অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘বুচি আপা’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
দুবার হাই তুললো নিয়ামুল। মোবাইল তুলে সময় দেখল, সাতটার কাছাকাছি। উঠে বসলো বিছনায়। সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখল, খালি। হা বরাত! সামনের দেয়ালে ছুঁড়ে মারলো প্যাকেটটা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খুলে পড়ে গেল লুঙি। বসে পড়লো ফের। হাই তুললো। বালিশটা দলা করে কোলের ভেতর নিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। চুপচাপ।
বারান্দার বাতি জ্বলছে।
ঘরেরটা নেভানো।
বারান্দার বেশ খানিকটে আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। কেন যেন মনে হলো তার, কোনও কারণ ছাড়াই, তার তো ঘুম থেকে ওঠার কোনও দরকারই আসলে ছিল না। সে পারতো ঘুমিয়ে থাকতে। পারতো আলো-অন্ধকারের এই ঘরটাতে মমি হয়ে বেঁচে থাকতে। ঘুম এক প্রকার নির্ভরতা। সে নির্ভরতা পেতে পারতো। আর কী কী পেতে পারতো ভাবতে ইচ্ছে হলো না তার। কেবল মনে হলো জেগে উঠে খুব বেশি কিছু লাভ তার হয়নি।
এক ঝটকায় বালিশটা ছুঁড়ে ফেলে লুঙি গিঁট দিয়ে উঠে ঢুকে গেল বাথরুমে। বেরিয়ে এসে শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ির মাথায় এসে থমকে দাঁড়ালো। সাততলা থেকে নেমে যেতে হবে নিচে। তারপর সিগারেট কিনতে হবে। সে যদি ঘুমিয়ে থাকতো তবে তো জানতেও পারতো না তার প্যাকেট খালি। আর না জানতে পারলে তার তো নামতে হতো না নিচে। ঘুম থেকে জেগে ওঠা তার আসলে ঠিক হয়নি, নামতে নামতে ভাবতে থাকে সে।
সিগারেট ধরিয়ে ওপরে আর উঠতে ইচ্ছে হলো না। হাঁটতে ইচ্ছে হলো। হাঁটতে হাঁটতে দশ নাম্বার গোলচত্বরে এসে পড়লো। চা খেল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চা খেতে খেতে. হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করলো মানুষের আসলে কোনও গন্তব্য নেই। গন্তব্য বলতে সত্যিকার ভাবে মানুষ যা জানে তা আসলে গাছতলায় একটু বসে জিরিয়ে নেয়ার মতো। ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হলে দৌড়োতে হয় ভালো একটা আশ্রয়ের খোঁজে।
মানুষের তো কোনও আশ্রয় নেই। মানুষ মানুষের বগলতলা শুকছে। হাঁটছে, নাকি দৌড়োচ্ছে একজন আরেকজনকে ঠেলে এ এক রহস্য। যে যে রকমভাবে রহস্য মিলিয়ে নিতে পারে। আউলা হয়ে গেছে সবার মাথা। পাগলা ষাঁঢ়ের মতো ছুটে যাচ্ছে লোকাল বাস। এবং আশ্চর্য, আউলা হয়ে গেলেও কেউ ধাক্কা খাচ্ছে না বাসের সঙ্গে। এদের সবারই যেন পেছনে আরও দুটো করে চোখ আছে। এক মেয়ে ভিড়ের বাস থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল নিচে। কেউ তাকালো, কেউ তাকালো না। যারা তাকালো, খেয়াল করে দেখলো নিয়ামুল, সবার চোখ মেয়েটার শরীরের ঠিক ঠিক জায়গায়।
ওভারব্রীজের ওপর উঠে এলো সে। মানুষের চেয়ে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পেরে তার ভালো লাগলো। ঝুঁকে দাঁড়ালো একটু। চেয়ে রইলো নিচের দিকে। বাস থেকে বোঁচকা-বাচকি নিয়ে এক বুড়ো নেমে এলো। তার সঙ্গে হাড় বের হয়ে যাওয়া এক বছর বিশের মেয়ে। বুড়োর মেয়ে হতে পারে, নাও হতে পারে। মেয়েটার কোলে দুধ খাওয়া বয়েসি বাচ্চা। বুড়োটা হাঁপাচ্ছে। মেয়েটার এক হাত বাচ্চাকে সামলে আরেক হাত দিয়ে বোঁচকা-বাচকি সামলাচ্ছে। ঘিরে ধরলো ওদের কয়েকজন রিকশাঅলা। বোঁচকা টানাটানি আরম্ভ করে দিলো। মেয়েটা এক হাতে আর সামলাতে পারছে না। বিরক্ত গলায় সে বলছে, আপনেরা যান, আপনেরা যান।
রিকশাঅলারা চলে যাওয়ার মতো অতটা সুবোধ এখনও হয়ে ওঠেনি। তারা টানাটানি করতে থাকে।
কই যাবেন আফা, আমারটায় আসেন।
আরেকজন বলছে, আমার কাছে দ্যান। চাচা মিয়ার মনে হয় শইল খারাপ।
মেয়েটা করুণ চোখে চাইলো বুড়োর দিকে, আব্বা...
বুড়ো এবার হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আপনেরা যান তো। আমরা কোথাও যাব না। আমাদের যাওনের জায়গা নাই।
এ কথায় কাজ হলো। দু একজন সরে পড়লো। দু একজন দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো মেয়ের দিকে চেয়ে। বাচ্চা কাঁদছে। মেয়েটা বাচ্চাটার কান্না সামলাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সে কান্না ঢেকে যাচ্ছে গাড়ির আওয়াজ আর মানুষের কোলাহলে।
নিয়ামুল তাকালো আকাশের দিকে।
মানুষের আসলে কোনও আশ্রয় নেই।
মানুষের আসলে কোথাও ফেরার নেই।
মানুষের কেবল চলে যাওয়া আছে, ফেরা নেই।
আকাশে আজ চাঁদ ওঠেনি। মেঘে ঢেকে আছে। চাঁদ হয়তো উঠবে আরও পরে। মেঘ সরে গেলেই চাঁদ উঠবে। চাঁদ না উঠলে এ শহরকে আলো দেবার তো আর কেউ থাকবে না। এখন চাঁদ উঠতে কত সময় লাগে কে জানে!
আরও তিনটে মানুষ বাড়লো এ শহরে। আরও একজন বেশ্যার সম্ভাবনা দেখা গেল এ শহরে। বাচ্চাটা বড় হতে থাকবে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হতে হতে।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ধীর পায়ে নিয়ামুল নেমে এলো রাস্তায়।
হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছাকাছি চলে এলো। কারেন্ট নেই। ওপরে উঠতে ইচ্ছে হলো না আর। বক্কার ভাইয়ের চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। বিটিভিতে ফলের বাজারের ওপর একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এ বছর আমের ফলন তেমন হয়নি দেশে। ইণ্ডিয়ার আম এসে বাজারগুলো দখল করে নিচ্ছে। তার ওপর আছে ব্যবসায়ীদের নানা রকমের মতলব। কুষ্টিয়ার একটা বাজার থেকে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব প্রায় তিন টনের কাছাকাছি কার্বোইড দেয়া আম হাস্যোজ্জ্বল মুখে পুকুরে ফেলে দিচ্ছে। এই ছবি দেখাচ্ছে টিভিতে। পাড়ে দাঁড়িয়ে ভিড় করে এই দৃশ্য দেখছে পাবলিক।
মেজাজ তেতে গেল মুহূর্তে। কত বড় গর্ধব শালারা, যে দেশে মানুষ দিনে একটা আম খেতে পারে কীনা এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে সে দেশে টন টন আম কেবলমাত্র বিষাক্ত বলে ফেলে দিচ্ছে। তার মনে পড়লো ইলিশ মাছও মাঝে মাঝে এ রকম ফেলে দেয়া হয় বিষাক্ত বলে। অথচ বাংলাদেশের হাজার হাজার পরিবারে বছরে একটা ইলিশ খাওয়া হয় কীনা কেউ তলিয়ে দেখেছে? বাজারে যে চড়া দাম ইলিশের!
কিছুদিন আগে একটা দৈনিকের ফান-ম্যাগাজিনে একটা লেখা পড়েছিল সে, মনে পড়লো তার। জনৈক গার্মেন্টসকর্মীর মাসিক বেতন দশ হাজার টাকা। তার বাড়িভাড়া ছয় হাজার টাকা, যাতায়াত পাঁচশো টাকা, তিন বেলা ডালভাত খাওয়ার তিন হাজার টাকা। সে যদি খুব শখ করে একবেলা ইলিশ মাছ খেতে বসে তবে মাসে কত দিন তাকে না খেয়ে থাকতে হবে?
অংকের হিসেবে খুবই সহজ এটা, কিন্তু মানবিক হিসেবে নিশ্চয়ই অত সহজে হিসেবটা মিলবে না। মেলা সম্ভব না।
সাংঘাতিক রাগ ধরে যায় তার শরীরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর। এরা এত দুর্বল কেন! ম্যাজিস্ট্রেট বালছাল মাইরধোর দিয়ে কেড়ে কেন খাচ্ছে না এরা আম? সরকার ভুলভাল বোঝাচ্ছে আর এরা কী সুবোধের মতো বুঝে যাচ্ছে! কার্বোইড দেয়া আম খেলে কিচ্ছু হয় না, সে জানে। এর ক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রক্রিয়া। কার্বোইড দেয়া আম প্রতিদিন কেজি খানেক করে খেলে এক বছরের মাথায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে, ঠিক কথা। কিন্তু এ দেশের কোন মানুষ প্রতিদিন আম খেতে পারছে? এক কেজি তো অনেক দূরের, এক গ্রামই বা পাচ্ছে কোথায়? নিয়ামুলের ভেতরটা নরম হয়ে উঠলো। বাংলাদেশের মানুষ আসলে এখনও মানবিক। এরা নদীর মানুষ। এদের পূর্বপুরুষ এদের শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার সাংঘাতিক এক মন্ত্র। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে পুঁজিতন্ত্র। ভুংভাং দিয়ে যা খুশি করে যাচ্ছে টাকার কুমির আমেরিকার বগলে বসে।
বক্কার ভাই, চা দিয়েন এক কাপ।
চায়ের জন্যে বসে রইলো নিয়ামুল দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চেয়ে। হঠাৎই মনে হলো, মানুষের ছেলেবেলা ছাড়া আর কোনও জীবন নেই। ওই বয়সে অতি কুৎসিত কোনও দৃশ্য দেখলেও সুন্দর মনে হয়। আবার সুন্দর দৃশ্য দেখলে খলবল করে ওঠে শরীরের খুব ভেতরে। তাদের বাড়ির সামনে রাস্তায় পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। বুড়ো গাছ। ইয়া মোটা মোটা ডালপালা। খুব ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিতেন আব্বা। ওজু করে নামাজ পড়তে হতো তার সঙ্গে। তারপর একটু হাঁটাহাঁটি। ফেরার পথে সে বসে পড়ত কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। আব্বা চলে যেতেন বাড়ির ভেতর। সারারাত ঝরে ঝরে বাসটে ফুল বিছিয়ে থাকত রাস্তার ওপর। সে বেছে বেছে একটু তাজা দেখে কৃষ্ণচূড়া কুড়িয়ে শার্টের পকেট ভরিয়ে ফেলত। পকেট ভরে গেলেও কুড়ানো শেষ হতো তার। কী এক ঘোর তৈরি হতো তার ভেতর। স্তূপ করে ফেলত সে কৃষ্ণচূড়া। বুচি আপা এসে জোর করে তুলে নিয়ে যেত।
পড়া নাই তোর?
পড়ব না।
চল, এক থাবড়া খাবি।
দ্যাও না থাবড়া। আম্মার কাছে বইলে দিবানে।
বুচি আপা তখন সোহাগ দেখাতো। মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলত, চল তো লক্ষ্মী ভাই, স্কুলের পড়া করবি না?
যাব কিন্তু ওইগুলো নেব না। তুমি ওড়নায় করে নিয়ে দ্যাও।
বুচি আপা হাসত। কী সুন্দর সেই হাসি, কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল। বুচি আপা তার ওড়নায় কৃষ্ণচূড়ার স্তূপ তুলে নিয়ে তার হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যেত।
চোখে পানি এসে যাচ্ছে নিয়ামুলের। ছেলেবেলার সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার ছবি ঝাপসা হয়ে আসছে তার ভেতর। সে দেখল সোডিয়াম আলোয় রঙ বদলে গেছে গাছটার। কেবল গাছ নয়, আরও অনেক কিছুরই রঙ বদলে যায় এই শহরে। কে তার খবর রাখে।