আবু তাহের সরফরাজের ১৫টি গান
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০২০
৭ মার্চ
ঘাম ঝরছে তপ্ত রোদে সূর্য মাথার ’পর
লক্ষ্য কোটি আমজনতা কাঁপছিল থত্থর।
বাংলা নামের ভূখণ্ডকে করতে হবে মুক্ত
এই চেতনা সবার ভেতর ঘুমন্ত আর সুপ্ত।
সেই চেতনা জাগিয়ে দিল শেখ মুজিবের হাঁক
সবার বুকে ঢেউ দোলালো মাতৃভূমির ডাক।
সেদিন, প্রতিবাদের ভাষা পেল বাঙালির অন্তর।।
জয় বাংলার উঠল ধ্বনি আকাশে বাতাসে
সেই ধ্বনিতে হানাদারের বুক যে কাঁপে ত্রাসে।
রেসকোর্সে শোনান মুজিব নতুন দিনের পদ্য
এই কবিতা বাংলা এবং বিশ্বে অনবদ্য।
বাংলাদেশের স্বপ্নপুরুষ সব বাঙালির পিতা
লাল-সবুজের পতাকা আর দিলেন জাতীয়তা।
এখন, স্বাধীন দেশে মুক্ত হাওয়া পাখির কলস্বর।।
প্রভাতফেরি
খুব ভোরে আজ পাখির শিসে প্রভাতফেরির গান
রক্তপলাশ শিমুলফুলে ফাল্গুনের আহ্বান।
শব্দে লিখি পাখির ভাষা গাছ ও হাওয়ার ছন্দ
খুব নীরবে গোলাপ ফোটে সেই ভীরু আনন্দ।
আনন্দ ঢেউ হাওয়ার বুকে ধরলো সুরের তান।।
বাংলাদেশের নদীর ঢেউয়ে বাংলা ভাষার শব্দ
বর্বরেরা এই ভাষাকে করেছিল জব্দ।
রক্তরাঙা ফেব্রুয়ারি রক্তস্নানে ধন্য
প্রভাতফেরি ফুলপাখিদের শহিদ ভাইয়ের জন্য।
রক্তরঙে টুকটুকে লাল পলাশ ফুলের ঘ্রাণ।।
স্বপ্ন ফেরিঅলা
স্বপ্ন ফেরিঅলা তোমার স্বপ্ন কিনে নিলাম
স্বপ্ন দেখে দিন কাটাবো হবো না আর গোলাম।
এই শহরের স্বপ্নগুলো হয়ে গেছে বাসি
স্বপ্ন দেখার অপরাধে দিচ্ছে গলায় ফাঁসি
সবুজ স্বপ্ন খুঁজতে এসে তোমার স্বপ্ন পেলাম।
রাষ্ট্রযন্ত্র গণতন্ত্র দিচ্ছে স্বপ্ন বলি
তোমার স্বপ্ন নিয়ে এখন হচ্ছে দলাদলি
পুঁজির তন্ত্রে স্বপ্ন তোমার হচ্ছে দেখো নিলাম।
কাস্তে-হাতুড়ি
কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা
পোস্টার দিয়ে ঢাকা
বাংলার অলিগলি
এক ঠায় সব শ্রমিক-কৃষক
দেখছে দাঁড়িয়ে এতদিনে ঠক
সুদজীবীদের বলি।
পুঁজিবাদী সুদে পণ্যবাজার
আমাদের দেশ করেছে সাবাড়
এবার, নিজের মাটিতে নিজেদের শ্রমে
জীবনের অঞ্জলি।।
সরকারি খাতে শিল্পের কল
কার ইশারায় হচ্ছে বিকল
এবার, সব মানুষের দাবি আদায়ের
সংগ্রামে পথ চলি।।
মানুষ এখন কাঁদছে
মানুষ এখন কাঁদছে দ্যাখো শুভবোধের অভাবে
দেখতে মানুষ হলেও যন্ত্র বসানো তার স্বভাবে।
যন্ত্র আবিষ্কারক মানুষ নিজেই যে আজ যন্ত্র
যান্ত্রিকতায় বদলে গেছে মহান মানবতন্ত্র।
মানুষ হয়েও নেই মানবিক
যন্ত্রদানব অস্বাভাবিক
অনুভূতিশূন্য হৃদয় ঢেউ তোলে না সেভাবে।।
অর্থনীতি সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির মন্ত্রে
নিষ্পেষিত মানুষ এখন পুঁজির গণতন্ত্রে।
সবকিছুতেই শোষণনীতি
হারাচ্ছে তাই মানুষ রীতি
যন্ত্র কোরে তুলছে হৃদয় যান্ত্রিকতার প্রভাবে।।
নির্জনতার গান
ঘাটে ঘাটে নৌকা ভেড়ে সূর্য ডোবে
সন্ধে এলো, সন্ধে এবার রাত্রি ছোঁবে।
নির্জনতার আদিমতা চরাচরে
অন্ধকারে জোনাক জ্বলে থরে থরে
শূন্যে হাওয়া মুখর হলো ভাষার লোভে।
চাঁদের নদী চাঁদের পাহাড় ঘুরে ঘুরে
ঘুমপরি গায় ঘুমপাড়ানি সুরে সুরে
ধরিত্রী মা শিশিরে তার মুখটি ধোবে।
হাওয়ার বাড়ি
হাওয়ার ওপর হাওয়ার বাড়ি
তার ভেতরে পুরুষ-নারী
খেলতেছে খেলা
জগৎজুড়ে জগৎপিতা মেলেছেন মেলা।
নাগরদোলায় দুলছে হৃদয় শরীর কাঁপে তিরতির
এক শরীরের উত্তাপে হায় কাঁপে আরেক শরীর।
দুই শরীরের বোঝাপড়া
সৃষ্টিগত পরম্পরা
মনের ঘরের দরজায় তবু ঝুলছে সোনার তালা।।
মেলার শেষে ভাঙাহাটের উড়ছে ধুলো হাওয়ায়
কী যেন এক হাহাকারের হাওয়া ঘরের দাওয়ায়।
শূন্য হৃদয় পুরুষ-নারী
বসত করে হাওয়ার বাড়ি
পরস্পরের দীর্ঘশ্বাসে ভাঙে প্রণয় খেলা।।
হাওয়ার বাড়িঘর
হাওয়ার ওপর যত্ন কোরে হাওয়ার বাড়িঘর
ঘর ভালো বেঁধেছেন কারিগর।
সেই ঘরে যে বসত করে
আয়নায় তার রূপ না ধরে
রূপ সনাতন আজব কারিগর।।
নকল হাটের লেনাদেনা
আসল মানুষ যায় না কেনা
হাট মহাজন আজব জাদুকর।।
কালো-ধলা যারেই চিনি
সবার ভেতর বিরাজ তিনি
হাওয়ায় কাঁপে হাওয়ার বাড়িঘর।
আসল কিনি নকল কিনি
সব কিছুরই জামিন তিনি
সকল হাটেই একই যে তার দর।।
পাগলা সাঁই
ওরে ও পাগলা সাঁই
ক্যামোনে ঘুরতে যাই
অচিন দেশে
আমারে না চিনলাম আমি
চিনল যে সে নামিদামি
অরূপ বেশে।
চারদিকে তোর অথই পানি মাঝখানে এক ফুল
সেই ফুলেরই গন্ধ নিতে প্রাণ করে আকুল।
ডুব দিয়ে সেই ফুল তুলতেই যায় রে আবার ভেসে।।
প্রাণের সুবাস প্রাণেই বহে মন যে বৃন্দাবন
মনের কথা মনের ভেতর খুবই তা গোপন।
গহনে ডুব দিলেই কী আর দাঁড়াবে সে এসে।।
মনের ভেতর মন
মনের ভেতর মন লুকানো
চিনতে তবু পারোনি
চোখের আড়াল আড়াল বলেই
আরেকটা মন ছাড়োনি।
এক নদীতে ডুব দিয়েছি
আর কেউ তা দেখেনি
সেই নদীটা গোপন ছিল
আড়াল তুমি রাখোনি।।
যা ছিল সেই পাতালপুরে
কুড়িয়েছি ঘুরে ঘুরে
আমার সে ধন সহজলভ্য
এই সত্য হায়, বলোনি।।
দেহনদী
তুমি আমার একটা নদী
যাও ভেসে জোয়ারে যদি
তীরে বসে থাকব একা
অনন্তকাল নিরবধি।
ঢেউ ভাঙে ওই দেহে যখন
কাঁপতে থাকি আমি তখন
সাঁতার দিতে ইচ্ছে করে
তোমার দেহের তল অবধি।।
তোমার হাতে হাত রাখিতে ইচ্ছে খুবই প্রাণে
তুমি আমার মনের মানুষ জগৎবাসী জানে।
জলের ঘ্রাণে কলমিলতা
ফুল হয়ে ফুটেছে যথা
সেই কূলে যেই ফুল হয়েছি
ভাঙল দেহে ঢেউয়ের গতি।।
দেহঘর
এক নদীতে ডুব দিল তিন সদাগর
তিরতিরিয়ে কাঁপে নারীর দেহঘর।
মোকাম ছিল আরেক ঘাটে
তিন সদাগর ফন্দি আঁটে
এই নদীতে ডুব দিয়ে রূপ
তুলব নিয়ে আরেক হাটে
ডুব দিয়ে যেই দেখল কুসুম
বৈঠা দিল তার ভেতর।।
পাপড়ি খুলে ধরল নদী
ঢেউ দিতেছে নিরবধি
বৈঠা পেয়ে সঙ্গোপনে
তিরতিরিয়ে কাঁপছে মোদী
বৈঠা দিয়ে জল নামিয়ে
কাঁপছে কুসুম থরো থর।।
রঙমহল
সংসারে যে ফোটায় শত রঙের হৃদকমল
সেই জাদুকর চেনায় মানুষ আসল আর নকল
কী চমৎকার সাজাও রঙমহল দয়াল
কী চমৎকার সাজাও রঙমহল।
হাওয়ার ওপর রঙের বাড়ি
তার ভেতরে পুরুষ-নারী
কী বাহারে ঝলমল ঝলমল করে
অন্তরে এক আয়না আছে
মনের মানুষ দ্যাখায় কাছে
আসল রঙে মানুষ সে না ধরে
সুযোগ পেলে বদলে ফেলে মুখোশের আদল।।
একই রূপের হাজার বরণ
রঙমহলের এমন গড়ন
সাধ্য কী আর চিনতে মানুষ পারে
আজ যে আপন কাল তো সে পর
একটি বাড়ি হাজারটা ঘর
পাই কি মানুষ যখন খোঁজে যারে
আড়াল থেকে আরেক মানুষ হয় কিরে বদল।।
হলুদিয়া পাখি
হলুদিয়া পাখিরে আমার উড়াল দিল বনে
শতেক বৃক্ষে নীড় বান্ধিল নিশি সঙ্গোপনে।
পুষ্পরথি জাতক কুমার তৃষ্ণানদীর বাঁকে
ময়ূরাঙ্ক্ষী নাও সাজাইয়া রাধার তরে জাগে
শীত কুয়াশায় হয় রে সিনান দেহ মন্থনে।।
প্রকাশিল নিঝুম চন্দ্র শঙ্খনদীর টানে
পাখিমুগ্ধ বয়েস আমার কাটিল বিজনে
প্রাণের দোসর নাই রে প্রাণে অন্তরাত্মা জানে।।
তামাশা
আমরা যদি বেগুনি রঙের তামাশা হয়ে যাই
বেগুনখেতে সবুজরঙে ফুটব আবার সাঁই।
আমরা তো ভবে হেঁটে আর হেঁটে
দেখতেছি লীলা, পুথিটুথি ঘেঁটে
কেউ কেউ স্বয়ং
ছেড়ে যায় অহং
তার দ্যাখা প্রভু যেন ভবে পাই।।
বাঁধা আছে ভবে রীতি আর নীতি
মানুষের যা, তাই তার স্মৃতি
জগতের বাইরে
জ্ঞান কারো নাইরে
অনুমানে কত কথা লিখে যাই।।