আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘পদার্থের পরিমাপ ও একক’

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২৩

পদার্থের জগৎ
আমাদের চারপাশে এই যে বিশ্বপ্রকৃতি, তা খুবই বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্য দুইভাবে উপলব্ধি করা যায়। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে এবং বৃহৎ থেকে বৃহৎ পর্যায়ে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে উপলব্ধির মানে হলো, কোনো পদার্থকে ভেঙে পাওয়া যায় অণু। অণু ভেঙে পাওয়া যায় পরমাণু। পরমাণু ভেঙে পাওয়া যায় স্থায়ী ও অস্থায়ী কণা। কণা ভেঙে পাওয়া যায় কোয়ার্ক। কোয়ার্ক ভেঙে পাওয়া যায় শক্তিগুচ্ছ। বৃহৎ থেকে বৃহৎ পর্যায়ে উপলব্ধির মানে হলো, উপগ্রহ, গ্রহ, সৌরজগৎ, ছায়াপথ, গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল... এরকম আরও কত কী! অনুমান করা হয়, বিশ্বজগতের শতকরা ৪ ভাগ মানুষ জানতে পেরেছে।

 

পদার্থ দিয়ে বিশ্বজগৎ তৈরি। পাঁচটি জ্ঞানের ইন্দ্রিয় দিয়ে বিশ্বজগতের প্রতিটি পদার্থের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। পদার্থের এই জগৎ চারটি উপাদান দিয়ে গঠিত। এগুলো হচ্ছে: স্থান, সময়, ভর ও শক্তি। মাটির ওপর একটি ফুটবল স্থির হয়ে আছে। আমরা চোখ দিয়ে একটি পদার্থ দেখছি। এই পদার্থের ভর আছে। পদার্থটি স্থান দখল করে আছে। মাটির ওপর ফুটবলটি যতখানি স্থান দখল করে আছে, ততখানি স্থান ফুটবলটির আয়তন। পা দিয়ে ফুটবলকে লাথি দাও, মানে বল প্রয়োগ করো। মুহূর্তে সেটার মধ্যে শক্তির সঞ্চার হবে। আর অমনি ফুটবলটি চলতে শুরু করবে। শক্তি যে কোনো পদার্থের ভেতর কাজের প্রেরণা যোগায়। লাথি দেয়ার কারণে ফুটবলটি গতিশীল অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরে যাবে। সময়ের সাপেক্ষে স্থান বদলের এই ক্ষমতা ফুটবলকে যোগাচ্ছে শক্তি।

 

ঘরবাড়ি, বইখাতা, কাগজ-কলম, গাছপালা, গাড়ি, জীবজন্তু যা-কিছুই আমরা দেখি না কেন, সবই পদার্থ। পদার্থের অস্তিত্ব সরাসরি ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু শক্তি সরাসরি ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। পদার্থের মধ্য দিয়ে এদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার, এমন পদার্থও রয়েছে যা আমরা চোখে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করতে পারি। যেমন, বায়ু। বায়ু আমরা দেখতে পাই না ঠিকই, তবে তার অস্তিত্ব সবসময় অনুভব করি। প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইছে। সেই দাপটে বড় বড় গাছ লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। ভেঙে পড়ছে টিনের ঘরবাড়ি। বায়ুর এই দাপট দেখে আমরা ভীত হয়ে উঠি। কখন না জানি কী ঘটে! আবার দ্যাখো, গরমের দিনের ঝিমধরা দুপুর। দরদর ঘাম ঝরছে গা বেয়ে। গাছপালার পাতাও নড়ছে না। হঠাৎ কোত্থেকে এক ঝলক ঝিরঝির বায়ু ছুটে এলো। নড়ে উঠল গাছের পাতা। ঘামে ভিজে ওঠা দেহে যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে গেল। শক্তির অস্তিত্বও আমরা এভাবেই উপলব্ধি করি। চোখ দিয়ে আমরা সরাসরি আলোক শক্তি দেখতে না পেলেও আলোকিত জিনিস দেখতে পাই। আমরা তাপ অনুভব করি ত্বক দিয়ে। আবার, কান দিয়ে সরাসরি শব্দ শক্তির অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি।

 

৮ রূপে প্রকৃতিতে শক্তি বিরাজ করছে। এর মধ্যে কোনো শক্তি সরাসরি ইন্দ্রিয় দিয়ে আবার কোনো শক্তি পদার্থের মধ্য দিয়ে আমরা অনুভব করতে পারি। একই কথা সময়ের বেলাতেও। সময় আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু সময়ের প্রভাব আমাদের সামনে প্রকৃতির সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। পদার্থজগতের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে, পদার্থ, স্থান, সময়, ভর ও শক্তি পরিমাপ করা যায়।

 

পরিমাপ
কোনো কিছুর পরিমাণ নির্ণয় করাকে পরিমাপ বলে। বাজার থেকে তুমি ১ কিলোগ্রাম চিনি কিনে আনলে। এখানে চিনির ভরের পরিমাণ ১ কিলোগ্রাম বা কেজি। তোমার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। এখানে দূরত্ব বা দৈর্ঘ্যরে পরিমাণ ৩ কিলোমিটার। বাড়ি থেকে হেঁটে স্কুলে যেতে তোমার সময় লাগে ৩০ মিনিট। এখানে সময়ের পরিমাণ ৩০ মিনিট।

 

পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা
বিজ্ঞানের সাহায্যে যে জ্ঞান আহরণ করা হয় সেই জ্ঞান নির্ভর করে পরীক্ষার ওপর। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা কতগুলো রাশির পরিমাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় কোনো পদার্থের ভর পরিমাপ করতে হয়। আবার, কোনো পদার্থের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে হয়। নয়তো, কোনো পদার্থ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে কত সময় নিচ্ছে, তা পরিমাপ করতে হয়। কেবল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেই নয়, আমাদের প্রতিদিনের কাজকর্মে পরিমাপ খুবই জরুরি একটি বিষয়। হাট-বাজারে যত রকম কেনাবেচা হয়, সবই পরিমাপের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন করো, দোকানে গিয়ে তুমি বললে, আমাকে অনেক চাল দিন। দোকানি কিন্তু ‘অনেক চাল’ কথাটি শুনে তোমাকে চাল দিতে পারবে না। কিন্তু যখন বলবে, আমাকে দুই কেজি (কিলোগ্রাম) চাল দিন, তখন দোকানি বুঝতে পারবে তুমি কী পরিমাণ চাল কিনতে চাচ্ছ। এখানে কিলোগ্রামকে একক হিসেবে ব্যবহার করে চালের ভরকে বোঝানো হয়েছে। কাপড়ের দোকানে গিয়ে তুমি বললে, আমাকে কাপড় দিন। কিন্তু কী পরিমাণ কাপড়, তা তুমি বললে না। তাহলে দোকানি কিসের ভিত্তিতে তোমাকে কাপড় দেবে? তুমি যদি বলো, আমাকে ৬ গজ কাপড় দিন। তাহলে দোকানি তোমাকে ৬ গজ পরিমাণ কাপড় পরিমাপ করে দিতে পারবে। এখানে গজকে একক হিসেবে ব্যবহার করে কাপড়ের দৈর্ঘ্যকে বোঝানো হয়েছে।

 

আমরা যখন দুধ কিনি তখন দুধের আয়তনের পরিমাণকে লিটার হিসেবে পরিমাপ করি। আবার ধরো, বাসে চড়ে তুমি ঢাকা এলে। বাস থেকে নেমে বললে, ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসতে অনেক সময় লেগেছে। এখানে ‘অনেক সময়’ কথাটি আসলে কিছুই বোঝায় না। কিন্তু যদি বলো, ৪ ঘণ্টা লেগেছে, তাহলে সময়ের পরিমাপ জানা গেল। সময়ের পরিমাপ করতে একক হিসেবে এখানে ঘণ্টাকে ব্যবহার করা হয়েছে। ত্রিভূজের কোণ পরিমাপ করতে ডিগ্রিকে পরিমাপের মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। এইভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রেই যে কোনো কিছু পরিমাপ করতে হয়। পদার্থজগতের যে কোনো কিছু পরিমাপ করতে দুটো জিনিসের দরকার হয়। একটি হলো রাশির মান, আরেকটি হলো একক।

 

পরিমাপের একক
কোনো কিছু পরিমাপ করতে হলে প্রথমেই দরকার একটি একক বা মাপকাঠি। একটা লম্বা লাঠি নিয়ে যদি বলা হয়, এর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করো। কিসের ভিত্তিতে তা করবে? লাঠির দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে হলে দরকার হবে সুবিধাজনক একটি একক বা মাপকাঠি। ফুট স্কেল দিয়ে যদি লাঠির দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, ওই লাঠির দৈর্ঘ্য ৪ ফুট। এখানে ফুটকে দৈর্ঘ্যের একক ধরে আমরা লাঠির দৈর্ঘ্য পরিমাপ করলাম। দৈর্ঘ্য, আয়তন, ক্ষেত্রফল, ওজন, সময়, কোণ, বল, চাপ, শক্তি, তাপ, উষ্ণতা প্রভৃতি পরিমাপ করতে প্রত্যেকেরই এক একটি ভিন্ন ভিন্ন একক রয়েছে। কেননা, সব জিনিসের পরিমাপ পদ্ধতি এক রকম হয় না। কোনোটি গ্রাম, কোনোটি মিটার, কোনোটি লিটার, আবার কোনোটি মিনিট, ঘণ্টা. ডিগ্রি নানা নামে প্রকাশ করা হয়। এই নামগুলোকে পরিমাপের একক বলে। কোনো রাশিকে পরিমাপ করতে হলে ওই রাশির সুবিধাজনক নির্দিষ্ট একটি অংশ নেয়া হয়। নির্দিষ্ট এই অংশকে ওই রাশির পরিমাপের একক বলে। যেমন: ত্রিভূজের বাহুর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে সুবিধাজনক একক হচ্ছে সেন্টিমিটার। কাপড় পরিমাপ করতে সুবিধাজনক একক হচ্ছে মিটার। রাস্তার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে সুবিধাজনক একক হচ্ছে কিলোমিটার।

 

কোনো রাশির মধ্যে ওই রাশির একক যতবার থাকবে, সেই সংখ্যাই ওই রাশির পরিমাপ। মনে করো, একটি লাঠির দৈর্ঘ্য ৭ মিটার। এখানে মিটার হচ্ছে দৈর্ঘ্যরে একক। ৭ মিটার বলতে বোঝায়, ৭টি ১ মিটারের ৭ গুণ দৈর্ঘ্য। মানে লাঠির দৈর্ঘ্যে ১ মিটার আছে ৭টি।

 

আদর্শ এককের গুণাবলি
আদর্শ এককের সাধারণত তিনটি বিশেষ গুণ থাকে। এই তিনটি গুণ হচ্ছে:
১. সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়।
২. সর্বজনস্বীকৃত।
৩. একটি এককের মতো হুবহু আরেকটি একক সহজেই তৈরি করা যায়।

 

পরিমাপের এককের প্রকার
পরিমাপের একক তিন প্রকার। মৌলিক একক, যৌগিক বা লব্ধ একক এবং ব্যবহারিক একক।

 

মৌলিক একক
প্রত্যেক রাশি পরিমাপ করতে একটি একক দরকার হয়। একক ছাড়া কোনো কিছু পরিমাপ করা যায় না। প্রশ্ন উঠবে যে, পদার্থবিজ্ঞানে তো হাজার হাজার রাশির কথা উল্লেখ রয়েছে। সেসব রাশির কি হাজার হাজার একক রয়েছে? জবাব হচ্ছে, না, নেই। কারণ, রাশি অসংখ্য হলেও মৌলিক রাশি রয়েছে তিনটি। এই তিনটি মৌলিক রাশি পরিমাপের একক দিয়ে পদার্থজগতের সকল রাশি পরিমাপ করা যায়। তাই, এই তিনটি রাশির একককে বলা হয় মৌলিক একক। সহজভাবে বলা যায়, যে তিনটি মৌলিক রাশির একক একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল নয় এবং যে তিনটি মৌলিক রাশির একক থেকে যৌগিক রাশির একক গঠন করা যায়, সেই তিনটি একককে মৌলিক একক বলে।

 

যেমন: ক্ষেত্রফল পরিমাপ করতে দৈর্ঘ্যকে প্রস্থ দিয়ে গুণ করতে হয়। দৈর্ঘ্যরে একক যদি ১ ফুট ধরি, তাহলে ১ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট প্রস্থ বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল হবে ১ বর্গফুট। এই বর্গফুটই ক্ষেত্রফল পরিমাপ করার একক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যে একক দিয়ে দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা যায়, সেই একই একক দিয়ে ক্ষেত্রফলও পরিমাপ করা যায়। এক্ষেত্রে, ক্ষেত্রফল পরিমাপ করতে আলাদা কোনো নতুন একক দরকার হয় না।

 

যৌগিক বা লব্ধ একক
যেসব রাশি পরিমাপের একক গঠন করতে এক বা একের বেশি মৌলিক একক দরকার হয়, সেসব একককে যৌগিক বা লব্ধ একক বলে। যেমন: ক্ষেত্রফল (দুটি দৈর্ঘ্যরে গুণফল), আয়তন (তিনটি দৈর্ঘ্যরে গুণফল), বেগ (দৈর্ঘ্য গুণ সময়)। ক্ষেত্রফল, আয়তন ও বেগ রাশি তিনটির একক মৌলিক একক থেকে পাওয়া যায়। এজন্য এই তিনটি রাশির একককে যৌগিক বা লব্ধ একক বলে।


ব্যবহারিক একক
কয়েকটি মৌলিক একক খুব বড় কিংবা খুব ছোট। এ কারণে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাদের ভগ্নাংশ কিংবা গুণিতককে একক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই জাতীয় একককে ব্যবহারিক একক বলে। খুব বড় কোনো কিছু পরিমাপ করতে ব্যবহারিক একক দরকার হয়। যেমন: সিলেট থেকে ঢাকার দূরত্ব পরিমাপ করতে মৌলিক একক হিসেবে কিলোমিটার ব্যবহার করা হয়। ২৭০ কিলোমিটার দূরত্বকে ভগ্নাংশ একক (সেন্টিমিটার বা মিলিমিটার) হিসেবে প্রকাশ করলে পাওয়া যায়, ২৭০০০০০০ সেন্টিমিটার বা ২৭০০০০০০০ মিলিমিটার। এক্ষেত্রে পরিমাপের অঙ্ক আকারে বড় হয়। আবার, খুব ছোট কোনো কিছু পরিমাপ করতে ব্যবহারিক একক দরকার হয়। যেমন: বইপত্র কিংবা কলমের দৈর্ঘ্য অথবা ঘনত্ব পরিমাপ করতে মৌলিক এককের ভগ্নাংশ সেন্টিমিটার বা মিলিমিটার ব্যবহার করা হয়।

 

লেখকের অনুমতি ছাড়া কপিপেস্ট করলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে