শেক্সপিয়রের জীবনীগ্রন্থের প্রচ্ছদ

শেক্সপিয়রের জীবনীগ্রন্থের প্রচ্ছদ

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯

নাহ! মেয়েটার মধ্যে সাজুর কিছু ছিল না, বনলতা সেনের সেই রহস্যময়তা তো নয়ই। ওর মধ্যে ছিল একটা পাশ্চাত্যের ছাঁচ ও ছিরি। তখনো আমাকে সাজু আচ্ছন্ন করে রেখেছে ঘোরতরভাবে। চিনতে পারছেন তো সাজুকে! ওই যে নক্সী কাঁথার মাঠের— লাল মোরগের পাখার মতো ওড়ে তাহার শাড়ি/ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি/মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে/নাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে/পড়শিরা কয় মেয়ে তো নয়, হলদে পাখির ছা/ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ।

হ্যাঁ, সেই সাজু যে আমার মনোজগতে কী গভীর অভিনিবেশ গড়ে তোলেছিল, তা আমার বলবার নয়। আগেও বলেছি, শৈশবে আমি আমার বাবার একটা ট্রাঙ্কভর্তি বইয়ের খনি আবিষ্কার করেছিলাম। সেই বইয়ের বহরেই ছিল জসীম উদদীনেরও দুটো বই— নক্সী কাঁথার মাঠ আর সোজন বাদিয়ার ঘাট। কী ভালো যে লেগেছিল নক্সী কাঁথার মাঠের কাহিনিকাব্য। আমার শৈশবে তখন গ্রামে বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না। গাছপালাও ছিল ঘন নিবিড়। জোছনা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করা যেত। সেই অনুপম এক জোছনা ঢলঢল রাতে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে নায়ক রূপাই সাজুকে বাঁশি শুনিয়েছিল। সেই জোছনায় রূপাইয়ের কোলে শুয়ে শুয়ে বাঁশি শুনছিল সাজু। সাজুকে হারানোর আশংকায় হঠাৎ বাঁশি থেমে গিয়েছিল রূপাইয়ের। চোখে অশ্রু চিকচিক করছিল। বাঁশির সুর চোখের অশ্রু সব মিলেমিশে ছলবল করছিল পূর্ণিমার উপচানো আলোয়।
 
বাঁশি বাজাতে পারি আর না-পারি, এমন একটা মধুময় জোছনারাত কত যে কামনা করেছি এমনি এক সাজুকে সাথে নিয়ে। সেই কল্পনালতা সাজুর সহজাত সারল্য ছিল না মোটেও মেয়েটির চেহারায়, এমনকি অনুপস্থিত ছিল বনলতা সেনের রহস্যময় সৌন্দর্যও। অন্তত আমার মনে তখন চলকে ওঠিনি এ-প্রশ্ন যে, এতদিন কোথায় ছিলেন? তবুও সে-মেয়েটি, ট্রেনে আমার সামনের আসনে বসা মেয়েটি আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল! আমি তো তখন শুধু জসীমউদদিন বা রবীন্দ্রত্তোর জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু বা সমর সেনে বুদ নই, উল্টো পড়ছি পাশ্চাত্যসহ বিদেশি কবিদের কবিতাও। মনন পরিবৃত নানান বৃত্তে! সেদিন আমি মেয়েটির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম ওফেলিয়ার ছায়া! অ্যানা হ্যাথওয়ের ছায়া। অথবা দুজনের যুগল সৌন্দর্যের সমবেত অম্লমধুরতা! হ্যাঁ, ওর চেহারায় দেহের গঠনে কথা বলার ভঙ্গিমায় পোশাকেআষাকে পাশ্চাত্যের একটা ছাপ ছিল স্পষ্ট। বেশ ইংরেজি বলছিল ওরা। বাড়ি যে সিলেট তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে বোধ হয় সিলেট থাকতো না, লন্ডনেই গড়েছিল নিবাস! বাংলাদেশে বেড়াতে এসে হয়তো ঢাকা-সিলেট খেলছিল।

তো এখানে ওফেলিয়া বা অ্যানা হ্যাথওয়ের কথা আসছে কেন? কেননা ওরাও সাজু বা বনলতা সেনের মতো আমার মানসপটে গেড়ে বসেছিল, গড়ে দিয়েছিল আমার খানিকটা কাব্যমেজাজও। আব্বার সেই বইয়ের ট্রাঙ্কের মধ্যেই জুটেছিল শেক্সপিয়রের এক জীবনীগ্রন্থ। সে-বইতেই পড়েছিলাম, এক কুয়াশা-উপচানো ভোরবেলা শেক্সপিয়রের বাবা ওকে পাঠিয়েছিলেন নিজের কী একটা ব্যবসায়িক কাজে। বোধ হয়, টাকা ওঠানোর তাগাদা দিতে। তো সেই পথে, স্ট্র্যাটফোর্ড অন আভনের সেই কুয়াশামোড়ানো পথে, হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ তীব্র কুয়াশার ভেতর বিপরীত দিক থেকে আসা এক মেয়ের সঙ্গে প্রচণ্ড শারীরিক সংঘর্ষ ঘটে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের। তারপর দুধভেজা কুয়াশার আবছায়ায় একজন আরেকজনকে অবাক চোখে দেখতে থাকে, দেখতে দেখতে একজন আরেকজনের কাছ থেকে দুই বিপরীত দিকে সরে যেতে যেতেই হঠাৎ, শেক্সপিয়র যেন অনেকটা অনন্যোপায় হয়েই খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোই বলে ওঠলো, আমাদের কি আবারো দেখা হতে পারে না? মেয়েটার পথচলাও থেমে গিয়েছিল, মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়েছে, হুম। দেখা হতে পারে। নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, দেখা হয়েছিল, মেয়েটা এসেছিল টন টন মিলিয়ন কবিতার প্রেরণার গোলা ভরে নিজের সাথে নিয়ে, শেক্সপিয়নের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে সমস্ত জীবন। মেয়েটার নাম অ্যানা, অ্যানা হ্যাথওয়ে! হতে পারে, হ্যাঁ, হতে পারে, ট্রেনেও এ মেয়েটা হতে পারে আমার অ্যানা হ্যাথওয়ে! বানিয়ে দিতে পারে আমাকে অনন্য শেক্সপিয়রে! তাহলে কি দেখা হয়ে গেল কবিতা-দূতির সাথে? সে কি রূপেসৌরভে ধরা দিতে যাচ্ছে আমাকে এখনই? অ্যানা হ্যাথওয়ে তো বুঝলাম। ওফেলিয়া কেন? তখন, সেই আমার প্রাক-দ্বিবার্ষিক বাংলা বিভাগে, আমার বিষাদদিগন্ত সময়ে আমি কেবল আবিষ্কার করেছি রাইনার মারিয়া রিলকে, বোদলেয়ার, আলবেয়ার ক্যামু, এলিয়ট, র‌্যাবো, কাফকা! আর আশ্চর্য দেখো রিলকে ও কাফকা দুজনই উঠে এসেছিলেন প্রাগ থেকে। প্রাগ থেকে যারা উঠে আসে তারাই কি অনন্ত বিষাদে পোড়ে? নিঃসঙ্গতায় ভস্ম হতে থাকে কেবল? কাফকার বিষণ্ণতা আমাকে ছুঁয়েছিল রিলকের বিষাদও। এই রিলকের কবিতা থেকেই আমি পেয়েছিলাম ওফেলিয়াকে। আমার ওফেলিয়া নয় শেক্সপিয়রের হ্যামলেটের ওফেলিয়া, বিষ্ণু দের কবিতার ওফেলিয়া, আমার ওফেলিয়া রিলকের ওফেলিয়া। রিলকের কবিতার ওফেলিয়া! সে ওফেলিয়ার কথা একদমই মনে নেই। বুদ্ধদেব বসুর অনূদিত সে-বইটিও কোথায় হাওযা হয়ে গেছে! তবে বোদলেয়ারের মতো বুদ্ধদেব বসুর রিলকের সেই অনূদিত ওফেলিয়াও আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেই রিলকে যার মৃত্যু হয়েছিল গোলাপের কাটায় বিষাক্রান্ত হয়ে। তখন অবশ্য তেমন বুঝিনি ওফেলিয়া, যেমন বুঝিনি দুয়িনি এলিজিও, কিন্তু ওফেলিয়ার নামের সম্মোহনেই হোক আর কবিতার বিষাদছোঁয়া মাধুর্যের কারণেই হোক, যার প্রতি আমার প্রেম আসতো তখন, জাগতো ভালোবাসা, তাকেই আমার মনে হতো— সে আমার ওফেলিয়া! আমার হাতে গোলাপ দিলে আমি তাকে চুমু খাবো না। সারা পৃথিবী যেন শুনতে পায় এমন জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠবো— ও     ফে    লি    য়া...

তো, আমি সেই সিলেটগামী ট্রেনে ওফেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বিমোহিত হয়েছিলাম, বিমুগ্ধ হয়েছিলাম, নিজেকে বুঝি বিস্মিতও হয়েছিলাম। আমার পক্ষ থেকে ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটা ছিল বড় মুশকিলের ব্যাপার। একেই কি বলে পটলচেরা চোখ! কী ডাগরডোগর চাহনি! ঠোঁটটা বাঁশির মতো পাতলা, মুখের শেপটা ধারালো— সবমিলিয়ে বেশ শার্প! আর বড় কথা হলো মেয়েটা স্লিম, তাই বলে টিঙটিঙে নয়। ঢলোঢলো ভাবটা আছে চেহারায় দেহের ভাঁজে ভাঁজে। মনে হলো নাকের ডগায় টোকা মারলেই রঙধনুর আবির্ভাব হবে! তা কত বয়স হবে? বোধহয় উনিশ কিংবা কুড়ি! তো, সেই উনিশার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, আমি যখন চোখকে একটা ইন্টারভ্যাল দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি কী তাকাইনি, অমনি দেখো সুনীল আকাশের মাখো মাখো সাদা মেঘগুলো আমার উদ্দেশে ফিসফিসিয়ে ওঠলো, অ্যাই হাঁদারাম! এর জন্যই তো তোকে আজ ট্রেনে ওঠিয়েছি! মেয়েটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সেরে নে। ঠিকানা রাখ! বুঝলি না! যা যা, ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! সাদা মেঘ চোখ টিপে সরে গেল কোথায়।

তাই নাকি? আমি মাননীয় মেঘ-মহোদয়ের কাছে সাপোর্ট পেয়ে আবারো মেয়েটার দিকে তাকাই আর ভাবি, কীভাবে ভাব জমানো যায়, কীভাবে বলা যায় কথা! কথা বলার সাহস আর কিছুতেই আসে না। পা কাঁপে যত থরথরিয়ে, হৃদয় কাঁপে তত বেশি ধুকপুকিয়ে! তবু আমি মেয়েটাকে দেখি! দেখেই চলি। দেখতে দেখতে টায়ার্ড হলে বাইরের দিকে তাকাই। আর বাইরের দিকে তাকালেই প্রকৃতি— কখনো গাজীপুরের শালবন, কখনো ভৈরবের নদীপিঠ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ধমকে ওঠে, ভেতরে মন দে। ভেতরে মন দে।

তাজ্জব তো! ট্রেনটাও কি সেই একই কথা বলে চলেছে নাকি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আশ্চর্য হয়ে শুনি, ট্রেনটাও ছুটতে ছুটতে বলছে, ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! তাই নাকি? হ্যাঁ, এই তোর অ্যানা হ্যাথওয়ে! তোকে শেক্সপিয়র বানাবে দেখিস! ভেতরে মন দে! ভেতরে মন দে! এইসব অনুপ্রেরণা! চারদিক থেকে! আমি দ্বিগুণ সাহস সঞ্চয় করে আবারো মেয়েটার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করি, মাঝে মাঝে চোখ পিছলে যায়, মাঝে মাঝে চোখ চোখে স্থির হয়, তারপর মেয়েটা ঝটিতিই চোখ নামিয়ে ফেলে। এমনি যেতে যেতে হঠাৎ আচমকা খেয়াল করি যে, মেয়েটার চোখ আর নামছে না! আমার চোখে থির হয়ে আছে। এক সেকে- দুই সেকেন্ড তিন সেকেন্ড... ষাট সেকেন্ড... এক মিনিট... দুমিনিট... তিনমিনিট— আরে ব্যস! হয়ে গেল নাকি! বাঁশি কি বাজলো বেগে! মেয়েটার ঠোঁটের ফাঁক গলে কি প্রথম সকালের রোদের মতো ঝলসে ওঠলো শেফালিফুলের ধবধবে হাসি? আমি যখন অভিভূত হতে যাবো! ঠিক ত-ত-ত-খনি... গ-গ-গলা খাঁ-খাঁ-কারির শ-শ-শব-দদ শু-শুনে... ওরে বা-বাবা! এ-এ-এ এটা কে?

একেবারে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের রুদ্ররূপ! মিলিটারি মার্কা গোঁফ! ঘন ভারি। দুপাশ থেকে চুক্কা হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। চোখটাও কি ভয়ংকর। রক্তলাল। সুগোল। এমন ভয়ানক চেহারা বাপের জীবনে আর কখনো সামনাসামনি দেখিনি। সিনেমায় অবশ্য অনেকবার দেখেছি অমরেশ পুরীর বদৌলতে! কী হয় সম্পর্কে মেয়েটির? অচিরেই ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে বাকি রইলো না, বাবা! এই ভয়ানক চেহারার ভদ্রলোক হন মেয়েটার বাবা! সর্বনাশ! এতক্ষণ যেভাবে ফ্রিস্টাইলে ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম, ওকে দেখছিলাম— উনি কি সব খেয়াল করেছেন নাকি? আমি মানে মানে সিট থেকে উঠে বাথরুমের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক