আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান এবং জনপ্রিয়তার বিপদ
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২১
জনপ্রিয়তার একটা হেজেমনিক দিক আছে। এই সেলিব্রিটিজমের একটা আধিপত্যমূলক চরিত্র আছে। ফলে এর বিপরীতে সবসময় একটা বিরোধিতা বা প্রতিরোধের ধারা থাকে। এমন কোনো পপুলারিজম বা সেলিব্রেটিজম সম্ভব নয়, যার বিরোধীপক্ষ নাই। জনপ্রিয়তার এই খেসারত অপরের কাছ থেকে কিছু ক্ষেত্রে নজরদারি, আর কিছুক্ষেত্রে শত্রুতা বা ঈর্ষা আকারে হাজির থাকে।
একজন বক্তা বা লেখকের যখন অসংখ্য ভক্ত তৈরি হয়, তখন যে ধরনের লেখা বা বক্তব্যের কারণে সে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, ওই ধরনের লেখা বা কথা উৎপাদনেই সে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে, ক্রমাগত। ফলে বক্তা ও শ্রোতা, লেখক ও পাঠক উভয়েই একটা বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভক্তদের নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধ সমর্থন বক্তা বা লেখককে আত্মবিশ্বাসী ও তোয়াক্কাবিহীন করে তোলে।
ফলে ওই বক্তা বা লেখকের আত্মবিকাশ ও আত্মোন্নতির সম্ভাবনা হ্রাস পায়। পাঠ, ধ্যানমগ্নতা ও চিন্তার নিবিষ্টতায় ঘাটতি হওয়া তার জন্যে এক অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। জনপ্রিয় ব্যক্তির উচিত তার নিজের জনপ্রিয়তাকে সন্দেহ করা। আর ভক্তদের প্রশংসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে খুব সুবিবেচনাপ্রসূত বা সুচিন্তিত হয় না, সেটা মনে রাখা।
কথাগুলো মনে হলো সম্প্রতি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একজন বক্তা আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানের কথা মনে করে। অত্যন্ত স্মার্ট। পরিষ্কার ও মান বাংলায় চমৎকার বাকভঙ্গিতে কথা বলেন তিনি। প্রস্তুতি নিয়ে, গুছিয়ে, বিষয়ের মধ্যেই থেকে টু দ্য পয়েন্টে কথা বলেন। উচ্চারণে আভিজাত্য স্পষ্ট। প্রচলিত ওয়াজের ভঙ্গি তার নয়। অল্প বয়স, এখনকার অনেক জনপ্রিয় লেখক-বক্তাগণের মতোই।
কোরাআনের আয়াত ও হাদিসের আরবি এবারতও আনেন বক্তৃতায়। অত্যন্ত মুখলিসই মনে হলো তাকে। তার সাত-আটটা বক্তব্য শুনলাম। তার ইউটিউব চ্যানেলে বক্তব্যগুলোকে পাবলিক লেকচার বা জুমা`র খুতবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার প্রায় সবগুলো বক্তৃতাই ভালো লেগেছে। তার উপর তিনজন ব্যক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। আমাদের দেশের মুফতি কাজী ইব্রাহিম ও মুফতি হারুন ইজহার এবং ত্রিনিদাদের ইমরান নযর হোসেন।
এই ফাঁকে বলে রাখি, ওয়াজ শোনায় আমার অভিজ্ঞতা স্বল্পদিনের। আখেরি যমানার আলামত নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন মুফতি কাজী ইব্রাহিম। ইমাম মাহদীর আগমন, কিয়ামতের আসন্নতা নিয়ে তার হাদিসভিত্তিক ব্যক্তিগত গবেষণা আছে। আমাদের খাদ্যব্যবস্থায় পরিবির্তন আনতে হবে, কৃষিভিত্তিক জীবন ও অর্থনীতিতে আমাদের ফিরে যেতে হবে, এমন অনেক বক্তব্য মাওলানা ইব্রাহীমের বক্তব্যে পাওয়া যাবে। তবে এসব বিষয় ত্বহা আদনানও বলছেন তারুণ্যকে উদ্দেশ্য করে, খুব জোর দিয়ে, বেশ কনফিডেন্ট ও কনভিন্সিং ভঙ্গিতে।
কাজী ইব্রাহিম যেভাবে ব্যক্তি উল্লেখ করে, খাস করে অনেক কথা বলার ঝুঁকি নিয়েছেন, ত্বহা তেমনটা নেননি। আবার, জমাহবদ্ধ হওয়ার কথা, এক আমির প্রসঙ্গ, গ্লোবালি রিবা, শিরক ও যিনার বিস্তার ইত্যাদিকে যে গুরুত্ব দিয়ে আল্লামা হারুন ইজহার উল্লেখ করেন, ত্বহাও তার অনুসরণে নিজের বক্তব্য হাজির করেন। অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থা বিষয়ে ত্বহা মুহাম্মাদ আদনানের বক্তব্য প্রায় ইমরান নযর হোসেনের মতোই।
পেপার মানির ভয়ংকরতাকে ইমরান নজর তীব্রভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গোল্ড দিনার ও সিলভার দিরহামের প্রয়োজনীয়তাকে কোরান সুন্নাহর দৃষ্টিতে সামনে আনেন। ব্যাংক ব্যবস্থার ফাঁকি তুলে ধরেন। তার প্রায় সবগুলো বইই বাংলায় অনূদিত। বর্তমান যুগে আখিরি যমানার আলামত, এক জমাত-এক আমির, ফিতনার যুগে মুসলিম সম্প্রদায়ের করণীয়, কোরানের দৃষ্টিতে ইজরাইল রাষ্ট্র ও ইব্রাহিমের (আ.) ধর্ম, তোরআন ও হাদিসে সুদের নিষেধাজ্ঞা, অর্থব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ইহুদি খ্রীস্টানমিত্রশক্তির মহাপরিকল্পনা, ইজরাইল রাষ্ট্রের রহস্যময় সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা ইত্যাদি বিষয়ে ইমরান নযর হোসেন লেখেন ও বক্তৃতা করেন।
ইসলামিক স্টাডিজ, দর্শন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হচ্ছে ইমরান নযর হোসেনের একাডেমিক বিচরণক্ষেত্র। বাংলাদেশের ওয়াজ সংস্কৃতিতে বা সভা-সেমিনারে এগুলো সত্যিই স্বল্পালোচিত বিষয়। ইমরান নযরের আলোচিত এইসব বিষয় নিয়ে ত্বহা আদনানের কথাগুলো লকডাউনকালে বেশ জনপ্রিয় হয়। তবে ইমরান নযরের কয়েকটি সমস্যার কথা আলেমগণ বলেন। যেমন: ১. বুখারির কিছু হাদিসকে ইমরান নযর `ফ্যাব্রিকেটেড` মনে করেন। ২. ইয়াজুজ-মাজুজ এরই মধ্যে আবির্ভূত বলে তিনি ব্যাখ্যা করেন। (অ্যাংলো-আমেরিকান-ইজরাইলি জায়োনিস্ট মিত্রশক্তি ও রাশিয়া-পরিচালিত এলায়েন্সে ইয়াজুজ-মাজুজ এরই মধ্যে হাজির বলে তিনি মনে করেন)।
৩. শিয়াদের প্রায় আমভাবে তিনি মুসলিমই ভাবেন। অনেকে তাকে শিয়া মনে করেন বা শিয়া এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলে ভাবেন। যদিও ইমরান নযর নিজেকে সুন্নি ও হানাফিই দাবি করেন। ৪. দাজ্জাল এরই মধ্যে এসে গেছে, সে এখন তার তৃতীয় পর্যায়ে আছে। ইত্যাদি। তবে ইমরান নযরের বিষয়গুলো নিয়ে ত্বহা বক্তৃতা করলেও আকীদাগতভাবে ইমরান নজর ও তার মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়নি। অন্তত যতটুকু শুনেছি তার আলোকে বলতে পারি। জিহাদ বা ইকামতে দীন, খিলাফাহ, উম্মাহর করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে তার ধারণা ও বক্তব্য মুফতি হারুন ইজহারের অনুবর্তীই মনে হয়েছে।
একটা হাদিসের ব্যাখ্যা সে করেনি, শুধু এই কারণে যে নবিজী এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেননি। বক্তব্য শুনে তাকে উপকারী মনে হয়েছে। তার বক্তব্যে আমলেও আগ্রহ জন্মায় বলে মনে হয়েছে। তার দ্বারা বড় খিদমত সম্ভব, ইনশা আল্লাহ। সমস্যা হচ্ছে, অচিরেই তিনি ব্যাপক বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন। কারণ, প্রথমত তিনি একাডেমিক অর্থে আলিম নন, জেনারেল লাইন থেকে আসা। শুনেছি তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স ও মাস্টার্স। আরবি শিখেছেন। পড়ুয়া। দ্বিতীয়ত তিনি তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, প্রভাব রাখতেও শুরু করেছেন।
শুধু ইউটিউবের কল্যাণে তার বক্তৃতার ভিউ বাড়ছে হু হু করে, প্রতিনিয়তই নজর কাড়ছেন অনেকের। অনেকেই তাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করছে বা করবে, ‘সহীহ নিয়তে’ই। নিশ্চিত। এমনটা অনেক জনপ্রিয় ওয়াজেনের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তবে এতে মাঠ আরো ফাঁকা হবে। দরকার খুব দরদি ও বুঝবান কিছু আলেম যারা মহব্বতের সাথে তাকে গাইড করবেন, দরকার হলে নিজের কাছে মাস বা বছরখানেক রেখে আরো দ্বীনি শিক্ষা দেবেন। আমার মতে, তিনি দাঈ থাকার চেষ্টা করলেই ভালো হবে, দ্বীনি নেতৃত্বের চিন্তা করলে এটি অসুবিধাজনক হবে। ত্বহা সাহেবেরও উচিত হবে, জনপ্রিয়তায় আত্মমুগ্ধ হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে না দেয়া, তার চেষ্টা করা দরকার ইলমি ইজাজত নিতে, অভিজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ক্লাসিকাল বইগুলো পড়া।
এটা তার জন্যে সহজ কারণ যেকোনো উস্তাদের জন্যে তার মতো ত্বলিব পাওয়া গর্বেরই, আর দ্বীনি খিদমতের ব্যাপার তো আছেই। তা নাহলে আবু ত্বহা মুহাম্মাদ আদনান বিপদে পড়বেন। এরই মধ্যে শাইখ আবু বকর জাকারিয়া তাকে খারেজি বইলা ফেলছেন। জনপ্রিয়তা বিপদ আনে নিজের ও অপরের। আল্লাহ এই ভাইকে কবুল করুন, সঠিক পথ দেখান। তিনি রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হলে জেনারেল লাইনে আমাদের ছাত্র সমতুল্যও, সেই দাবিতেও তার জন্যে ভালোবাসা ও দোয়া। আরেকটি প্রত্যাশা, তিনি তার বক্তৃতা চালিয়ে যাবেন, কারণ এগুলোর খুব প্রভাব তৈরি হচ্ছে তরুণদের ঈমানে ও আমলে। তবে তিনি যদি তার বক্তব্য ও বক্তব্যের বিষয়কে কোনো ‘বড়’ ও অভিজ্ঞ আলেমকে দেখিয়ে নেন বা পরামর্শ নেন এবং তারপর ইউটিউবে ছাড়েন, তাহলে অসাধারণ ফায়দা হবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক