আলোকচিত্রী: লেখক

আলোকচিত্রী: লেখক

আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ৪

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মে ২৭, ২০১৯

হ্যাঁ, আমি আল মাহমুদের কথাই বলছি। কী আশ্চর্য! ট্রেনের দোল-দোলানিতে তার কোনো অটুট ছন্দ-গাঁথুনির ছড়া নয়, মৃত্তিকাসংলগ্ন কবিতাও নয়, মনে পড়লো কিনা গল্পের কথা— রোকনের স্বপনদোলা। সে এক এমনি ট্রেনভ্রমণের কাহিনি। তাও আবার এ-রুটেরই ট্রেন, ঢাকা টু চট্টগ্রাম। তবে সেটা দিন নয়, রাতের যাত্রা।
 
আবারো সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া! ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন থেকে প্রায় যাত্রীশূন্য বলে ফার্স্ট ক্লাসেরই এক কামরায় বউ নিয়ে উঠে বসলো চাকরিজীবী রোকন। ওরা চট্টগ্রাম যাবে। ট্রেনের কামরায় উঠেই রোকন আবিষ্কার করলো আরেকজোড়া দম্পতিকে। সেই দম্পতি-জোড়ের নারীর পাশেই বসতে হলো ওর বউ রোকেয়াকে। ক্রমে আলোআঁধারির ভেতর সেই নারীকে বিপরীত দিকে বসা রোকনের মনে হতে লাগলো চেনা। যেন কোথায় দেখেছে! আস্তে আস্তে ওর স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠলো এবং ও আবিষ্কার করলো যে, এই মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই সেকেন্ড মাস্টারের মেয়ে, যার সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার কথা একরকম ঠিকঠাকই হয়েছিল। তখন মেয়েটিকে পছন্দ হয়নি। কিন্তু এখন রোকন মনে মনে বলছে, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগছে। তোমার চোখ আভাময় হয়ে উঠেছে। তোমার ঠোঁট দৃঢ়তার বদলে কাঁপছে। কে বলেছে তোমার নাকটা কদাকার?’ রোকন সেই নারীকে নিয়ে অদ্ভুত এক ফ্যান্টাসিতে জড়িয়ে যায়। আর রোকনেরই প্রণোদনায় কিনা হঠাৎ আমিও সেই গল্পের ঘোর থেকেই যেনবা গা মোচড়ে জেগে উঠি, দাঁড়িয়ে পড়ি সটান। আমার সামনে পেছনে ইতিউতি খুঁজি... কাকে খুঁজি আমি? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, ওকে?

হ্যাঁ ব্যাপারটা মিথ্যে নয়, কষ্টকল্পিতও নয়। আমার আব্বা গাজীপুর কোনাবাড়ির আজকের যে বিখ্যাত শরীফ ডাক্তার তার সঙ্গে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার বিয়ের পাত্রী দেখতে। আব্বার পছন্দও হয়েছিল মেয়েটিকে, আমাকে দেখাতে মেয়েটির ছবিও নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে... আমি মেয়েটার ছবি খুব খুব দেখেছিলাম... যেমন প্রতিটি বসন্ত এলেই নতুন নতুন পত্রপল্লব দেখি, অবিকল সেই অনুধ্যান নিয়েই দেখেছিলাম! সে-কথা মনে পড়তেই আমি কবি নিতাই সেনের উদ্দেশে বেশ জোরালো সুরেই বলে ওঠলাম, জানেন নিতাইদা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিন্তু আপনার চাইতেও আমার আরো বেশি আপন হতে পারতো, আরো বেশি আত্মীয় হতে পারতো, আরো বেশি স্বজন...

নিতাই সেন ততক্ষণে মোবাইলে কল দিয়ে বসেছেন, দাঁড়ান! শেরামদারা কতদূর এলেন একটু খবর নিয়ে নিই। আমি সে-অবসরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। উপচানো সবুজে চোখকে ভিজিয়ে নিই, চোখকে দারুণ এক রৌদ্রস্নান দেই। ট্রেন ধীরাশ্রম ছাড়িয়ে চলেছে... নিতাই সেন মোবাইল অফ করতে করতে বললেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? আমি তখন ঘটনাটা নিতাই সেনকে সবিস্তারে খুলে বলি যে, আমার কীভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামাই হওয়ার একটা সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হয়েছিল। নিতাই সেন খুব আফসোস করতে থাকেন। ইস! সেটা হলে আজকের রাতটা আর আমাদের আগরতলায় স্টে করা লাগতো না। আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকেই কাল সকাল-সকাল আগরতলার এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেনটা ধরতে পারতাম! আমিও সায় দিই যেন সেই সুগন্ধিটা পেতে পেতেই, ‘হ্যাঁ, বাসা থেকে আমার শাশুড়ি আম্মাজানের রান্না চাপলাইশ চালের লাল সুস্বাদু খোশবাই গরম ভাত খেয়ে...উমম! সাথে দেশি করথনাথ মুরগির মাংসল রান! গোল আলুর অর্ধ চাক থেকে একটু একটু ভেঙে ঝাল সালুনে মিশিয়ে! উফফ! ঝালে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে!’ নিতাই সেন ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার শ্বশুড়বাড়ির মানুষগুলো এত ঝাল খায় কেন? আমি তার দিকে অবাক চোখে তাকালাম! এত সুন্দর আতিথেয়তা পেয়েও তিনি...

সত্যি ট্রেনটা যতো গতি পায়, আমি জানি ক্যারম ক্যারম হয়ে যাই। আমি আর আমি থাকি না। একটা কেউকেটা একটা জায়ান্ট একটা হিরো... প্রথম যেদিন ট্রেনে চড়লাম, সেদিন থেকেই এ-অবস্থা আমার! আহাহাহা! কোনোদিন ভুলবো না সে-কথা, কোনোদিন ভোলা সম্ভব নয়! যদি ভোলা যেত! ঝড়ের আর্তনাদ থেকে মুক্তি পেতাম! ডানাভাঙা পাখির ছটফটানি থেকে উদ্ধার হতো! বাংলাসাহিত্যেও আবির্ভাব ঘটতো একজন শেক্সপিয়রের! বলবো সে-গল্পটা? বলি? কবিতার সঙ্গে কিন্তু যায়! ইম্ফলের সঙ্গেও! কীভাবে? তাহলে আমার সঙ্গে পুরো যাত্রাতেই যে থাকতে হবে আপনাদের! থাকবেন তো?

সে এক আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ি। ফার্স্ট ইয়ার যাই যাই করছে। সেকেন্ড ইয়ার বলছে এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে! ঠিক তেমনই এক সময়ে একেকটা দিন আমার কাছে যে কী বিপুল নিঃসঙ্গতার খোড়লে অন্ধকারা, সে কেবল আমিই জানি! বন্ধুদের আড্ডা ভালো লাগে না, বইপড়া হয়ে ওঠে একঘেয়ে। সিনেমা হলে ঢুকলে অন্ধকারকে মনে হয় অজগরের পেট। আমি ছবি না দেখেই বেরিয়ে আসি বাইরে। অথৈ বিষাদ আমাকে গ্রাস করে রেখেছে। আমি কবিতা লিখতে চাই, কবিতা লিখে হতে চাই যন্ত্রণামুক্ত! কবিতাও ক্যাম্পাসের কাঙ্ক্ষিত মেয়েগুলোর মতো ফিরে তাকায় না। নক্ষত্রপতনের মতো কোথায় ত্বরিৎ হারিয়ে যায়! আমি আবুল হাসানের লাবণ্য-পাথরে মাথা খুঁড়ে মরি! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ঘাড় ত্যাড়া করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠি, আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে!

তেমনি এক উড়ো পালকের দিনে হঠাৎ আবিষ্কার করি যে, সোয়ারিঘাট গেলে লঞ্চ টার্মিনালে ঘুরে বেড়ালে আমার যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশম হয়। আমি পরম বিস্ময়ে আবিষ্কার করি, কমলাপুর রেলস্টেশনে গেলেও আমার কষ্টের কিছুটা লাঘব ঘটে। আমি আরো উপভোগ করি যে, বিমানবন্দরের যাত্রী লাউঞ্জে ঘুরঘুর করলেও একটা আনন্দের জগৎ যেন ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সেতারের হাহাকার কাটিয়ে ওঠে আনন্দশংকরের তালে তালে একরাশ আনন্দের ধ্বনিমঞ্জুরি তৈরি করে চলে! এমনকি যে ফুলবাড়িয়া বাসস্টপেজ সেখানেও মানুষের ভিড়ের ভেতর হারালে জীবন যেন খুশিতে হঠাৎ সুনীল গাঙুলির নীরা হয়ে মুচকি হাসে! তাই আমি নিজের অলক্ষ্যেই কখনো ছুটে যাই বিমানবন্দর তো, কখনো কমলাপুর, কখনোবা সোয়ারিঘাট কখনো আবার ফুলবাড়িয়া বাসস্টেশন!
 
এ-এক বিচিত্র ব্যাপার। মন চাইলো তো ছুটো। সকাল তো সকাল, বিকেল তো বিকেল, হোক না দুপুর— ক্লাসের পরোয়া কে করে? ওসব জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার আর কোনো নির্দিষ্ট সময়-অসময় থাকে না। একবার মাঝরাত্রিতেও গিয়েছিলাম কমলাপুর রেলস্টেশন। সে যে কি কলকের উৎসব! ঘন হয়ে বসে সকলে, গোল হয়ে বসে সকলে, হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকে! দিয়ে যাও টান! জোরে নাও দম! সেও এক দৃশ্যকাব্য বটে। আমিও সেখানে বসে কবিতার লাইন হয়ে গিয়েছিলাম! কবিতা কি শুধু কাগজেই থাকে? নাকি তা শুধু সুললিত কণ্ঠে ময়ূরির মতো পেখম মেলে? কবিতা কখনো-সখনো ঝিম মেরে বসেও থাকে, কলকের দম হয়! ব্যোম ভোলানাথ বলে!

তো একদিন সেই কমলাপুর রেলস্টেশনে জুটে গেলাম খুব সকালবেলা, প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, অ্যারে ছ্যা! এক কুড়ি বয়স হলো তোর! এখনো যে ট্রেনে চড়িসনি? বলি, মেয়েরা কেন প্রেমে পড়বে তোর! গাধা কোথাকার! আর সহ্য হলো না। অন্য কেউ গাধা বললে দুম করে হয়তো একটা চড় বসানো যায়! বা চড় বসানোর সাহস না পেলে পরে ফেসবুকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তার বিরুদ্ধে একটা কড়া স্ট্যাটাস লেখা সম্ভব! কিন্তু নিজে যদি নিজেকে গাধা বলা হয়— কাকে মারবো? বলুন উত্তর দিন, কাকে করবো প্রহার! তখন তখনই হা পিত্যেশ টিকেট ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগলাম শ্রীমঙ্গলের টিকেট কাটার জন্য! দুদিন আগেই বাড়ি থেকে পাওয়া পকেটের নগদ ক্যাশগুলো আমাকে দৌড়ে যেতে হর্ন দিচ্ছিল। টাকাও যে পুলিশ হয়ে উঠতে পারে, এবং বিকটভাবে হর্ন বাজায়, সেদিনই প্রথম জানা হলো।

তো, শ্রীমঙ্গল কেন? তখন আশপাশে শুধু গল্পই শুনে যাচ্ছিলাম ক্যাম্পাসের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সব যুবাদের কাছে, শ্রীমঙ্গল নাকি এক রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা! জঙ্গলে ভরপুর! দিনদুপুরে সেখানে অজগর চড়ে বেড়ায়। আর নাকি চাবাগানগুলো বেশরমের মতো রোদে শুয়ে থাকে নগ্ন হয়ে! সেই তোড়েই কিনা অমন করে হঠাৎ শ্রীমঙ্গলের টিকেট কাটার ঝাকানাকা! এখন কেউ মনে করিয়ে দিতেই পারেন, কেন বাপু! কক্সবাজারেও তো সমুদ্র নগ্ন হয়ে রোদ পোহায়! সেখানেও তো যেতে পারতে! আমি শুধু বিনয়ের সঙ্গে একটি কথাই বলবো, আমি কি শুধু প্রকৃতির নগ্নতা দেখতেই যাই? কক্সবাজারের সমুদ্র কি শ্রীমঙ্গলের অরণ্যের মতো অতো গাঢ় সবুজ শ্যামল ছায়ার পোশাকে গা ঢেকে রাখে? অমন অবগুণ্ঠনও তো আশ্চর্য এক শোভা! ওখানে যা চাবাগানগুলোই একটু লজ্জাহীন, বেআব্রু!   

কিন্তু ট্রেনে ওঠেও যে শ্রীমঙ্গল পৌঁছানো যায় না বা শ্রীমঙ্গল পৌঁছালেও যে শ্রীমঙ্গল যাওয়া হয় না, তা আমি ছাড়া আর কে বেশি জানে! ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আমার চোখ হঠাৎ সুতীব্র ব্রেক ফেল করে বসলো শ্রাবস্তীর কারুকার্যে! চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক