আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘মানুষের মানবীয় প্রকৃতি’

প্রকাশিত : নভেম্বর ০১, ২০২০

পৃথিবীতে তোমরা কিছুকাল অবস্থান করবে। এবং সেখানে তোমাদের বেঁচে থাকার জন্য রয়েছে ভোগসম্পদ। (সূরা বাকারা ৩৬)

পৃথিবীর আরসব প্রাণীর মতো মানুষও জগৎ-সংসারে বেঁচে থাকতে চায়। এজন্য প্রকৃতিতে সবরকমের আয়োজন রয়েছে। প্রকৃতিতে রয়েছে অক্সিজেন, যা প্রতিটি নিশ্বাসে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখছে। শরীর গঠনের জন্য আমাদের খাবার দরকার। এজন্য সৃষ্টিকর্তা খিদে সৃষ্টি করে রেখেছেন। খাবারের জন্য প্রকৃতিতে দিয়েছেন ফলমূল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি। জলাশয়ে রয়েছে মাছ। মাছ শিকার করার বুদ্ধি সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন। কীভাবে চাষাবাদ করে নিজের জন্য খাবার তৈরি করে নিতে হবে, সে বুদ্ধিও তিনি মানুষকে দিয়েছেন।

সংসারে প্রতিমুহূর্তে রয়েছে নানা রকম বিপদ-আপদ। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ বিপদ-আপদ দেখেশুনে চলে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করে। কাঁচা ঘরবাড়ি টেকসই করতে চেষ্টা করে। যেখানে ভয়ের কিছু আছে, সেখানে সে যায় না। সতর্কতার এই অনুভূতি সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রবৃত্তিতে দিয়েছেন। এরকম অনুভূতি আমাদের না থাকলে বেঁচে থাকায় মুশকিল হয়ে পড়ত। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার পোশাক, ঘরবাড়ি ও হাতিয়ার। এসব তৈরির উপাদানও রয়েছে প্রকৃতিতে। শীতের প্রকোপ থেকে মানবদেহ সুরক্ষার জন্য প্রাকৃতিকভাবে শরীওে লোম সৃষ্টি হয় না। কিন্তু মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে প্রকৃতির উপাদান ব্যবহার করে নিজের দরকারমতো পোশাক তৈরি করে। বসবাসের জন্য নির্মাণ করে ঘরবাড়ি। এক এক কাজের জন্য এক এক রকম হাতিয়ার তৈরি করে মানুষ প্রকৃতি থেকেই তার দরকার মিটিয়ে নেয়। এসব কৃৎকৌশল সৃষ্টিকর্তাই মানুষের ভেতর দিয়ে দিয়েছেন।

প্রতিমুহূর্তে আমাদের মনের ভেতর হাজারও ভাবনা উদয় হচ্ছে। এর মধ্যে কোনোটা কাউকে কখনো আমরা বলতে পারি না। বললে মানুষের মধ্যে সর্ম্পক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার, এমন কিছু ভাবনা আছে যা আগেভাগে বলে ফেললে ভাবনার বাস্তবায়নে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এসব কারণে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এসব ভাব ও ভাবনা নিজের ভেতর গোপন রাখার ইচ্ছেশক্তি দিয়েছেন।

মানুষ মূলত স্থিতিশীল প্রাণী। বারবার সে আবাসভূমি বদল করে না। তা যদি করতো তাহলে সাংসারিক জীবনসহ রাজ্যশাসন ও সভ্যতার অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হতো। পারিবারিক ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা থাকতো না। এজন্য সৃষ্টিকর্তা মানুষকে স্থিতিশীল প্রাণী হিশেবে সৃষ্টি করেছেন।

জন্মগতভাবেই মানুষ আত্মসচেতন। কিসে তার ভালো হবে, কিসে তার উন্নতি ঘটবে, এ ব্যাপারগুলো তার ভেতর থেকেই জন্ম নেয়। কোনো মানুষ আরেক মানুষের অধীনে শৃঙ্খলিত হয়ে বাঁচতে চায় না। ব্যক্তিগত এই স্বাধীনতাবোধ নিয়েই প্রতিটি মানুষ জন্মগ্রহণ করে।

মানুষের এইসব মানবীয় প্রবৃত্তি পৃথিবীতে তার সুখভোগের সহায়ক। এসব প্রবৃত্তি যদি মানুষ যথেচ্ছ ব্যবহার করে, তবে তা সুখের বদলে তার জীবনকে করে তুলবে দুঃখময়। খাবারের কথাই ধরা যাক। মানুষের শরীর গঠন ও শক্তির যোগান দেয় খাবার। প্রকৃতিতে এসব খাবারের অভাব নেই। মানুষ একটু চেষ্টা করলেই তার খাবার যোগাড় করে নিতে পারে। তবে অল্প কয়েকটি খাবার আছে, যা মানুষের দেহ ও মনের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো সৃষ্টিকর্তা মানুষকে খেতে নিষেধ করেছেন। মৃত পশুর মাংস এবং মদ ও গাঁজা এরকম খাদ্যবস্তু। স্বাধীনতা মানুষের একটি মানবীয় প্রবৃত্তি। কিন্তু মানুষ যদি এ প্রবৃত্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করে সৃষ্টিকর্তার নিষেধ অমান্য করে মাদক সেবন করে, তাহলে তার শারীরিক ক্ষতি দেখা দেবে। মানসিক অবস্থাও হয়ে পড়বে অস্বাভাবিক। আমরা জানি যে, সিগারেটে থাকা নিকোটিন ক্যানসারের প্রধান কারণ। এরপরও আমরা আমাদের দেহে এই নিকোটিন টেনে নিচ্ছি ধোঁয়ার মাধ্যমে। এভাবেই আমরা আমাদের স্বাধিনতার অপব্যবহার করি। এর ফলও আমরা হাতেনাতে পেয়ে যাই।

আত্মমর্যাদা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু কেউ যদি আরেকজনের আত্মমর্যাদাকে ছোট করে, তবে তা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। মানুষের যতগুলো মানবীয় প্রবৃত্তি আছে, সবগুলোর স্বাভাবিক ব্যবহারই সৃষ্টিকর্তার কাম্য। প্রকৃতির নিয়মও এটা। কেউ যদি এসব প্রবৃত্তির অস্বাভাবিক ব্যবহার করে, তবে তার ফল তাকেই ভোগ করতে হয়। প্রবৃত্তির অস্বাভাবিক ব্যবহারে কোনো জাতি যদি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব সেই জাতির প্রতিটি মানুষের ওপর পড়ে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক