যে বর্ষা আসে। বর্ষার অপরূপ বর্ণনা আছে। অপরূপ প্রকৃতির মধ্যেই লেখক হঠাৎ আবার আঁকেন বিষাক্ত চিত্র। একদিন কচুর লতি তুলতে গিয়ে কচুর পাতা সরিয়ে মনীষা তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। ‘আমি ওর চিৎকারকে অনুসরণ করে পাতার ফাঁকে তাকাই, এবং আমিও ভয়ে শিটকে উঠি, একটা শীতল পানির ধারা আমার মেরুদণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং সবগুলো লোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। আমাদের অজান্তেই আমরা দুজন একজনের হাতের আঙুল দিয়ে আরেকজনের হাতের আঙুল পেঁচিয়ে ধরি। কেননা নালার মধ্যে কচুপাতার ফাঁকে পড়ে আছে একটা গলাকাটা লাশ, গায়ে কিছু নেই, লুঙ্গিটা কাছামারা।... দৌড়াতে দৌড়াতে অপু-দূর্গার রেলগাড়িকেও ছাড়িয়ে আসি আমরা।’
এর মধ্যেই মায়ের কথায় স্কুলে যাওয়া আসা করতে হয় দুভাইবোনকে। অবসর সময়ে তথাগত সোলায়মানের বাবার দোকানে বসে রেডিও শুনে। একদিন আর গান বাজে না রেডিওতে। মেজর ডালিম নামে কে একজন বারবার বলে শেখ মুজিবকে নাকি সপরিবারে খুন করা হয়েছে। এরপর স্কুলে ঘোষণা করা হয় সরকার জাতীয় পোশাক ঠিক করেছে। ছাত্রদের সবাইকে পাঞ্জাবি আর টুপি পরে আসতে হবে, ছাত্রীদের পড়তে হবে সালোয়ার কামিজের সঙ্গে বিছানার চাদরের মতো ওড়না। তথাগত ভাবে, ‘মনীষার ওড়নাটা নাহয় মা’র শাড়ি ছিঁড়ে বানানো যাবে, বাবার পাজামা পাঞ্জাবি কি আর লাগবে আমার! এই দুর্দিনে মায়ের পক্ষে কি আর সম্ভব হবে আমাকে পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে দেয়া! তারচেয়ে এখন বর্গাদারদের খেত চষার জন্যে, হালআবাদ আর সার বীজ কেনার জন্যে টাকা দেয়া অনেক বেশি জরুরি।’
তবুও তথাগত মন দিয়ে মৌলভী স্যারের কথা শুনতে থাকে। ‘মৌলভী স্যার মনে হয় হেড স্যার আর গেম স্যারদের জব্দ করার বেশ ভাল মওকা পেয়েছেন আজ। জোরে জোরে মুখ বাঁকিয়ে তিনি কথা ছুড়ে চলেছেন, আগে যা হয়েছে, হয়ে গেছে, এখন আর বেশরিয়তী কাজকাম চলবে না। আল্লাহ কখনও সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। কত বড় বড় স্লোগান শুনলাম, সব স্লোগান বরবাদ হয়ে গেল। খোদার গজম এইভাবেই নামে। এক নেতা এক দেশ, এক রাতেই সব শেষ। খালি তাই না, গুষ্টিসুদ্ধ সব শেষ। মাদ্রাসা তুলে দিতে চেয়েছিল, এখন নিজেই উঠে গেছে।’
আরো অনেক কথা আছে মৌলভী সাহেবের। ইতিহাসে তা হয়তো সত্যিই, কেউ কেউ এরকম বলেছিল, কিন্তু, উপন্যাসে একজনের সংলাপে একবারে এতো কথা কিছুটা বিরক্তিই লেগেছে। সেদিনই তথাগত বাড়ি এসে দেখে বাবা ফিরেছেন। প্রায় তিন বছর তিনি বাড়ি ফিরলেন। এতদিন বাড়ির সাথে তার কোনোরকম যোগাযোগ ছিল এরকম কিছুর উল্লেখ নেই। বাড়ি ফিরে আলমারির ভাঙা কাচের গ্লানি ঢেকে দেন শেখ মুজিবের ছবি দিয়ে। সুতরাং একদিন বাড়ি জলপাই বাহিনী। তারা অবশ্য রাত বাহিনী বা রক্ষী বাহিনীর মতো অসৌজন্য ব্যবহার করে না। বিছানা-বালিশ নাড়াচাড়া করে আবার সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছিল। এমন কি গরুর পানি খাওয়ানোর নান্দার নিচটাও এত সুন্দর করে খোঁজাখুঁজি করে যে তথাগত মুগ্ধ হয়ে যায়। ‘শেখ মুজিবের ছবির সামনে এসে এক জলপাই বাহিনীর অফিসার একটু থামে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সকৌতুকে বাবাকে প্রশ্ন করে, আপনি তো জাসদ করেন। এর ছবি রেখেছেন কেন?
বাবা বলে, এখন আমরা যাই করি না কেন যুদ্ধের সময় তিনি আমাদের সবার নেতা ছিলেন। এমন কি যারা তাঁকে হত্যা করেছে, যিনি এখন সামরিক বাহিনীর প্রধান হয়েছেন তারা সবাই তো তাঁর অধীনেই যুদ্ধ করেছি।’
নিশ্চয়ই এরকম মুক্তিযোদ্ধা, বামপন্থি এবং মুজিবপ্রেমী অনেকেই ছিলেন; কিন্তু, তাকে হঠাৎ জলপাই বাহিনী ধরে নিয়ে যাবে কেন! শুধু জাসদ করার কারণে! জাসদ তো তিনি করতে গিয়েছিলেন রক্ষী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য। এখন জলপাই বাহিনী এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। মনে হচ্ছে না জলপাই বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার জন্যই তিনি ঘরে মুজিবের ছবি লাগিয়েছেন, কিংবা, লেখক এই চরিত্রটাকে নিয়ে সাপলুডু খেলছেন। তাকে একটা করুণ পরিণতি দিতে হবে এই জন্য ইতিহাসের প্রতিটা মোচড়ে তাকে ভোক্তভুগী করে তুলছেন। জলপাই বাহিনী পরদিন সকালে তার লাশ ফেরত দিয়ে যায়। ‘বাবা ফিরে আসেন পরদিনই সকালবেলায়। জলপাই বাহিনীর লোকেরাই নিয়ে আসে। তবে বাবা তখন আর বেঁচে নেই। জলপাই বাহিনীর লোকেরা বলে, বাবা নাকি পালানোর জন্যে হঠাৎ করে আর্মি ভ্যান থেকে লাফ দিয়েছিল।...’
এর মধ্যে, উপন্যাসের ৭৯ পৃষ্ঠায় প্রথম আগমন ঘটে তথাগতর বড় চাচার। এর আগে তার তো দূরের কথা, তথাগতর কোনো আত্মীয়-স্বজনেরই উল্লেখ নেই। ২৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, ‘আত্মীয়-স্বজন তো খুব একটা নেই আমার বাবার, আর থাকলেও আসে না কোনওদিন। চাচা কিংবা মামা জাতীয় লোকজন কেমন কিংবা জীবনে তাদের ভূমিকাটাই বা কি তাও জানা হয়নি আমার।’ বড় চাচা এসেছেন তথাগতকে বুঝাতে যে, ‘পরের ঘরের এই দুটো মেয়ে পুষে আমি কেন আর চালডাল নষ্ট করি। বাবার তো দ্বিতীয় পক্ষের কোনও ছেলেপুলে নেই যে সম্পত্তিতে হক জন্মাবে ওদের। মনীষা ও তো আমার বোন না আমার।’
তথাগত কিছু না বলেই ঠাণ্ডাভাবে চাচাকে বিদায় করে। চাচা সড়কে গিয়ে উঠলে তথাগত ঘরে ঢুকে। দেখে মনীষা বাবার খাটের একটা প্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ ভারি হয়ে উঠেছে ওর। আর সারা শরীরে যেন অবসন্নতা নেমে এসেছে। তথাগত বুঝতে পেরেছে মনীষা সব শুনে ফেলেছে। নিজের অজান্তেই দুজন দুজনের দিকে এগিয়ে যায়। ‘তুমি আমাদের তাড়িয়ে দেবে? ওর কণ্ঠ করুণ হয়ে আসে। আমরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরি।’
এখানে বড় একটা অনুচ্ছেদে কিছু কাব্যিক বর্ণনা দেয়ার পর লেখক লিখেছেন, ‘হঠাৎ আমি অনুভব করি ঝিরঝিরি বৃষ্টি নেমে এল, কোথায় যেন একটা পাখি উড়ে গেল, বাঁধ ভেঙে গেল একটা নদীর। মনীষার চুলের মধ্যে আমার হাতের আঙুলগুলো কেঁপে কেঁপে উঠল, ঠোঁট আপনা-আপনি নড়তে লাগল, তোদের আমি কোথাও যেতে দেব না।
আমাদের দুজনের শরীরই এবার হঠাৎ একবার শক্ত হয়ে উঠল, তারপরই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো, আমরা অবসন্নতা আর উদ্দীপনা দুটোকেই একসঙ্গে ধারণ করে বাবামা’র খাটটার একধারে পাশাপাশি বসে রইলাম।’
আমি ভেছিলাম এতটুকুই বোধহয়। হঠাৎ একটু বাড়তি আবেগ। কিন্তু তারপর উপন্যাসের শেষ দিকে লেখক মনীষার সঙ্গে তথাগতকে একেবারে বিছানায় শুইয়ে ছাড়লেন। হতে পারে তারা সৎভাইবোন, কিন্তু ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে, একই বিছানায় ঘুমিয়েছে, তাদের কেন বিছানায় শোওয়াতে হলো এটা কোনোভাবেই আমার মাথায় ঢুকল না।
এই হচ্ছে বাস্তববাদী লেখকদের একটা সমস্যা, অন্ধকারের কথা বলতে গিয়ে এতো অন্ধকারের ছবি আঁকেন যে আলোর রেশটুকুও আর কোথাও বাকি থাকে না। একজনের জীবনেই কেন এতো নাটকীয় দুর্ভোগ নেমে আসে তাও আমি জানি না। কলেজে পড়তে গিয়ে যে- ছেলেটি তথাগতর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয় সেই মামুনকে মেরে ফেলে আর্মিরা। ঢাকা ভার্সিটি পড়তে গিয়ে তার পরিচয় হয় মারিয়ার সঙ্গে। সেই মারিয়াও রেপ হতে গিয়েছিল সাঁতার-প্রশিক্ষকের কাছে। আইয়ুব নামের এক ছেলের সঙ্গে তথাগতর বন্ধুত্ব হয়েছিল। ততদিনে রগকাটা বাহিনী মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেছে। সেই রগকাটা বাহিনীর শিকার হয় আইয়ুব। এর মধ্যে অনেক দিন পর একদিন তথাগত বাড়ি ফিরে শুনে মা নেই বাড়িতে। কোথায় গেছে সেটাও মনীষা বলে না। বলে মা আসলে তাকেই জিজ্ঞেস করতে। তখনই তথাগতর সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয় মনীষার। তথাগতর সাথে এতো নিবিড় সম্পর্কের পরও মার সম্পর্কে কিছু গোপন কথা বলতে কেন মনীষা অপারগতা প্রকাশ করে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। বরং তথাগতর সাথে মনীষার যেরকম বন্ধুর মতো সম্পর্ক, এবং তারা যে-সব বইটই পড়েছে, এবং ছোটবেলা থেকেই বাবা তাদের যেভাবে বড় করেছে, যে কোনো সমস্যায় বরং তাদের আরো শলাপরামর্শ করা উচিত। তাদের চরিত্রের যা গঠন তাতে তাই বলে। তাতে পুরো পরিবারটা বেঁচে যেত। কিন্তু, এদের বাঁচানো তো লেখকের উদ্দেশ্য নয়। লেখকের উদ্দেশ্য এদের একটা করুণ পরিণতি দেয়া। এখানেই উপন্যাসটা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে পড়ে।
বাড়ি ফিরলে মাকে খুব খুশি খুশি দেখায়। এই বিরান প্রান্তরে সোমত্ত মেয়েকে একা ঘরে রেখে দুদিনের জন্য তিনি কী করে বেড়াতে চলে গেলেন এটা শুধু তথাগতর প্রশ্ন না, আমাদেরও প্রশ্ন। এতো অবিবেচক তাকে আগে কখনো মনে হয়নি। প্রথমে সন্দেহ হয় তিনি বোধহয় বড়চাচার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতেই গেছেন। পরে জানা যায় আসলে তিনি বড়চাচার ছেলের সঙ্গে মনীষার বিয়ে ঠিক করেছেন। এটা অবশ্য আরো অনেক পরে জানা যায়। তথাগত ঢাকা এসে অনেক দিন পর আবার গ্রামে ফিরে যাবার সময় পথেই হালিম নানার কাছে শুনে মনীষা আর বেঁচে নেই। সে আত্মহত্যা করেছে। পরদিন রাতেই মা খুন হয়ে গেছেন।
পুরাই নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর! নাটকীয় ঘটনার এখানেই শেষ না। নায়ককে তো মরতে হবে, তাই না! নায়ককে কী করে মারা যায়? নায়ক তার পিতার একটা রিভলবার ছোটবেলা থেকেই সাথে বহন করে। সেটা তার অঙ্গের মতো হয়ে গেছে। একরাতে পুলিশ কিছু টিপস নেয়ার জন্যই তাকে ধরে। ছিনতাইকারী হিসেবে তাকে একটা কেইস দিয়ে দিতে চায়, যেন সেই ভয়ে সে কিছু টাকা দিতে পারে। কিন্তু, তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। সাথে একটা ঘড়ি ছিল, ঘড়িটা মারিয়া দিয়েছিল, পুলিশ এখন সেই ঘড়ির রশিদ দেখতে চায়। ঘড়ির কি রশিদ থাকে, নাকি সেটা কেউ সাথে নিয়ে ঘুরে! পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়, এবং থানায় নিয়ে যাবার পর পিস্তলটা উদ্ধার হয়। পুরাই আজগুবি ব্যাপার! পিস্তলটা রাস্তায় পেলেই হতো। পুলিশ যখন তাকে চেক করছে তখনই তো পিস্তলটা পাওয়ার কথা। আর ভোগান্তি সৃষ্টি করার জন্য সাজানো এসব কেসে পুলিশ সাধারণত থানা পর্যন্ত কাউকে নিয়ে যায় না। রাস্তাতেই যা পায় টুপাইস নিয়ে ছেড়ে দেয়। তথাগতকে থানা পর্যন্ত কেন নিয়ে যাওয়া হলো এটা কোনো যুক্তিতেই মেলে না। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ইন্টারোগেশনে প্রচণ্ড অত্যাচার চলে তথাগতর ওপর। গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে তথাগতর বাবা বিয়ে করেছিলেন তার চাচার বিধবা স্ত্রীকে, তারই সন্তান তথাগত। ধর্মমতে এ বিয়ে জায়েজ, কিন্তু তবু তথাগতর বাবাকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল এই বিয়ের পরে। বাবা তার সংসার পেতেছিল তার দাদার দেয়া সামান্য মেঠো জমির ওপর ছনের একটা ছাপড়া তুলে। ‘ইন্টারোগেশন অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার সৎবোনের নাম মনীষা হওয়ার কারণ আমি জানি কিনা। আমি মাথা নাড়ি। অফিসারটি আবারও তথ্য যোগায় আমার সৎমা ছিল হিন্দু মেয়ে, কলকাতায় তার আসল বাড়ি, পার্টি করত চারু মজুমদারের, নকশাল স্বামী মারা যাওয়ার পরে নিরাপত্তা ও অন্যান্য সবকিছু চিন্তা করে সে চলে আসে এই দেশে। পরিচয় হওয়ার পর বিয়ে হয় বাবার সঙ্গে। বিয়ের সবকিছু ঠিক করে আরেক নকশাল হালিম মিয়া।’
যাই হোক, এক আশ্চর্য সুন্দর নির্মল স্বপ্ন দেখতে দেখতে মৃত্যু ঘটে তথাগতর।
একটা জাতির ইতিহাসে যা সত্য, তা কি একটা মাত্র ব্যক্তির জীবনেই ঘটতে পারে! ব্যক্তি হয়তো এখানে রাষ্ট্রের প্রতীক। হয়তো তথাগতর নামই বাংলাদেশ। ইতিহাস বা সংবাদ-পরিবেশন হিসেবে এসব তথ্য এক মলাটে পাওয়া স্বার্থক মনে হলেও উপন্যাস হিসেবে আমার কাছে প্রচণ্ড ক্লান্তিকর, একঘেয়েমিপূর্ণ মনে হয়েছে। লেখক যেন কয়েকটা বাহিনীর নাম খাতায় লিখে বসেছেন, একটা পর একটা বাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা দিবেন, সে-জন্য কাহিনীকে যেমন খুশি টেনে নিয়ে গেছেন। উপন্যাসটা অনেক আগে প্রকাশিত হলেও এবার পেণ্ডুলাম থেকে নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রথম প্রকাশের দিন-তারিখ পেন্ডুলাম পাবলিশার্স কেন জানালো না এটা নিশ্চয়ই তাদের গোপন ব্যবসায়িক পলিসি। ১৫৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির দাম ২৫০ টাকা। বইটি পড়েই ভেবেছিলাম বড় একটা রিভিউ লিখব। শুরুতে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছিল মাথায়। পরে সব ভুলে গেছি। লেখাটা বড় হয়ে যাবে ভেবে আর লিখিনি। আজ হঠাৎ বইয়ের তাকে বইটা দেখে ভাবলাম লিখেই ফেলি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার