অক্ষর প্রকাশনীতে লেখক, কবি নিতাই সেন, কবি এ কে শেরাম, প্রকাশক শুভব্রত দেব, কবি পুলিন রায়, কবি এল বীরমঙ্গল সিংহ

অক্ষর প্রকাশনীতে লেখক, কবি নিতাই সেন, কবি এ কে শেরাম, প্রকাশক শুভব্রত দেব, কবি পুলিন রায়, কবি এল বীরমঙ্গল সিংহ

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ১৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯

শুভব্রত দেবের সঙ্গে যে কেবল সে-যাত্রায় আমবাসা বইমেলায় দেখা হয়েছিল তা নয়, আমবাসা থেকে আমরা যখন আগরতলা ফিরলাম, অক্ষরে এসেও দুদিন আড্ডা দিয়েছি। হ্যাঁ, যেদিন আমবাসা বইমেলার সমাপ্তি অনুষ্ঠান হলো, তার পরদিনই সকালবেলা নাস্তা সেরে আমরা রওনা দিয়েছিলাম রাজধানী আগরতলার উদ্দেশে। একটি প্রাইভেট কারে ছিলাম আমি আর কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার, আরেকটিতে ছিল গানের শিল্পীর দল— শান্তা সরকার, আরিফ রহমানরা। আমবাসার উঁচুনিচু পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পথ থেকে পথে নামতে নামতে, জিপটার যেমন নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, আমিও হঠাৎ শিকার হয়েছিলাম অসুস্থতার। হ্যাঁ, সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমার জীবনের; সকালবেলার তেলেভাজা দু-দুটো পরোটার ধকল সইতে পারেনি বোধহয় আমার পাকস্থলি। বদহজম থেকে তৈরি হচ্ছিল গ্যাসের। অসহ্য পেট-ব্যথায় আমি কেবল কাতরাচ্ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম আগরতলায় জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারবো কিনা। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম বটে কথাশিল্পী মঞ্জু সরকারকে। তিনি শুধু বলছিলেন, অপু শুয়ে থাকো সিটে আরাম করে।

আরাম কি আর হয়? এত ঝাঁকুনি! একবার সিটে শুই তো পেট চেপে, আরেকবার উঠে বসি, আর বাইরে তাকিয়ে খুঁজি ওষুধের দোকান। জিপটা ক্রমেই নেমে এসেছিল সমতল অঞ্চলে। আর পথের পাশে আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছিল শহুরে ছাঁচের ঘরবাড়ি, দোকানপাট। দেড় দু-ঘণ্টা পরই হবে একটা ওষুধের দোকান দেখে ড্রাইভারকে অনুরোধ জানালাম জিপটা রুখতে। যেন গুলি খাওয়া আহত মানুষ, পেট চেপে ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হয়েছিলাম ওষুধের দোকানে। দাদা, গ্যাসের ওষুধ দেন। তিনি আমার ব্যথার নমুনা শুনে ট্যাবলেট দিয়ে দিলেন। এখনই খেয়ে নিন। সেরে যাবে। তখন তখনই ট্যাবলেট মুখে দিই। পানি পান করে আবার ওঠে বসি জিপে। চলতে শুরু করে জিপ। হাওয়া এসে পরশ বুলোয় শরীরে। বাইরের দুপাশের ঘরবাড়ি-দোকানপাটের ভেতরেও সবুজের নির্জলা ছায়া চোখে পড়ছে। হ্যাঁ, আমি বেশ সুস্থ বোধ করতে থাকি।

সেবার আমবাসা থেকে ফিরে আমরা আগরতলায় উঠেছিলাম ভগত সিং যুবা আবাসনে। এটা নিউ আগরতলায়। আমবাসা বইমেলার আয়োজকরাই এখানে করে রেখেছিলেন থাকার ব্যবস্থা। বেশ বিস্তৃত ও খোলা পরিসরের এই আবাসনে মূলত ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা বিষয়ে ট্রেনিং নিতে আসা তরুণ-তরুণীরাই থাকেন। বিশেষ ব্যবস্থাধীনে বিশেষ অতিথিরাও থাকার সুযোগ পান। তিনতলা সুবিশাল এই ভবনটিকে আমার অনেকটাই আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের মতোই লাগছিল। তারই আধুনিক আর দুর্বল সংস্করণ! সলিমুল্লাহ হলের মধ্যে একটা রাজরানীর ভাব আছে বেশ হৃষ্টপুষ্ট, আর ভগত সিং যুবা আবাসন যেন সেই তন্বী সুন্দরী, যে স্লিম হতে গিয়ে খানিকটা হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। আগরতলায় আমার আর মঞ্জু সরকারের আগমন সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশ হৃদয়েষু কবি আকবর আহমেদ। যিনি বাংলাদেশ থেকে কারো আগরতলায় আসার খবর শুনলেই, বিশেষ করে শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের কারো, অন্তকরণের সমস্ত সৌহার্দ্য নিয়ে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পাশে দাঁড়াবে।

জলে ভাসে বনজ মুকুট, ঋতুবদলের প্রার্থনা সঙ্গীত, নিজেকে লুকিয়ে রাখা খোলসসহ বেশ কয়েকটি কবিতার বইয়ের জনক আকবর আহমেদের সুনাম সুখ্যাতি অবশ্য আমরা ঢাকা থেকেই শুনে গিয়েছিলাম। আমার আর মঞ্জু সরকারের পরম সৌভাগ্য যে, এই কবি নিজের চাকরি, পার্টির কাজকর্ম আর পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনের পাশাপাশি প্রতিদিনই আমাদের দুজনের সময়কে রাঙিয়ে দেয়ার জন্য একবার হলেও দেখা করতেন। শুধু কি দেখা করা, আকবরের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, ও আমাদের আরো অনেক সমৃদ্ধ স্মৃতিই উপহার দিয়েছে, সেসব বলা যাবে যথাযথ জায়গায়, এখন শুধু বলি সেই আকবর আহমদই দেখা হওয়ার প্রথম দিনের সন্ধ্যাতেই আমাদের দুজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন অক্ষরে। আরো বেশ কজন কবি, চিত্রশিল্পীকে ডেকেছিলেন সেখানে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। যাদের মধ্যে ছিলেন ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্য, কথাশিল্পী শ্যামাপদ চক্রবর্তী, অলোক দাশ গুপ্তসহ আরো বেশ কজন। অনেকের নাম ভুলে গিয়েছি। শ্যামল বৈদ্য অবশ্য আকবর আহমেদের সঙ্গে পরেও একবার আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভগত সিং যুব আবাসনে যান। তিনি আমাকে উপহার দেন তার উজান ভাটি উপন্যাস।

উজান ভাটি উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সালের ত্রিপুরা। ত্রিপুরায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরের যাপিত জীবন। সম্ভবত ১৯৭১ সালের ত্রিপুরা রাজ্যের বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরের জীবন নিয়ে এটাই প্রথম উপন্যাস এবং একমাত্র। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরা রাজ্যের তিনদিকেই বাংলাদেশের সীমান্ত হওয়ায় একাত্তর সালে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে গিয়েছিল সেখানে। সারা ত্রিপুরা রাজ্য জুড়ে ছিল শরণার্থী শিবির। সুদীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষকে কাটাতে হয়েছে সেখানে কখনো চরম আশাহত, কখনো বা নতুন দেশের স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে।

অক্ষর প্রকাশনীর শুভব্রত দেব দেখছি সে-আড্ডার কথা সামান্যও ভুলেননি। তিনি আমাকে দেখেই সহাস্যে বরণ করে নিলেন। আমরা যখন পাশের মোবাইল দোকানকেন্দ্রিক পথজমানো আড্ডায় জমাটি ছিলাম, তখনই কোনো এক ফাঁকে তিনি অক্ষরে ফিরে নিজ গদিতে আসন নিয়েছিলেন। আমাদের দেখেই মেতে ওঠলেন আপ্যায়নে। সিঙারা আনালেন, চা আনালেন। আড্ডাও জমে ওঠতে সময় লাগলো না। এল বীরমঙ্গল সিংহ, গৌতমলাল চাকমাকে তো ভালোভাবেই জানেনই, কবি এ কে শেরামের সঙ্গেও দেখলাম তার আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা। নতুন করের শুধু শুভব্রত দেবের সঙ্গে পরিচয় হলো কবি নিতাই সেন আর পুলিন রায়ের।

হাস্যরসের মধ্যেও দু-একটা অপ্রিয় বিষয় উঠে এলো আলোচনায়। শুভব্রত দেব ভারতীয় বই বাংলাদেশে পাইরেসি হয় বলে সমালোচনা করলেন, আগরতলার বই বাংলাদেশে যায় না বলেও অনুযোগ করলেন। কিন্তু তার বিশাল বইয়ের দোকানের ভেতর থরে থরে সাজানো দেশ-বিদেশের বইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের দু-একটা বই বাদে তেমন কোনো বইই চোখে পড়লো না। তার মানে শুধু ভারতীয় বই যাবে বাংলাদেশের বাজারে, বাংলাদেশের কোনো বই ভারতে থাকবে না! খুব বলতে ইচ্ছে করছিল কথাটা, কিন্তু বলা হলো না। সব সত্য কথা কি ধুম করে বলা যায়? শুধু বললাম, আগরতলার বই ঢাকায় যায় না বটে, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কবিসাহিত্যিকের বইও কি ঢাকার কোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়, মেলে? ওখানে তো সব ভারতীয় বই, নতুন-পুরনো সব লেখকের। বাংলাদেশের কবিসাহিত্যিক সেখানে ব্রাত্য, চরম অবহেলিত।

চমৎকার আড্ডা শেষে ভালো একটা ফটোসেশনও হয়ে গেল। ফটোসেশন তো এখনকার সময়ের এক অনিবার্য বিষয়, যেমন অপরিহার্য ফেসবুকিং। ফটোসেশনের সময়ই আগরতলার বিশিষ্ট সাংবাদিক তাপস দেবনাথের আমার শহর আগরতলা বইটি চোখে পড়ল। তার ত্রিপুরা ভ্রমণ বইটি আগেই কিনেছিলাম। আজ এটাও নিয়ে নিলাম। আকবর আহমদ আগরতলার সে-যাত্রায় তাপস দেবনাথকেও নিয়ে এসেছিলেন ভগত সিং যুবা আবাসনে। বেশ বাহারি সাইজের গুম্ফধারী মানুষটি যেমন খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে জানেন, আমারো তাকে আপন করে নিতে সময় লাগেনি। আকবর আহমেদের সঙ্গে তাপস দেবনাথও আমাদের সেবারকার আগরতলা ভ্রমণকে বর্ণাঢ্যতা দিয়েছিলেন। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক