আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘পাগল’
প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০১৯
দ্বিতীয়বার ক্ষুব্ধ হইলেন ঈশ্বর। হে মানব সম্প্রদায়, আমরা জানি প্রথমবার তিনি ক্ষুব্ধ হইছিলেন হযরত মুসার (আ.) কওমের ওপর। এরপর তিনি পৃথিবীতে মহাপ্লাবন পাঠিয়ে দিছিলেন। কিন্তু এবার তিনি আর তা করলেন না। আকাশসমান পানির একটা ঢেউ কেবল পাঠিয়ে দিলেন পৃথিবীর একদিক থেকে আরেকদিকে। কেননা, ঈশ্বর দেখলেন, পৃথিবীতে মানুষ আত্ম অনুসন্ধান না করে জ্ঞানবিজ্ঞানকে চিত্তবিনোদনের কাজে ব্যবহার করছে। আর একাজে জ্ঞানীকে সার্বিক সহযোগিতা করছে রাষ্ট্র আর গণমাধ্যম। জনগণ যত মূর্খ থাকবে, রাষ্ট্র আর গণমাধ্যমের তত লাভ। আর তাই ঈশ্বরের আদেশমতো ঢেউটি পৃথিবীতে খণ্ড খণ্ড সময়ের নানা ঘটনা, শিল্প-সাহিত্য, রাষ্ট্র ও সমাজনীতি, সবকিছু ধুয়ে মুছে এনে স্তূপ করল ঈশ্বরের সামনে।
ঈশ্বর দেখলেন, রাষ্ট্র আর গণমাধ্যমের তৈরি চিন্তার স্তূপ তার সামনে। কত কত লেখা। কত কত লেখক। এই হলো পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস। যে ইতিহাস লেখা হয় রাষ্ট্রের সমর্থনে। ঈশ্বর এক ফেরেস্তাকে নির্দেশ দিলেন, যাও, গন্ধম গাচের নিচে এক পাগল বসে আছে। তাকে নিয়ে এসো।
ফেরেস্তা তাকে আনতে গেলেন। পাগল কিন্তু এলো না। ফেরেস্তাকে বলল, পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে ছিলাম, আমি তো কিছুই লিখতে চাইনি। কী এক কাতরতা যেন আমার ভেতর থেকে কথা বলে উঠত। যেন আমি নীলকণ্ঠ। যন্ত্রণা আর আনন্দের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আমি বাঁচতে চেয়েছি। তাই লিখে গেছি আমার কাতরতা। এখন ঈশ্বরকে গিলে বলেন, ওইসব হাবিজাবি লেখার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আমি এখন এইখানে বেশ সুখে-শান্তিতে আছি। দয়া করে ইশ্বর যেন আমাকে আমার কৃতকর্মেও জন্য দোষারোপ না করেন।
ফেরেস্তা বললেন, আপনি আরেকবার ভাবুন। আপনি ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করছেন।
পাগল বলল, ঈশ্বর জানেন আমি তার আদেশ অমান্য করছি কীনা। আমি আমার প্রভুর গোপন ইচ্ছের কথা জানি। এই যে দেখুন গন্ধমগাছ, মানুষের আদিপিতা এ গাছের ফল খেয়েই প্রথম সভ্য হন। তার ভেতর এসেছিল যৌনবোধ। আমিও আদমের বংশধর। আমার মুখের ওপর সবসময় ঝুলতে থাকে জ্ঞানের এ ফলগুলো। কিন্তু ঈশ্বরের আদেশ আমি ভুলিনি। তিনি আমার আদিপিতাকে এ ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। আমি শুধুই বিস্মিত হতে চাই, জ্ঞানী হতে চাই না।
ফেরেস্তা জিগেশ করলেন, বিস্মিত হতে গেলে তো জ্ঞান দরকার।
পাগল জবাব দিল, সে জ্ঞান আমি আমার আদিপিতার কাছ থেকেই পেয়েছি।
ফেরেস্তা চলে গেলেন। সব কথা শুনে ঈশ্বর হাসলেন। বললেন, এ কারণেই আমার পাঠানো ঢেউ পাগলটার লেখা পৃথিবী থেকে ধুয়ে দিতে পারেনি। একটু থেমে ফের ঈশ্বর বললেন, বেশিরভাগ মানুষ সেসব লেখককে পড়ে, যারা গণমাধ্যমের তৈরি। এসব পাঠক-লেখক সময়ের খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত। আতশবাজির মতো একটু সময় পরই মিলিয়ে যায়। রত্নভাণ্ডার তো থাকে সাগরের নিচে, অনন্ত ঘুমে। জীবন-জগৎ বিষয়ে জানেঅলা লেখকেরা এরকম। ঢেউয়ের অনেক অনেক নিচে তারা বসবাস করে। দক্ষ ডুবুরি ছাড়া রত্নখনির কাছে যেমন কেউ পৌঁছতে পারে না, তেমনই বিচক্ষণ পাঠক ছাড়া ওই লেখকের খোঁজও কেউ পায় না।
ঈশ্বর থামলেন। দেখলেন, তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই কাঁপছে। কাঁপছে প্রতিটি প্রাণী। শুধু কাঁপছে না মানুষ। তবে দু’চারজন কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তারা চেয়ে আছে আসমানের দিকে। তাদের দিকে চেয়ে ঈশ্বর আবারও হাসলেন। বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালেন, ওই দু’চারজন যতদিন থাকবে ততদিন আমি পৃথিবী ধ্বংস করব না।