বিপ্লবী চে আর্নেস্তো গুয়েভারা ও পাবলো নেরুদা

বিপ্লবী চে আর্নেস্তো গুয়েভারা ও পাবলো নেরুদা

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ১২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০১৯

আমি তো ভেবেছিলাম, অনেকক্ষণ আমাকে না-দেখে শেরামদা রাগ করবেন। অহেতুক টেনশনে ফেলার জন্য একটু হলেও বিরক্ত হবেন। নাহ! রাগ তো করলেনই না, সামান্য ভ্রুও কুঁচকালেন না। উলটো হাসলেন, স্মিত অপার হাসি। এই হাসি কবির। এই হাসি সাচ্চা কবি-হৃদয়ের। একজন কবি খামোখাই উত্তেজিত হন না। খামোখা উত্তেজিত হয়ে কারো হৃদয় কাঁচের টুকরোর মতো ঝনঝন ভাঙতে পারেন না। কবি শুধু জানেন স্বপ্ন দেখাতে। আশাজাগানিয়া গান শোনাতে। শেরামদাও স্বপ্ন দেখান। শেরামদা তার গদ্যে সেই স্বপ্নের কথা বলেন, বলেন কবিতার কথা, ‘স্বপ্ন দেখেছিলেন পল রোবসন আর বিপ্লবী চে আর্নেস্তো গুয়েভারা; যে নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে বিপ্লব, বিপ্লবী গেরিলার অদম্য এগিয়ে চলা— ভেসে ওঠে স্বপ্ন আর স্বপ্নভরা কবিতার কথা। চে স্বপ্ন দেখতেন। আর স্বপ্নের জোনাকি পোকাগুলোকে সাজিয়ে সাজিয়ে কবিতা লিখতেন। শুধু মনে ও মস্তিষ্কে নয়, পেটে ও পিঠে তিনি বয়ে বেড়াতেন অবিনশ্বর স্বপ্নের সোনালি শস্যদানা। মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে আটকাবস্থায় চে’কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— তুমি এখন কী ভাবছো? স্বপ্নের অতলান্ত গহ্বর থেকে তার স্বপ্নালু দৃষ্টিকে তুলে এনে নির্বিকারভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি। আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারা কিউবার বিপ্লবকে সফল করার পর মন্ত্রিত্বের লোভনীয় পদ নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবের মোহন মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে স্বপ্নকে সম্বল করে আবার ছুটে গিয়েছিলেন বলিভিয়ার গহিন জঙ্গলে। গড়ে তুলেছিলেন অদম্য এক গেরিলা বাহিনি। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার ছোট্ট পাহাড়ি শহর লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে বন্দি চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। কিন্তু মৃত্যু হয়নি চে-র সেই অবিনশ্বর স্বপ্নের। কারণ, নশ্বর মৃত্যুর প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখনো এই স্বপ্নাচারী মানুষই স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছেন নিপীড়িত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে। চে কবিতা ভালোবাসতেন। তার মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল পাবলো নেরুদার একটি কবিতার বই, কান্টো জেনারেল। চে নিজেও কবিতা লিখতেন। তার স্বপ্নগুলো সোনালি মাছের মতো সাঁতরে বেড়াতো তার কবিতার শরীর জুড়ে।
 
তুমি বলেছিলে সূর্যোদয় হবে।
চলো যাই
সেই অচিহ্নিত পথে
তোমার ভালোবাসার সবুজ কুমারকে মুক্ত করতে।
এবং চলো আমরা
সকল উপেক্ষাকে তুচ্ছ করি
বিদ্রোহী প্রগাঢ় নক্ষত্র-প্লাবিত ভ্রুকুটিতে।
হয় জয়ী হবো না হয়
মৃত্যুকে যাবো পেরিয়ে।
(ফিদেলের জন্য গান/ চে’ গুয়েভারা)’

তারপর হাসিমাখা মুখে শেরামদা শুধু জানতে চাইলেন, আপনি হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন? ব্যাপারটা খুব রহস্যজনক! তার কথাটার পক্ষে সমর্থন জোগাতেই যেন তাকালেন কবি নিতাই সেনের দিকে। নিতাই সেনও গম্ভীর চালে বললেন, খুবই রহস্যজনক। হামিদ কী ব্যাপার! মুগ্ধ হলাম শেরামদার চারিত্র্যিক স্নিগ্ধ ব্যবহারে। কী শান্ত সৌম্যতা। আমার ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টার গেট কেলেংকারির কথা শুনে কবি নিতাই সেনকে নিয়ে আরেক প্রস্থ হেসে নিলেন বেশ করে। হাসির উচ্ছ্বাস থামিয়ে তাড়া দিয়ে উঠলেন, ডলার ভাঙালে ভাঙিয়ে নিন এখানে। নইলে আগরতলা বা ইম্ফলে অনেক ভোগান্তি হবে। এবং আমাকেও অচিরেই পুলিন রায়ের মতো ফটোকপি মেশিন খুঁজতে আবারো ইমিগ্রেশন সেন্টারের বাইরে যেতে হলো। কী কাকতালীয়! গেটমুখে পুনরায় দেখা হলো পুলিন রায়ের সঙ্গে, সে ফটোকপি করিয়ে ফিরছে আর আমি যাচ্ছি। পুরো রিভার্স!

আগরতলায় সন্ধ্যা-সকাল
ছোটবেলায় বৃষ্টি এলেই আমার আগরতলার কথা মনে পড়তো। চেরাপুঞ্জির কথা মনে পড়তো। চেরাপুঞ্জির কথা মনে পড়তো এটা শুনে শুনে যে, ওখানে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। শিলং আমি গিয়েছিলাম অনেকটা চেরাপুঞ্জির টানেই। হ্যাঁ, সেখানকার বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজেওছিলাম। আগরতলার কথা মনে পড়তো কেন, বৃষ্টি এলেই আমি উগারতলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। উগারতলায় আমাদের টিনের চাল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে মোটাদাগে পানি ঝরতো, মার্চপাস্টের মিছিলের মতো সমান দূরত্ব মেপে মেপে, যতোদূর পর্যন্ত ঘরের চালটা বিস্তৃত সে-অবধি। উগারতলার মাটিতে বৃষ্টি-দগ্ধ আর্ত-ক্ষতের চিহ্নও লেগে থাকতো, সেও ছান্দসিক দূরত্বে দূরত্বে। আমি টিনের চাল থেকে গড়িয়ে পড়া মোটাদাগের পানি মুঠোয় কুড়াতাম। ধরে রাখতাম অনেকক্ষণ, তারপর ছেড়ে দিতাম হঠাৎই। আবার করতাম মুঠোবন্দী, আবার ছেড়ে দেওয়া। তখনই আমার মনে পড়তো আগরতলার কথা। আমার স্বপনমামা, আজ তিনি নেই আর পৃথিবীতে, মেঘ হয়ে গেছেন কবেই, কথায় কথায় ধিষটান দিয়ে ওঠতেন, কোথায় আগরতলা আর কোথায় উগারতলা। তিনি আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। তার শৈশব পুরোটাই কেটেছে আমাদের বাড়ি। শুধু স্বপনমামাই নয়, আমার বড় জ্যাঠি মেজো জ্যাঠিকেও বলতে শুনতাম। আরো অনেকের মুখে শুনেছি।
আমাদের গ্রামে কথাটা খুবই প্রচলিত ছিল। কারো সাথে কারোর তুলনা হলে অথবা কোনোকিছুর সঙ্গে কোনোকিছুর পরিমাপ করলে তারা বলতেন, কোথায় আগরতলা আর কোথায় উগারতলা। আমার তখন মনে হতো আগরতলা যেন অনেক দূরের কোনো দেশ। এতো দূরের যে, সেখানে যেতে যেতে দিন ফুরিয়ে রাত নেমে আসে, পৌঁছাতে হয় অনেক গভীর রাতে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভীষণ টায়ার্ড হতে হয়। বিছানায় ক্লান্তিতে ঢলে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। অথচ রাত তো হলোই না, কেমন দুপুরে-দুপুরেই আগরতলার কর্ণেল চৌধুরী রোডের রয়্যাল গেস্ট হাউজে এসে বসে আছি। হ্যাঁ, যে-সিএনজি স্কুটারওয়ালা দুজনের সঙ্গে নির্বাসন দণ্ডের সময় গল্প করছিলাম, তারাই আমাদের চারজনকে বর্ডার থেকে এখানে পৌঁছে দিয়েছেন। মাত্র দশ কী পনেরো মিনিট সময় লেগেছিল। আচ্ছা, আখাউড়া খালটা কোথায় ছিল? হাওড়া নদী? এক সময় নাকি বাংলাদেশের মানুষ আগরতলা আসতো আখাউড়া খাল দিয়ে ছোট ছোট ছিপ নৌকায়! আগরতলার বিখ্যাত সাংবাদিক তাপস দেবনাথের বইতে পড়েছিলাম।  

হোটেল কক্ষে ঢুকেই আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিই। ভ্যাপসা গরমে বেশ কাবু হয়ে পড়েছিলাম। গোসল করতে পারলে ভালো হতো। বাথরুমে যেতে পারছি না, আমার নতুন বন্ধু পুলিন রায় এখনই বেরিয়ে যাবে মধ্যাহ্ন ভোজ সারতে, তাই। ডাবল সিটেড এ-রুমটায় প্রবেশ করে আমরা আপনাআপনি আপনি থেকে দুজন কখন যে তুমিতে নেমে এসেছি, নেমে এসেছি না ভেসে গিয়েছি নিজেরাই টের পাইনি। আবিষ্কার করেছি দুজনের জন্ম একই সালে। কতো সাল, সেটা না-হয় বিশাল একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়েই থাক। বৃটিশ আমল তো আর নয়! কীবা প্রয়োজন উল্লেখের! শেরামদা আর নিতাই সেন উঠেছেন আরেক রুমে। একটু পরই তিনকবি একসঙ্গে বেরিয়ে গেল মধ্যাহ্ন ভোজ সারতে। আমি গেলাম না, কেননা আমি একটুও ক্ষুধা টের পাচ্ছিলাম না, আখাউড়ার হোটেলে পেটপুরেই খেয়েছিলাম সাদা-রুটি আর আলু-ভাজি। তাছাড়া গোসলের জন্য আমার পরাণ কাঁদছিল। গোসলই আমার এখন প্রিয়তমা। ওকে সঘন আলিঙ্গনে না জড়ালে আমার এখন কোনো শান্তি নেই, বিশ্রাম নেই। আমি চাই গোসলের এক দীর্ঘ চুম্বন!

তরতাজা এক গোসল-সম্ভোগের পর, বেশ তৃপ্তি অনুভব করি। রুমে ফিরে এসে জানলা দিয়ে তাকালাম আগরতলা শহরের দিকে। পুরনো দালানকোঠা, ঘরবাড়ি এবড়ো খেবড়ো, মাঝে মধ্যে তারই ফাঁকে ফাঁকে উদ্ভিজ্জ গুল্মলতা। শূন্য নীল আকাশের গায়ে  রোদেলা দুপুর কি আমারই মতো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে আগরতলার অতীত যাত্রার? ১৭৫৭ সালে উদয়পুর থেকে পুরনো আগরতলায় রাজধানী স্থাপন করেন মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য। তারপর থেকেই এ-শহরটি ক্রমাগত বিস্তারিত হতে থাকে। ১৯০১ সালে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সময় আগরতলার ঘটে বিস্ময়কর উন্নয়ন— রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালি, বন্যার হাত থেকে আগরতলাকে বাঁচাতে কাটাখাল খনন। তারপর নানা চড়াই উৎরাইয়ের মাঝখান দিয়ে আজকের এই আধুনিক আগরতলা। ছোটবেলায় এই আগরতলা শহরটাকেই ধরার জন্য দেখেছি মুস্তাফা স্যার প্রায় প্রতিটি পড়ন্ত বিকেলেই কী প্রাণান্তকর চেষ্টায় হাতড়ে ফিরছেন। হ্যাঁ, সেও আমার এক অমল শৈশবের গল্প। গ্রামে আমাদের বাড়ির কোনাবাড়ি-কাশিমপুর রাস্তার ওপাশে গিয়াস ভাইদের বাড়ির বাংলাঘরে লজিং থাকতেন মুস্তাফা স্যার। ঘরটার সামনে ছিল সুপরিসর এক বারান্দা। বারান্দা আর রাস্তার মাঝখানে ছিল ছোট্ট এক বাগান। কামিনি, হা¯œাহেনা, জুঁই, ঘাসফুল, পাতাবাহারের মেলা ছিল জায়গাটা। সেই বারান্দায় দুই পাশের দুই হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসে মুস্তাফা স্যার রেডিওতে খুঁজে বেড়াতেন আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র। শুধু একটু হিন্দিগান শোনার দুর্নিবার পিপাসায়। কী যে পোকা ছিলেন তিনি হিন্দিগানের। তার কাছে এই হিন্দিগান শোনার জন্য তখন আকাশবাণী আগরতলার এই রেডিও কেন্দ্রটি ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো অপশন ছিল না। সন্ধ্যার দিকে তখন হিন্দি ছায়াছবির কী একটা গানের প্রোগ্রাম হতো। আমিও শুনেছিলাম বটে। যতটুকু না বাদ্যবাজনার আওয়াজ, তারচেয়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দই যেন বেশি শ্রুত হতো। আর একবার সাউন্ডটা নামতে নামতে বঙ্গোপসাগরের পাতালতলে নেমে যেত তো আরেকবার চড়তে চড়তে উঠে যেত দেখো সুউচ্চ হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্টে! গান তো শোনা নয়, একসঙ্গে হয়ে যেত পাতালভ্রমণ আর পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করার দুর্লভ সুখ! চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক