আমবাসায় লেখক, ২০১৬ সালে
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১৩
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০১৯
গতবার বর্ডার ক্রস করার পর সুযোগ হয়নি শহর আগরতলার কোনো জানালামুখ থেকে এ-শহরের ছিরিছাদ দেখার। সেদিন আদি শংকর হোটেলে পাবদা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার পরই দু-দুটো জিপ আমাদেরকে চিলের মতো ছোঁ মেরে শহর থেকে ক্রমশই নিয়ে ছুটছিল অন্তহীন সবুজপ্রপাতের নিসর্গ-পথে। নৈঃশব্দ্যের সেই সবুজ-প্লাবনে ভাসতে ভাসতে আমাদের পথ আস্তে-ধীরে সমতল ভূমি ছাড়িয়ে কখন যে পৌঁছে গিয়েছিল ধলাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে— তারপর শুধুই বিমুগ্ধ হওয়ার পালা। বৃষ্টিভেজা সেই পাহাড়ি পথের কোথাও কোথাও জঙ্গল হয়ে আছে। যতই আমবাসার দিকে ছুটছিল জিপ, পাহাড় আর জঙ্গল নিবিড় হচ্ছিল। আমাদের জিপটা হঠাৎ পথের বাঁক ঘুরে ঘুরে উঠে যেতে লাগলো ক্রমশ উঁচু থেকে আরো উচ্চতায়। একেবারে চূড়াভূমিতে। সেখানেই আমবাসা সার্কিট হাউজ।
সার্কিট হাউজের চারপাশটা খোলা। ঘুরে ঘুরে দেখা যায় চারপাশের আমবাসা। সবুজ গাছপালার ভেতর ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ির টিনের চাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এলোমেলোভাবে। পড়ন্ত সেই বিকেল ঈষৎ কালো মেঘে গম্ভীর হয়েছিল। আমাদেরকে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন আমবাসা-আগরতলার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং সংস্কৃতিজীবী পংকজ চক্রবর্তী। তিনি আমাদেরকে যার-যার রুমে পৌঁছে দিয়েছিলেন। প্রতিটি রুমেই ছিলাম দুজন। আমি আর মঞ্জু সরকার এক রুমে। আমাদের সঙ্গে আসা গায়েন মেয়েরা, শান্তা সরকার, রীনা ফেরদৌসি, শুচিস্মিতা দেবনাথ শুচি যার যার রুমে ঢুকেই শুরু করলো সাজুগুজু। সন্ধ্যার পরই যে যেতে হবে আমবাসা বইমেলার উৎসবে। ওরা গাইবে গান। আর আমাকে এবং মঞ্জু সরকারকে তার আগের মূল অধিবেশনে বসতে হবে মঞ্চে, দিতে হবে বক্তৃতা।
এই বক্তৃতা দেয়ার কথা মনে পড়তেই আমার শরীরে যেন গা-কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে চাইলো। আমি সার্কিট হাউজের আধো-অন্ধকার বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবি, কেন যে মফিদুল হক ভাইয়ের কথায় এখানে আসতে রাজি হয়েছিলাম! আসলে উনি যখন আমবাসা বইমেলায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন, আমার শুধু বেড়ানোর কথাই মাথায় এসেছিল, নিরমহলের কথা মনে এসেছিল! রবীন্দ্রনাথ-রক্তকরবী আর ত্রিপুরা রাজবাড়ির কথা মনে এসেছিল— লোকজনের সামনে যে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হবে, সে-কথাটা একদমই খেয়ালে আসেনি। এখন? এখন কি হবে?
পায়ে পড়ি বাঘমামা...
করো না কো রাগ মামা...
তুমি যে এ-ঘরে কে তা জানতো...
তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো...
তুমি এ ঘরে... এ ঘরে... এ ঘরে তুমি যে... তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো...তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো
এ যে বিনা মেঘে পড়ে বাজ...এ যে বিনা মেঘে পড়ে বাজ...বিনা মেঘে পড়ে বাজ... বিনা মেঘে পড়ে বাজ
কেঁচে বুঝি গেল কাজ...গেল কাজ কেঁচে...কেঁচে গেল কাজ...কেঁচে কেঁচে...এ-যে বিনা মেঘে পড়ে বাজ কেঁচে বুঝি গেল কাজ
দয়া করে থাকো হয়ে শান্ত— মামা, কে বা জানতো... তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো... তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো
যদি ঘাড়ে এসে...বাবা... যদি ঘাড়ে এসে পড়ে পড়ে...
যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা... ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা বাবা থাবা বাবা... বাবা রে বাবা রে... যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা
কী হবে তা জানি বাবা
হারা যাবে তাজা দুটি প্রাণ তো... হায় হায়... দুটি তাজা প্রাণ... আহা দুটি তাজা প্রাণ যাবে হারা... আহারে হারা
জানি হারা যাবে তাজা দুটি প্রাণ তো...
তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো... তুমি যে এ ঘরে কে তা জান তো
বাঘাদা বাঘাদা বলি হিরা নিলে কত শুনি... বাঘাদা হিরা নিলে কত শুনি?
সময় কি আছে যে গুণি?
তবুওওও... কত শুনি?...
নিয়েছি যথেষ্ট...
তবে আর নিয়ে কাম নাই আর নিয়ে কাম নাই
এবারে চলো পালাই এবারে চলো পালাই
বড় কষ্টে পাওয়া গেছে কেষ্ট... বড় কষ্টে পাওয়া গেছে কেষ্ট... যথেষ্ট যথেষ্ট
তাই তো! পালাই! এবারে চলো পালাই! এরচেয়ে ভালো বুদ্ধি আর কি হতে পারে! চুপচাপ এখান থেকে সটকে পড়লেই হলো! অনুষ্ঠান শেষ হবে হয়তো রাত দশটায় বা এগারেটায়! তখনই বিধ্বস্ত একটা অবস্থা নিয়ে ফিরে আসলেই হলো!
সত্যি পালাবো? ধ্যাত! কী যে সব আজগুবি চিন্তা আসে মাথায়। তুমি যে এ ঘরে তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো? কে তা জানতো? যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা বাবা বাবা গো! না না গিয়ে কাজ নাই, পালাই চলো পালাই, আমি সত্যি সত্যি যেন নিজের অজান্তেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসি। মঞ্জু সরকার শুয়ে চোখ মুদে কী ভাবছিলেন। আমার বেরিয়ে পড়াটা খেয়াল করলেন না।
এই পালানোর অভিজ্ঞতাটা আমার নিছক কম নয়। আশা করি সার্থকভাবেই পলায়নবৃত্তিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করা যাবে এবং আন্তর্জাতিকতার স্বাদ পাবে! দূর-শৈশব থেকেই তো আমি ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছি। মসজিদে আরবি শেখা থেকে শুরু করে স্কুলের অ্যাসেম্বলি ক্লাস! অংক থেকে ইংরেজি ক্লাস! জ্বর এলেই ডাক্তার আসার খবর পেয়ে ইনজেকশনের ভয়ে ঝাড়া দৌড়— পালানো কোথায় থেকেছে বাদ? বাবা বাবা রে, থাবা... অ্যাসেমব্লি ক্লাসে পালানোর প্রয়োজন পড়তো কেন! কোনো কোনো দিন যে ডাক আসতো সবার সামনে দাঁড়ানোর... লিড দিতে হবে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনায়... আমি গাইবো আর আমার সুরে সুরে বাকি সবাই তাল মেলাবে। প্রায় তিন-চারশো ছেলেমেয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো! সবার সামনে একা আমি! পেছনে শিক্ষকগণ! বাবা বাবা রে বাবা, যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা... তুমি যে এ ঘরে তুমি যে এ ঘরে কে তা জানতো! তারপর স্কুল-কলেজের আরো কত অনুষ্ঠান, ভার্সিটিতে বাংলা বিভাগের বর্ষবরণ... অপু গান! অপু কবিতা আবৃত্তি! অপু বক্তৃতা! অপু কই? অপু নাই! আলাল যদি ডাইনে যায় দুলাল যায় বাঁয়ে। তাদের বাবা সারাদিন খুঁজে খুঁজে মরে। আলাল কই? দুলাই কই? নাই রে নাই রে নাই। আলালও দুলাল হে আলালও দুলাল! এই সেদিনও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের গল্পপাঠের নিমন্ত্রণ এসেছিল। তখন ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাব ছিল না বটে, কিন্তু সাধারণ জ্বর আবির্ভূত হতে তো আর সময় লাগে না। সে জ্বরের কথা বলেই পার পেয়েছি। এমনকি ঢাকার সাহিত্য সমাবেশগুলোতেও গয়রাহাভাবে অনুপস্থিত থাকি। পাছে আবার মঞ্চ থেকে ডাক আসে কিছু বলার জন্য। দু-একবার এমন হয়েছে বলেই ভয়টা মাথায় ভেতর সেধিয়ে গেছে। সেই এতো সতর্ক আমি কিনা আমবাসায় এসে ‘শ’শ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেব? কাঁকাঁকাঁপুনির... দেদেদেখেছো কি!
সার্কিট হাউজের চুড়াভূমি থেকে নিচে নেমে যাওয়ার ঢালু পথে আমি বীরদর্পে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাব? যেদিকে মন চায় সেদিকেই যাবো। একসময় নেমে আসবে অন্ধকার। অন্ধকারের চাদরে আরামসে গা মুড়ি দিয়ে থাকবো। কেউ আমাকে দেখতে পাবে না, কেউ না। আমি সেই অন্ধকারেই হাঁটতে থাকবো। কোথাও এক মুহূর্তের জন্যও বসবো না, বিশ্রাম নেব না। তারপর ঘড়ি দেখে দশটার পর ইউটার্ন নিয়ে ফিরে এসে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলে দিলেই হলো! ল্যাঠা চুকে যাবে... গল্প লেখাটাই বড় কথা নয়, গল্প বলার মধ্যেও একটা আর্টের কঠিন সমন্বয় ঘটাতে হয়! সেটারই আজ পরীক্ষা হবে।
কিন্তু পালাবো কোথায়? পালানোটা কি এতই সহজ! চারদিক থেকে যে কত রকমের শেকড় বাঁধা থাকে! হাতে-পায়ে, মনেও! ছড়ানো থাকে কতো রকমের অন্তর্জাল! ঢালু পথটা বাঁক নিয়ে যেখানে শেষ হয়েছে পাকা সড়কের মাথায়, তার কাছেই একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খাচ্ছিল আমাদের দলের আরিফ রহমান। সঙ্গে ওর বয়সী আরেক যুবক। আরিফ রহমান পরিচয় করিয়ে দিল, বিবেকানন্দ দাস। হ্যাঁ, বিবেকের কথা আমি বাংলাদেশ থেকেই শুনেই এসেছিলাম। ও এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছে ভারত। কলকাতা-দার্জিলিং ঘুরেটুরে আজ আমাদের সাথী হলো। ওদের দুজনের সঙ্গে চা-বিড়ি সমেত গল্পে গল্পে বেশুমার হয়ে কখন যে কীভাবে আবার ফিরে এসেছিলাম সার্কিট হাউজের সেই চূড়াভূমিতে আজ আর মনে নেই। তবে বেশ মনে আছে তারপরই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মঞ্জু সরকার এবং পংকজ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমাদের তিনজনের আড্ডা ভারি জমাট বেঁধেছিল। পংকজ চক্রবর্তীর বয়স ষাট বা তার বেশিও হতে পারে। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মানুষ। বাংলাদেশের গান নিয়ে তার মধ্যে আলাদা একটা উত্তেজনা আছে দেখেছিলাম। বললেন যে, কী বিপুল আপনাদের গানের সম্পদ। নিজস্ব সুরের কত যে বিশাল ভাণ্ডার।
আরিফ রহমান ও বিবেকানন্দ দাস তো গানেরই মানুষ মায় রুঢ়-বাস্তব জীবনের কথাকার মঞ্জু সরকার এবং সিরিয়াস টাইপের গল্পলেখক আমি পর্যন্ত গান নিয়ে আড্ডায় মুখর হয়ে উঠলাম। পংকজ চক্রবর্তী বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, বাংলাদেশের গানের যে নিজস্ব সম্পদ রয়েছে, যে-কোনো মূল্যে তার অরিজিন্যালিটি ধরে রাখা দরকার। এসব গানকে যেন পপ কালচারে মিশিয়ে ডালেচালে খিচুড়ি করা না হয়। হ্যাঁ, আমরাও কথাটা বিশ্বাস করি, পপ গান বা ব্যান্ডের গান তার নিজস্বতা নিয়ে এগোবে, কিন্তু জারি-সারি-ভাটিয়ালি বাউল সঙ্গীতের যে ধারা আছে, সেটাকে অবিকৃত রেখে। ভালো ভালো শিল্পীরা সেসব গান গাইলে তার জনপ্রিয়তাও অব্যাহত থাকবে। আবদুল আলিম, আব্বাসউদ্দিনের মতো শিল্পী আর কেন এলো না পল্লীগীতিতে? লালন সঙ্গীতেও সেরকম ফরিদা পারভীন বা কাঙালিনী সুফিয়ার মতো দরদিয়া শিল্পীর বড়ই অভাব! আমরা উপলব্ধি করি, নজরুলগীতির ক্ষেত্রেও এই অবহেলাটুকু রয়েছে চরম। সোহরাব হোসেন, খালেদ হোসাইন আর ফিরোজা বেগমের পর সেভাবে উচ্চারণ করা যাবে আর কোন শিল্পীর নাম? আমার তো চট করে কারো নাম মনে আসছে না। আপনি জানেন কি? প্রিয় পাঠক! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক