আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘যখন আঁধার যখন কুয়াশা’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০
সাঁকোর মুখটায় এসে থমকে দাঁড়ালো নূরি।
সাঁকো কাঁপছে।
নদী কাঁপছে।
চাঁদ কাঁপছে।
ডশরশিরে হাওয়ায় কাঁপছে অন্ধকার।
হেসে ওঠে নূরি। খলবল সে শব্দ মিলিয়ে যায় নদীর ওপর দিয়ে। শেয়াল ডেকে ওঠে কোথাও। সাঁকোর ওপর পা দিয়ে ভেবে পায় না সে, সাঁকো কেন কাঁপে। জলের মাছেরা জানে? কুয়াশায় ভিজে ভিজে রাতবিরেতে যারা আটকে যায় জেলেদের জালে। হাওয়ায় কারা যেন ফিসফিস করে। মাছেরা বোবা, না হলে বলতে পারত, যারা আসে আসে তাদের দ্যাখা যায় না। তারা আসে হাওয়ার ভেতর দিয়ে। চলেও যায় হাওয়ার ভেতর দিয়ে। কোথায় যে যায়, মাছেরাও কিছু বলতে পারে না। তাদের ঘর-গেরস্তির কোনো চিনপরিচয় কারো হদিসে নেই। মাঝরাতে পরাণ জাউলা যখন আসে জালের তদারক নিতে, সেই সাথে জেনে যায় বাকি রাত কী রকম মাছের সম্ভাবনা, সেই পরাণ জাউলাও কি জানে, কেন কাঁপে সাঁকো?
একটা গাছ, অন্ধকার জড়িয়ে-মড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপাড়ে। ডালপালা ছড়িয়ে আরো অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। ঝাপসা দেখা যায়। চোখ ফিরিয়ে নেয় নূরি। তাকায় ওপরে।
এই যে, শুনতেছেন?
মাথার ওপর দিয়ে স্তব্ধতা ঝরে পড়ে। টের পায়, বুঝতে পারে নূরি, এইবার সময় হেেয়ছে।
আহ!
সাঁকোর খুঁটি ধরে বসে নূরি, যেন কোনো ইশারা পেয়েছে সে। ঘূর্ণি হাওয়া ওঠে নদীর ওপর। কুয়াশা ছিঁড়ে ঝরে পড়ে হিম। কেঁপে ওঠে সে। কাঁপে। শীতে। কে যেন ফিসফিস করে। শোনা যায় না, বোঝা যায়।
এই যে শুনতেছেন, আপনে কই?
জলের ভেতর ঘাই মারে মাছ। বাস্তুকুকুর কেঁদে ওঠে কোনো গেরস্তবাড়ির উঠোনে। আর কোনো শব্দ ওঠে না। নিচের ঠোঁট কামড়ে দুখি দুখি চেহারায় বসে থাকে নূরি।
আমার শীত করে...
টের পায় নূরি, তার আঙুল কাঁপছে। পাজামার দড়িতে টান লাগে, খুলছে... তার হাত নামিয়ে ফেলছে পাজামা... গায়ের জামা... চাদর খুলে পড়ে গেছে নদীতে... কুকুর কাঁদছে... শীত করছে... স্তনচুড়ো কে যেন কুয়াশায় ভিজিয়ে দিচ্ছে...
উহ... আহ...
টলতে টলতে এসে ভেজা ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে নূরি। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বুকের ওপর শুয়ে থাকা সঙ্গীকে। হাওয়ার ভেতর থেকে ফিসফিস করে কথা বলে সেই সঙ্গী। শিরশিরে হাওয়া পেঁচিয়ে যেতে থাকে দু’ঊরুর মাঝখানে। তলপেটে চাপ টের পায় সে, সুখ সুখ লাগে। শীত লাগে। ঘুম পায়। কুয়াশা নামে চোখের ওপর। নাভির নিচে। ধবল জ্যোছনার মতো স্তন-উপত্যকায়।
নূরি রে... অ নূরি...
কেউ ডাকছে। অস্পষ্ট হয়ে নির্জনতায় ভেঙে পড়ে সেই ডাক। ঘোরের ভেতর থেকে নূরি জবাব দ্যায়, উঁ।
আলস্য লাগে এখন। ফুরফুরে এক অবসাদ। দূরে গাছপালার ভেতর দিয়ে কেউ হারিকেন হাতে হেঁটে যাচ্ছে। ব্যাকুল গলায় ডেকে যাচ্ছে, নূরি রে... অ নূরি... কই গেলিরে জ্বিন ভাতারি...
নূরি ওঠে। আলস্য ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। হাওয়ার ভেতর থেকে যেন ফিসফিসে গলায় বলে ওঠে, আপজান আমি এইহানে।
শীত করে তার। ছেড়ে রাখা কাপড়গুলোর দিকে চোখ যায়।
পা কাঁপে।
চাঁদ কাঁপে।
কুয়াশা কাঁপে।
পায়ে পায়ে নদীর ভেতর হেঁটে যায় নূরি।
ডুব দ্যায় তারপর।