আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর জন্মকথা’

পর্ব ১

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২১

যার কোলে দিন কাটে খেলায়
রাত কাটে ঘুমঘোরে
বল তো খোকা এই পৃথিবী
তৈরি ক্যামন কোরে!

তাই তো! এই যে দেখছি চারপাশ, লোকজন, ঘরবাড়ি, নদীনালা, সাগর, পাহাড়... কত্ত আরো নানা কিছু। এসব নিয়েই তো আমাদের পৃথিবী। সুজলা আর সুফলা। এই পৃথিবীর বুকে আমাদের বসবাস। এই মাটির বুকেই তো আমরা জন্ম নিই। এরপর বেড়ে উঠি বাবা-মায়ের পরম আদরে, আশ্রয়ে। সারাদিন খেলে বেড়াই, আর রাত হলে মায়ের বকুনি খাই। ঘুমানোর সময় আবার ঠিকই আম্মুর বাহুডোরে মুখ লুকোই। পৃথিবীও আমাদের মা। এই পৃথিবীর বুকেই তো আমরা জীবন কাটাই। পৃথিবীর মাটিতে জন্ম নেয়া গাছপালার ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকি। এই মাটি আমাদের আরামের আশ্রয়।

এই পৃথিবীটা কোত্থেকে এলো? জিগেশ করলে বলবে, আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আরো বলবে, আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করে এখানে গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়, নদী, আকাশ সৃষ্টি করেছেন। আমাদেরকেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। শুধু পৃথিবী নয়, এই যে চাঁদ, সূর্য, রাতের আকাশে দ্যাখা জ্বলজ্বলে অসংখ্য নক্ষত্র, এরসবই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর বুকে গাছপালা, নদনদী, পাহাড়, আলো-বাতাস, এইসবও আল্লাহর সৃষ্টি। পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি, শুধু এইটুকু জেনেই বসে থাকতে নিশ্চয়ই তোমার মন চাইছে না। আল্লাহ কিভাবে, কি কি দিয়ে এই পৃথিবী তৈরি করলেন, এটাও যে জানতে মন চাইছে। মানুষের স্বভাবই আসলে এরকম। যা সে জানে না, তা  সে জানতে চায়। এ জানায় আছে আনন্দ। গভীর আনন্দ। এই আনন্দ কিন্তু পশুপাখির নেই। কারণ চারপাশের পরিবেশ ও পৃথিবী বিষয়ে তাদের জানার কোনো আগ্রহ নেই। তাই, জানার আনন্দও নেই। অজানাকে জানার চেষ্টা যে মানুষ করে, সে-ই আসল মানুষ। জ্ঞানী মানুষ। গরু-ছাগলের মতো খাওয়া আর ঘুমানো মানুষের স্বভাব নয়। অথচ মজা দ্যাখো, আমাদের চারপাশের মানুষজন কেউই অজানাকে জানার চেষ্টা করে না। টাকা আয়ের জন্য দিনভর কঠোর পরিশ্রম করছে, আর রাত হলে ভুসভুস করে ঘুমোচ্ছে।

তা ঘুমোক। আমরা ওদের মতো বিশ্বজগৎ বিষয়ে উদাসীন নই। অজানাকে আমরা জানতে চাই। আর তাই, আজ তোমাদের পৃথিবীর গল্প শোনাবো। পৃথিবী কিভাবে তৈরি হলো, এটা জানতে হলে আগে জানতে হবে সূর্য ও তার পরিবার বিষয়ে। কেননা, সূর্য থেকেই পৃথিবীর উৎপত্তি।

পূব আকাশ রাঙিয়ে সোনার থালার মতো সূর্য ওঠে। ঝলমলে আলোয় ভরে যায় পৃথিবী। ভোর হয়। পাখিরা ডেকে ওঠে কিচিরমিচির। জেগে ওঠে মানুষ। কৃষক যায় ক্ষেতে চাষ দিতে। শ্রমিক ছোটে কারখানায়। যার যে কাজ, মানুষ ছড়িয়ে পড়ে সে কাজে। পূব থেকে পশ্চিমদিকে একসময় সূর্য ঢলে পড়ে। গোধূলির রঙ ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমের আকাশজুড়ে। কিচিরমিচির করতে করতে পাখিরা ফিরে আসে নীড়ে। কাজ থেকে মানুষ ফেরে যার যার বাড়ি। রাত হয়। অন্ধকারে ঢেকে যায় পৃথিবী। কোথায় লুকোলো সূর্য? রাত শেষ হলে কোত্থেকেই বা সে পূব আকাশ রাঙিয়ে আবার ওঠে? ভাবনার বিষয়। এই ভাবনা যুগে যুগে ভেবে এসেছে মানুষ। তোমরাও ভেবেছো নিশ্চয়ই।

মা-বাবা ও ভাইবোন নিয়ে আমাদের যেমন একটা পরিবার আছে, সূর্যেরও এরকম একটা পরিবার আছে। সূর্যের এই পরিবারকে বলে সৌরজগৎ। সৌরজগতের মাঝখানে অবস্থান করছে সূর্য। তাকে মাঝখানে রেখে চারদিক দিয়ে শূন্যের ওপর ঘুরছে সৌর পরিবারের নয়টি সদস্য। সূর্যের এই নয়টি সদস্যদকে বলে গ্রহ। সূর্য বিশেষ একটি আকর্ষণে গ্রহগুলোকে নিজের দিকে টেনে ধরে রেখেছ। এই আকর্ষণের নাম মাধ্যাকর্ষণ। সূর্য থেকে দূরত্ব অনুসারে সৌরজগতের গ্রহগুলো হচ্ছে: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। এই নয়টি গ্রহেরও আবার পরিবার আছে, তবে তা সূর্যের মতো বড় নয়।

গ্রহদের পরিবার হচ্ছে ছোট পরিবার। গ্রহদের পরিবারের সদস্যকে উপগ্রহ বলে। বুধ ও শুক্র গ্রহের কোনো উপগ্রহ নেই। পৃথিবীর একটি উপগ্রহ রয়েছে, যাকে আমরা চাঁদ বলি। মঙ্গল গ্রহের উপগ্রহ দুটো, ফোবোস ও ডিমোস। বৃহস্পতির ৭৯টি, শনির ৫৩টি, ইউরেনাসের ২৭টি, নেপচুনের ১৩টি এবং প্লুটোর পাঁচটি উপগ্রহ রয়েছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের ভ্রমণপথের মাঝামাঝি আকাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহাণু রয়েছে। দূরত্ব ও গতির কমবেশির কারণে এদের সবারই নিজ নিজ ভ্রমণপথে সূর্যকে ঘুরে আসার সময়ের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। গ্রহগুলোর প্রত্যেকের গতি ও ভ্রমণপথের দূরত্ব ভিন্ন ভিন্ন। যে সময়ের মধ্যে পৃথিবী সূর্যকে একশোবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পারে, সে সময়ে সূর্য থেকে দূরের কোনো গ্রহ সূর্যকে মাত্র একবার প্রদক্ষিণ করতে পারবে।

পৃথিবীর উপগ্রহ হচ্ছে চাঁদ। পৃথিবী ও আরসব গ্রহের মতো চাঁদও যে সূর্যের চারদিকে সমানে ঘুরতে থাকে, তা কিন্তু নয়। চাঁদ একদিকে যেমন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, একইসঙ্গে পৃথিবীকেও প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সূর্য হচ্ছে গনগনে আগুনের জ্বলন্ত একটা পিণ্ড। ধারণা করা হয়, ৪৬০ কোটি বছর আগে সূর্যের উৎপত্তি। সূর্য তার কেন্দ্রভাগে প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে। এই হিলিয়াম থেকেই তৈরি হয় তাপ, যা সূর্য থেকে মহাশূন্যে অবিরত ধারায় ছড়িয়ে পড়ছে। শূন্যের ওপর সূর্য কিন্তু স্থির নেই। ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে নয়টি গ্রহসহ সূর্য বিরামহীন ঘুরে চলেছে। কেন্দ্রের চারদিক দিয়ে একবার ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে ২২৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর।

তোমাদের কাছে মনে হতে পারে, পৃথিবীটা অনেক বড়। বিশাল বড়। কিন্তু সত্যি যে, মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর আকার একটা বালু কণার কয়েক কোটি ভাগের একভাগ মাত্র। তাহলেই ভেবে দ্যাখো, মহাবিশ্বে কত ক্ষুদ্র আমাদের এই পৃথিবী! আমাদের মাথার ওপর যে আকাশ, তার কোনো শেষ নেই। শুরুও নেই। রাতের আকাশে জ¦লজ¦ল করে জ্বলতে থাকে অসংখ্যা তারা বা নক্ষত্র। এসব নক্ষত্র আসলে প্রত্যেকটি এক একটি সূর্য। মহাকাশে এরকম সূর্য রয়েছে কোটি কোটি, হাজার হাজার মিলিয়ন। এর সংখ্যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের সূর্যের মতো ওইসব সূর্যকেও মাঝখানে রেখে চারদিক দিয়ে শূন্যে ঘুরছে গ্রহরা। আবার, গ্রহদের নিয়ে ওই সৌরজগতের সূর্যও ঘুরছে সীমাহীন মহাকাশে। প্রতিটি সূর্য ও গ্রহগুলোর রয়েছে একটা নির্দিষ্ট ভ্রমণপথ। নিয়ম মেনে সে পথে ঘুরে চলেছে প্রতিটি সৌরজগতের সূর্য ও গ্রহরা। এসব সূর্যের একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব কোটি কোটি কিলোমিটার।

মহাবিশ্বের জায়গা বা স্পেস ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। মহাবিশ্বে সূর্যগুলোর মধ্যেকার দূরত্বও বেড়ে চলেছে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মহাবিশ্বের প্রতিটি পদার্থকে একে অন্যের দিকে টেনে ধরে রেখেছে। একইসঙ্গে মহাবিশ্বে মহাবিকর্ষণ শক্তিও কাজ করে চলেছে। পদার্থগুলো কাছাকাছি থাকলে মাধ্যকর্ষণ শক্তির টান কার্যকর থাকে। আবার, পদার্থগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেলে মহাবিকর্ষণ শক্তি অবিরাম তাদেরকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে। এ কারণেই বেড়ে চলেছে মহাবিশ্বের স্পেস।

মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সূর্যের তুলনায় আমাদের সূর্যটা আকারে খুবই ছোট। অসংখ্য সূর্যের কোনো একটা সূর্য যদি পাহাড়ের মতো হয়, তবে আমাদের সূর্যটা তার নিচে একটা মার্বেল। রাতের আকাশে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা অসংখ্য সূর্যকে বিন্দুর মতো দ্যাখার কারণ, পৃথিবী থেকে তারা অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। এত দূরে যে, তা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার। কী বিশাল দূরত্ব, ভাবতে পারো! এই দূরত্বেই যদি সূর্যকে আমরা একটা থালার মতো দেখতে পাই, তাহলে সীমাহীন মহাকাশে এরচেয়েও বৃহৎ যেসব সূর্য রয়েছে পৃথিবী থেকে সেগুলো কতটা দূরে, তা বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না।

এবার তাহলে বুঝতে পারছ, বিশ্বজগতের যে বিস্তৃতি সেখানে আমাদের পৃথিবী একটা বিন্দুর চেয়েও অনেক অনেক ক্ষুদ্র। বলতে গেলে কিছুই নয়। অথচ দ্যাখো, আমাদের কাছে পৃথিবীটা কত বিশাল বলে মনে হয়! পৃথিবীকে সাধারণত কমলালেবুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। কমলালেবুর খোসা যেমন তার বাইরের সীমা, তেমনই পৃথিবীর বাইরের সীমা একশো মাইল গভীর বাতাসের সমুদ্র। এই বাতাস আসলে পৃথিবীর আবরণ। পৃথিবী যেমন হেলানোভাবে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকে, এই বাতাসের সমুদ্রও পৃথিবীর সঙ্গে ঘুরতে থাকে। গভীর সমুদ্রের তলদেশে যেমন অনেক প্রাণীর বসবাস, আমরাও তেমনভাবে বাতাসের এই গভীর সমুদ্রের নিচে বসবাস করছি। সমুদ্রের তলদেশের প্রাণীরা কখনো সমুদ্রের ওপরে এসে বেঁচে থাকতে পারে না। একইভাবে এই বায়ুসমুদ্রের ওপরে উঠে আমরাও বেঁচে থাকতে পারি না। আকাশযানে চড়ে মানুষ পৃথিবী থেকে যত ওপরে উঠতে থাকে, বায়ু তত পাতলা ও ঠাণ্ডা বোধ হতে থাকে। বেশি ওপরে উঠলে বাতাসের অভাবে মানুষ শ্বাস নিতে পারে না, এবং ঠাণ্ডায় কুকরে যায়।

বিশ মাইলের ওপর নামমাত্র বাতাস থাকে। মাটি থেকে চার মাইল ওপরে কোনো পাখিই উড়তে পারে না। তবে শোনা যায়, শকুনজাতীয় কনডোর পাখি খুবই কষ্টে চার মাইল ওপর পর্যন্ত উড়তে পারে। বিমানে চড়ে মানুষ সাত মাইল পর্যন্ত ওপরে উঠতে পারে, তবে তাতে প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট হয়। চলবে