আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর কয়েকটি কবিতা
প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২২
প্রকাশিত হয়েছে আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর কবিতার বই ‘সমস্ত বিসমিল্লাহ’। বইটি থেকে কবি কর্তৃক নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
মাওলানা
সিজদায় মজে আছে মাওলানা
দিলে বাজে রব্বানা
আমি মুক্তাদি, রুকুতে শামিল—
পড়ি সুবহানা।
মাওলানা ধীরে মধুর কিরাত করে
আমার ক্বলবে গোপন রক্ত ঝরে।
নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজি
সুজুদে হয়েছি ফানাহ ফিল্লা।
মাওলানা, মাওলানা কী শোনাও সুরে সুরে?
কীভাবে পা রাখি আজ লাল মসজিদের বাইরে?
আমার গোলাপ ফুটে আয়াত আল্লাহর
বুকে মরা গাছ জাগে কালাম আল্লাহর
আমি হারিয়েছি পৃথিবীর ঘড়ি, সময় ধারণা।
মাওলানা প্রিয় মাওলানা
আমি নিহত হয়েছি দুনিয়ার ভাষা—
ঝোপ জঙ্গলে, রূপসি হেলেনে
আমার হদয় শক্ত হয়েছে আনন্দ গানে।
আমি পূজা করি আমার নাফস আমমারা
আমি বিদ্রোহ করি সকালে বিকালে!
মাওলানা প্রিয় মাওলানা
আমি আজ কোথাও যাব না
আমি ঘুমিয়ে পড়বো তোমার কিরাতে
আমি মোম হয়ে গলে পড়বো আলিফ লাম মিমে
আমি ভুলে যাব আমার নাম ও ঠিকানা।
তোমাকে খুঁজি
নিরাকারে তুমি থাকো, তোমাকে দেখার যে কোনো উপায় নাই।
সে ব্যথায় আমি বিচলিত, চোখ মেলে অপেক্ষায় থাকি
রুকু আর সিজদার গহীনে তোমাকে খুঁজি।
তুমি কেবল দূরেই থাকো, আসো না সাক্ষাৎ রূপে
তোমার দিদার হবে কেবলই আমার জান্নাতে পেলে!
তোমাকে আসমা উল হুসনার সত্যে উপলদ্ধি করি
তাই ভাষাই মাধ্যম হয় তোমাকে পাওয়ার।
যেন ভাষা-দুনিয়ায় তুমি রয়েছ হাজির!
আমি ভাষা-বীনা কোনো পথ পাই না মালিক।
আমি ভিখারির বেশে নামাজে দাঁড়াই।
তোমার হঠাৎ উপস্থিতি টের পেতে চাই।
তুমি তাই— যেই নাম ধরে ডাকি
নিরানব্বই নামের নূরে তুমি স্বয়ং প্রকাশ আল্লাহ!
তুমি আকারে নাই কিন্তু অক্ষরে আছ
সুরাহ ফাতিহা থেকে সুরা নাস পর্যন্ত মায়াবি কালামে
তুমি হও প্রকাশিত। যেন জিন্দা সব আরবি অক্ষর—
আমার ক্বলবে— সুরে সুরে কথা বলতেছে।
তোমার নামের কারিশমা প্রতিটি হরফ থেকে উপচিয়ে পড়ে!
এই কি তোমার রূপ হে আল্লাহ, ইয়া জুল জালালি ওয়াল ইকরাম?
তোমাকে দেখার লোভে আমি ক্রমাগত আরবি কালামে মশগুল।
যেন বা আলিফ, লাম মিমের রহস্য খুলে— তুমি আলো করে
উপস্থিত হও আমার সালাতে!
আমার আল্লাহ
কবি সৈয়দ তারিককে
মানুষের দেহে থাকেন না তিনি, নাই কোনো জীব ও জন্তুতে।
সবই সৃষ্টি তার, স্রষ্টা তিনি। তিনি আলিমুল গায়েব, অদৃশ্য।
সব কিছুই ছুটছে তার পিছু, তিনি জানেন জাহির ও বাতেন।
বান্দাদের কন্ট্রোলার তিনি, তিনি দেন হিদায়েত কিংবা গোমরাহি।
তিনিই শব্দ, তিনিই বাক্য, শক্তি দেন কথা বলবার
তার কাছ থেকে সরে গেলে আওলিয়া সাজে শয়তান।
পুত্তলিকায় হাজির নাই তিনি, নাই কোনো পির বা মুর্শিদে
সবকিছুর ওপরে তিনি, মহাপ্রভু বসেন আরশে— সিংহাসনে।
কারো পিতা নন তিনি। কোনো সৃষ্টি নয় তার— পুত্র অথবা কন্যা।
আদমও সৃষ্টি তার, ইব্রাহিম কিংবা মরিয়ম পুত্র— যিশু।
নাফসে পাবে না তাকে, না পাবে মোরাকাবায়।
আবিদের ঈমান, আমলে তিনি, তাকে পাওয়া যায়
নবিজির হাদিসে, সালাতে; আল কোরআন, সিজদায়।
তিনিই একক। নাই তার অংশীদার, কেউ দ্বিতীয় অপর।
শুরুতেও তিনি, সমাপ্তিও তিনি, রাহমানুর রাহিম-আল্লাহ!
হাওয়া তোমাকে
তোমাকে লুকিয়ে রাখবো তামার পোশাকে
তিমির রাত্রি, নিবিড় যতনে, আউশফিৎজ ক্যাম্পে
গোপন কওমে, নিষিদ্ধ ভাষা— ভাষার বাবেলে।
তোমার শরীরে যেন কেউ ভুলে চক্ষু না দেয়
কেউ যেন হাত না দেয় তোমার নরম পালকে
অতি মনোরম স্পর্শকাতর— যাদুর আপেলে।
যেন সারা দেহে গাছ উঠে ঘন, গহীন গভীর
আমাজন-অ্যানাকোন্ডা চড়িয়ে গার্ড দেব।
তোমাকে যে ছুঁবে তাকে যেন দাঁত
দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে আমার হিংস্র পালাসাপ।
আগুন গাছের কামিজ বানিয়ে রাখবো সকালে
যেন বিচে গেলে হায়েনারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
তোমাকে আড়াল করবো হাবিলি কুঞ্জে
পাথর মর্মে, মাছের কফিনে, আবলুশ সিন্দুকে
লোহার পেরেক রাখবো সকল দরোজায়।
সায়ানাইডের প্রলেপ রাখবো হাতলে
যৌনডাকাতের হাত পচে যায় যেন
জননলাঠিতে তার পোকা খাবলিয়ে ধরে।
কালাশনিকভ নিয়ে আমি বসে থাকবো তোমার
বিছানার পাশে। শীত ও গ্রীস্মে দাঁড়িয়ে থাকবো
ধারালো মাসেটি-সামুরাই হাতে।
আমাকে পাগল বলো আর যাই বলো
আমি তো তোমাকে জান দিয়ে ভালোবাসি প্রিয়।
প্রেমিক আদম আমি, আদমের সন্তান
তোমাকে বিবাহ করে গাই স্বাধীনতা, শান্তির গান।
আমি ও ২২ শ্রাবণ
বাইশ শ্রাবণ আসলে পরে
একটা রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে বইসা থাকে।
আমার গরুর মাংস খাওয়া দেখলে তিনি চইলা যান না
বা আমার ‘আল্লাহু আকবর’ বইলা আজান দিলেও
রাগ করেন না। তিনি আমার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকেন।
আমি সোনার তরী, গীতাঞ্জলি নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ—
এইসব কবিতা আবৃত্তি কইরা শোনাই।
রবীন্দ্রনাথের পিপাসা লাগে। আমি পানি আইনা দেই।
এক সময় তিনি চায়ের কথা বললে, আমি চা বানাইয়া দেই।
আমি বলি, দেখেন আপনে মুসলমানদের নিয়া লিখেন নাই
বইলা আমার কোনো দুঃখ নাই। এইটা হইতেই পারে।
কিন্তু আপনে আমাগোরে বহিরাগত বলছেন।
ভিনদেশি বলছেন, এতে আমি কষ্ট পাইছি।
আমি বলি, শুনেন কবি, আপনিও তো বাইরের লোকই।
এইটা শুইনা রবীন্দ্রনাথ লজ্জা পায়। মুখ ঘুরাইয়া
জানালার দিকে তাকাইয়া থাকে।
তখন আমার নবিজির কথা মনে পড়ে।
তিনি কীভাবে একজন আবিসিনিও আর কালো
আমার ভাই— বেলালকে বুকে জড়াইয়া নিছেন।
এইসবই ইসলামের শিক্ষা। এইখানে
জাতপাতের কোনো ভেদাভেদ নাই।
তাই আটশো বছরের রাজত্বের পরও মুসলমানরা
ভারতবর্ষ থাইকা কাউরে চইলা যাইতে বলে নাই।
তারপরও বাইশ শ্রাবণ আসলে পরে
একটা রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে বইসা থাকে।
সব কথা শোনার পরও তিনি কোথাও চইলা যান না।
আমার ভাষার মধ্যে চুপি চুপি নৌকা চালাইয়া যান!
কাফকার যদি দেখা পাইতাম
কাফকার যদি দেখা পাইতাম তাহলে তারে সিডনির তুর্কি কাবাব শপে কাবাব খাওয়াইতাম। তারপর তার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাইয়া বলতাম, তোমার মনটা ভালো তো কাফকা? বলতাম, কে তোমাকে এত দুঃখ দেয়, কে তোমাকে বন্দি করে রাখে নাম না জানা কাসেলে? তখন হয়ত কাফকা একটা সিগারেট ধরাইয়া, ধোঁয়া টানতে টানতে বলত, আমার এই সমাজ ভালো লাগে না, এই রাষ্ট্র, প্রশাসন, আমলা আর মেসিনের মতো সারাদিন কাজ আর কাজ অসহ্য লাগে। মাঝে মাঝে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে! তখন আমি বলতাম, চলো চলো আমরা সমুদ্রের কিনার ধইরা হাঁটি। সিগালের ডানা ধইরা নাচি। এই যে বিশাল আকাশ, আকাশে তাকাইয়া থাকি। দেখ দেখ প্রাগের আকাশে এত নীল নাই। দেখ দেখ সুবাহানাল্লাহ— এই যে বড় বড় ঢেউ আর ওপরে সাদা সাদা মেঘ। এই যে পড়ন্ত সূর্য, এই যে গুত্তা খাওয়া তিমি! তখন হয়ত কাফকা তার নোটবুক বার কইরা গল্প লিখতে শুরু করত। চোখ বড় বড় কইরা আর একটা গ্রেগর সামসা, তার পোকা হওয়ার কাহিনি লিখত।
আমি বলতাম, কাফকা তোমার কি ঘর বাড়ি নাই? বউ বাচ্চা নাই? তুমি বিয়া করো না কেন? বয়স তো আর বইসা নাই। তখন হারবার ব্রিজ ধইরা আশ্চর্য সন্ধ্যা নাইমা আসত। তখন কোথাও একটা মিনার থেকে আজান ভাইসা আসত। আমি বলতাম, চল চল মসজিদে যাই। তাকে তখন সুরা ইখলাস শুনাইয়া দিতাম। অথবা সুরা আদদুহা শুনাইয়া দিতাম। বলতাম, ওয়াদ্দুহা, ওয়াল লাইলি ইজা সাজা— উজ্জ্বল দিনের কসম এবং কসম রাতের যখন তা নিঝুম হয়ে যায়। মা ওয়াদ্দাআকা রাব্বুকা ওমা কালা— তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেন নাই এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হন নাই। বলতাম, ওয়াল আখিরাতু খইরুল্লাকা মিনাল উলা— নিঃসন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে উত্তম। বলতাম, এখানে বসো তাহলে তোমার কোনো অশান্তি থাকবে না। এখানে যারা আসে তাদের কোনো জেলখানা থাকে না। তাদের শুধু একজন একমাত্র সাহায্যকারী থাকেন। যিনি ভালোবাসেন আর ক্ষমা করেন। তিনি সর্বজ্ঞানী, তার কোনো বে-ইনসাফি নাই। আমার এইসব কথা শুইনা কাফকা কী করত? সে কি হাসতে হাসতে ফাইটা পড়ত? তার বানানো অচেনা কেসেলে লুকাইয়া পড়ত? নাকি আসহাবুল কাহাফের যুবকদের মতো তিনশো বছর ঘুমাইয়া থাকত!
আমার নবি
আপনার কথা ভাবতে গেলেই আমার দু`চোখ ভরে পানি চলে আসে। কারো জন্য এমন হয় না আমার কখনো। আপনাকে কত খুঁজে বেড়াই! মাঠে ময়দানে, সবুজে, হলুদে। ভিড়ে, জনশূন্যে। এই তো আপনি আসছেন, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন! কিন্তু আপনাকে আমি কোথাও পাই না! যেদিকে তাকাই শুধু কাঁটাতারের সীমানা।
আপনি জন্মে ছিলেন আমার সময়ের অনেক অনেক আগে। আহা কত আগে, কত আগে! আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আপনি, কিন্তু আবার কীভাবে আমার কাছে বাস্তব হয়ে যান! যেন আমি দেখছি আপনাকে, কথা বলছি, হেঁটে যাচ্ছি আপনার সাথে। দেখছি আপনার মুখ থেকে আলো ফুটে উঠছে, চোখ থেকে আকাশ ঝরে পড়ছে।
আমি আপনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছি! অবশ হয়ে পড়ছে আমার শরীর, বন্ধ হয়ে পড়ছে জবান। যেন ভাভি এক পাহাড় টেনে চলছি ক্রমশ! এক সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি আর ভাবি, ওরা কী করত যারা আপনার কাছে কাছে থাকত? ভালোবাসায় নিজেকেই ভুলে যেত? শ্রদ্ধায় ব্যাকুল হয়ে পড়ত? নাকি আপনার কাছ থেকে সরতেই চাইত না কোনোদিন? আর অই যে মেঘদল যারা আপনাকে ঢেকে রেখেছিল, সেই যে সাহাবী গাছ যে আপনাকে ছায়া দিয়েছিল। আমি তো তাদের মতো এত সোভাগ্যবান হতেও পারলাম না, হায়!। আমি তো ধুলিও হতে পারলাম না সেই পথটির যার মধ্য দিয়ে আপনি রোজ হেঁটে যেতেন, প্রিয়।
সমস্ত পথে মাইন পাইতা রাখছ
তোমার সুন্দর মুখ দেখলে আমার তৃষ্ণা বেড়ে যায়।
আমি গলাকাটা মোরগের মতো লাফাইতে থাকি!
আমার সমস্ত শিরদাঁড়া বেয়ে নাইমা আসে জলডোরা সাপ।
যেন আমি রক্তে বিষ নিয়ে ঘুরতেছি হাজার বছর!
তোমার মুখের দিকে তাকাইলে
আমার আল্লার কথা মনে পড়ে।
যেন আমার গুনাহ হইতেছে,
যেন আমি হাসরের ময়দানে
দাঁড়াইয়া হিসাব দিতাছি।
আমি বলতেছি, ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি!
আমি বলতেছি, ইয়া আল্লাহ আমাকে মাফ করো।
এই চাঁদমুখ দেখাইয়া তুমি কি আনন্দ পাও?
একি শাস্তি দাও! একি আগুনের গোলা ছাড়ো?
আমি যেন কারাকুম মরুভূমিতে নিঃসঙ্গ মজনু!
আমি মরুদ্যানের বালুতে পিঠ দিয়া লাইলির চোখ দেখি।
যেন আমাকে পাগল বলে তাড়াইয়া দেবে রাফহার জনগণ।
বাচ্চারা পাথর ছুঁড়ে দেবে, আর বলতে থাকবে,
ওই যে কায়েস পাগল।
আমার নিজের ছায়া যেন আমার চলন্ত জেলখানা।
যেন কুয়ার ভেতর ইউসুফ নবির পরীক্ষা
যেন সুন্দরের কারাগারই আমার নিয়তি।
আমাকে কি তুমি কবুল করবা না ওগো দূরদেশি?
তুমি কি কেবলি ইল্যুশন, তূর পর্বতের কাছে
অপেক্ষারত রাখালের মরীচিকা? দেখছে— সামনে গুল্মলতা
সামনে উদ্দাম আঙ্গুরের বন। কিন্তু কাছে গিয়েই মিলছে
ট্রাভেলারদের সাদাকালো হাড়।
আমি যেন সেই ভাগ্যহত এক দেশহীন নাগরিক
যার সামনে তোমাকে ছাড়া আর কোনো জেলখানা নাই।
অথচ সমস্ত পথে তুমি মাইন পাইতা রাখছ!