২০১৬ সালে আগরতলা বর্ডারের ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারের অভ্যন্তরে
আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম
পর্ব ১১
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০১৯
আমি নিশ্চিত হই যে, তিন কবি ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারের ভেতরেই আছেন। কিন্তু চোখে কেন পড়লো না। সেটাই আমার কাছে ধন্দ লাগছে। স্কুটারওয়ালা দুজন নাছোড়ের মতো ডাকতেই থাকে, আপনি কোথায় যাবেন দাদা? আসুন না এদিকে! আমি কী উত্তর দেবো। আমার তো ভজঘট অবস্থা। শেরামদারা যে কি ভাবছেন? তড়িঘড়ি আবারো ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারের ভেতর ফিরতে উদ্যোগী হই। চাইলেই তো সব মনোবাসনা পূরণ হয় না, মনমতো হয় না সবকিছু। বিরূপ বিশ্ব, অপূর্ণ পৃথিবী! গেট দিয়ে ঢুকতে যাব, অমনি এ কে ফরটিসেভেন হাতে দাঁড়ানো বিএসএফ জোয়ান দুজন একসঙ্গে তেড়ে এলো। একবার বেরিয়ে এলে নাকি আর ভেতরে প্রবেশ করা চলে না। সমনজারির মতো করে জানিয়ে দিল দুজন হিন্দিতে। হিন্দি আমি বলতে পারি না বটে। তবে কিছু-কিছু অর্থ বুঝি কাজল এবং মাধুরী দীক্ষিতদের বদৌলতে! ওদের হা করে দেখতে গিয়ে যে ডায়লগও শুনতে হয়েছে ম্যালা!
ডায়লগ শুধু শুনেই গিয়েছি, যদি বলারও সুযোগ হতো, তাহলে হয়তো এতোক্ষণে আমি সিপাই দুজনকে বুলি কপচিয়ে একেবারে যাকে বলে কব্জা করে ফেলতাম। এখন আর কী! শেষ আশ্রয় হিসেবে বিএসএফ জোয়ান দুজনের কাছে এবড়ো খেবড়ো ইংরেজিতে আর্জি জানাই যে, ভেতরে আমার তিনসঙ্গী রয়ে গেছেন। ওরা আমাকে না দেখে টেনশন করছে। সুতরাং ভেতরে আমাকে যেতেই হবে।
কে শোনে কার কথা! ওরা আরো উলটো দূরের একটা ছায়াভরা গাছ দেখিয়ে দিল, যান ওটার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করুন। সত্যি রোদটা ভীষণ রগচটা, গরমও বাঘের মতো হালুম। অথচ একটু আগেই যখন বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের কাছে এসে পৌঁছেছিলাম, বৃষ্টির দুষ্টুমিতে ভিজে চুপসা হওয়ার জো হয়েছিল। বৃষ্টি কি তাহলে ভারতীয় সীমান্তে ঢোকার এন্ট্রি পায়নি? এক দেশের বৃষ্টিরও কি আরেক দেশে যেতে ভিসা লাগে! পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়? গবেষণা করে দেখা প্রয়োজন।
রোদের মধ্যে তিষ্টাতে না পেরে আমি অবশেষে বিএসএফ জোয়ান-নির্দেশিত উলটো দিকের সেই গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়াই। ভ্যাপসা গরমে তিনকবির জন্য অপেক্ষা করতে করতে কেবল ঘামতে থাকি। আর নিজেকে বেয়াকুব বলে-বলে শতবার ধিক্কার দিই। এ-কেমন বোকামো তোমার! হুট করেই কিনা একা একা...!
একেই বুঝি বলে আজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত তো, কাল পথের ফকির বনা! গত যাত্রায় যখন আগরতলা বর্ডারে ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারে এলাম, কী রাজসিক অভ্যর্থনাই না জুটেছিল! ফুলে-ফুলে রীতিমতো অভিষিক্ত হয়েছি। আর আজ দেখো কেমন একা নিঃসঙ্গ খঞ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছি পথের কিনারে। হ্যাঁ, সেই ২০১৬ সালে যেভাবে এখানে সংবর্ধিত হয়েছিলাম, সে-কথা কখনো ভোলা সম্ভবপর হবে না। সেবার এসেছিলাম সপ্তম আমবাসা বইমেলায় যোগ দিতে। সঙ্গে ছিলেন কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার আর একঝাঁক গায়েন— আরিফ রহমান, শান্তা সরকার, লীনা ফেরদৌসী, সুস্মিতা দেবনাথ এবং সুস্মিতা দেবনাথের মা। আমাদের দেখেই যেন ভারতীয় ইমিগ্রেশন সেন্টারের ভেতর ভালোবাসার পুষ্পবৃষ্টি নেমেছিল! সবাইকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন আমবাসার বিশিষ্টজন। তিনবছর পরও সে-মুখগুলো কত স্পষ্ট! সবাইকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! আমবাসার মহকুমা প্রশাসক মুক্তিপদ পাল, আমবাসা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন চন্দন ভৌমিক, আগরতলা সংস্কৃতি বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং নাট্যশিল্পী তপন পাল, স্বস্ত্রীক আইনজীবী উত্তম কুমার শর্মা, সাংবাদিক মনীশ চক্রবর্তী! এছাড়াও ছিলেন আরো বেশ কজন মানুষ— যাদের নাম স্মৃতিকোষ থেকে হারিয়ে গেছে সেই কবেই। জানি না, তারা সবাই এখন কেমন আছেন কোথায় আছেন। বিশাল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গেছে আগরতলায়। যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত! উদার মানবিক বামপন্থীদের জায়গায় ক্ষমতায় এসেছে উগ্র ধর্মবাদী দল বিজেপি। দূর থেকে শুনেছি, বামপন্থীদের ওপর নাকি অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছে! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তারা সবাই ভালো থাক। যার যার মর্যাদা নিয়ে সম্মানের সঙ্গে দিনযাপন করুক।
সেবার সলিল কাকাও ছুটে এসেছিলেন আমাকে বরণ করতে। সলিল কাকা মানে সলিল দেববর্মণ! সেই যে শিলংয়ে চির আত্মীয় হিসেবে পাওয়া কবি শঙ্খ শূভ্র দেববর্মণ, তার পিতা। যার ধমণীতে বইছে আগরতলা রাজপুরুষের রক্ত। শিলংয়ের সেই পরিচয়ের পর শঙ্খদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকদূর পর্যন্তই গড়িয়েছে। যমুনার স্রোত বেয়ে শুধু পদ্মা নয়, সমুদ্র অবধি! এটা সম্ভব হয়েছে শঙ্খদার কারণেই। আমার মতো গুটিয়ে থাকা মানুষকে তিনি আত্মীয়তার স্পর্শে জাগিয়ে তুলেছেন। তবে এই সম্পর্কের বন্ধন তৈরিতে কবিতারও একটা ভূমিকা রয়েছে বৈকি। হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। শিলংয়ে পরিচয়ের পর শঙ্খদার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ঢাকায়, খোদ আমার বাসাতে। জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে তিনি কবিতা পাঠ করতে এসেছিলেন পহেলা ফেব্রুয়ারির কবিতা মেলায়। সালটা ঠিক মনে পড়ছে না, কবি শঙ্খ শূভ্র দেববর্মণ তখন উঠেছিলেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনুর ব্যবস্থাপনাধীন তাদের পল্টন অফিসের ডরমেন্টে। কবিতাপাঠের দায় সারার পর শঙ্খদা যেমন আমার বাসায় বেড়াতে এসেছেন, আমিও ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে ছুটে গিয়েছিলাম পল্টনের সেই অতিথিশালায়। এরপর সলিল কাকাও একবার ঢাকায় আমাদের বাসায় থেকে গিয়েছেন দুটোদিন। আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে, ঢাকা হয়ে যাওয়াটা নাকি অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী। সলিল কাকা সেবার কলকাতা থেকে আগরতলা ফেরার পথে যখন ঢাকায় অবস্থান করলেন, আমাদের বাসাতেই ছিলেন। তার সেই ঢাকা-ভ্রমণ নিয়েও লেখা যাবে সাতকাণ্ড রামায়ণ। সেসব কথা অন্য কোথাও বলা যাবে প্রসঙ্গ মিলিয়ে। তবে সলিলকাকা সেদিন বর্ডারে আসেননি। আমাদের অভ্যাগত জানাতে আসা একজনের কাছে মোবাইলসূত্রে জেনেছিলেন যে, আমরা বর্ডার থেকে প্রথমে আগরতলা শহরে যাব, তারপর সেখানে আদি শংকর হোটেলে সারবো মধ্যাহ্ন ভোজন। সলিলকাকা সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আদি শংকর হোটেলের কথা আমার বহু আগে থেকেই জানা ছিল। এ-হোটেলে পাবদামাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা নাকি জীবনের অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকে। আমরাও খেয়েছিলাম। হয়তো ভালো, তবে আমার মা আর নানির হাতে যে পাবদার ঝোল খেয়েছি, তার সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয়। সে-কারণে আমার কাছে অতি সাধারণই মনে হয়েছে। সেদিন সলিল কাকা শংকর হোটেল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন।
কতক্ষণ আগরতলা বর্ডারের সেই গাছতলায় দাঁড়িয়েছিলাম জানি না, হঠাৎ কবি পুলিন রায়কে দেখে যেন রোজার ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ পেলাম। কী যে অসহনীয় ছিল সে-প্রতীক্ষা! প্রায় সমবয়সী খালা মামাসহ পাড়ার একদল ছেলেমেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি তো আছিই। চাঁদ আর কিছুতেই চোখে পড়ছে না! ওদিকে দ্যাখো তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেছে! তাহলে কি কাল ঈদ হবে না? মনটা যখন খারাপ হতে যাচ্ছিল, তখনি হঠাৎ ছোট খালাম্মা লাফাতে লাফাতে চেঁচিয়ে ওঠলেন, অই যে! অই যে চাঁদ! অই যে! ধীরে ধীরে হয়তো সবাই দেখতে পাচ্ছে, শুধু আমারই চোখে পড়ছে না। ছোটখালা রাগে আমার মাথায় জোরে একটা ঠেউয়া মেরে বসলেন, ইস! কানা! আরেকটু ডানে তাকা না! নারকেল গাছের পাতার নিচ দিয়ে! আমিও এবার যেন পথ খুঁজে পেলাম! সরু ফালি কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদটা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মেরে উঠলো।
না, পুলিন রায় চোখ টিপ মারলো না, চোখ বাঁকাও করলো না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে ইমিগ্রেশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আমাকে দেখে শুধু হাত নাড়ালো। একেবারে ঝাড়া হাতপা। ওর সঙ্গে ব্যাগ-লাগেজ কিসসু নেই। কেন? কী ব্যাপার? অন্য দু-কবিই বা কোথায়? আমরা দুজন দুজনের দিকে এগোই।
পুলিন রায়কে সবিস্তারে জানাই, কীভাবে আমার ইমিগ্রেশন সেন্টার থেকে একা একা বেরিয়ে আসা, গরমের মধ্যে কেন আমি এভাবে দাঁড়িয়ে নিচ্ছি নির্বাসন দণ্ড! সব শুনে ও শুধু হাসলো, জানালো যে, আমরা তো ভেতরে ডলার ভাঙাচ্ছি। পাশেই তো একটা রুম আছে! খেয়াল করেন নি বুঝি?
না, খেয়াল করিনি।
অসুবিধা নাই। আপনি ভেতরে যান। আমি একটা ফটোকপি করে আসি।
কিসের ফটোকপি?
আর বলবেন না। এত বড়ো অফিস। এদের ফটোকপি মেশিন নাই। পাসপোর্টের ডলার এনড্রসমেন্টের ফটোকপি লাগবে। এদিকেই নাকি কোথায় দোকান আছে। যান যান ভেতরে যান, শেরামদা আপনাকে খুঁজছেন। আমি বিএসএফ জোয়ান দুজনকে দেখিয়ে বললাম, পাসপোর্ট এন্ট্রি করে বেরিয়ে এসেছি। ওরা তো এখন আর ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
পুলিন রায় এবার সোজা এগিয়ে গিয়ে সেন্ট্রি দুজনকে চোস্ত হিন্দিতে আমাকে দেখাতে দেখাতে জানাল যে, আমি ওর সঙ্গী। আমারো ডলার ভাঙাতে হবে। তাই যাওয়া দরকার। এবার আর কোনো বাধাই থাকলো না। আমি ঢুকে পড়লাম ইমিগ্রেশন সেন্টারে আর পুলিন রায় হাঁটতে লাগলো আগরতলার ভূমিতে, ফটোকপি মেশিনের সন্ধানে। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক