আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘এই তো জীবন’

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০২২

বসবার ঘরটাকে ঠিক পৃথিবীর ভেতর কোনও জায়গা বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক উঁচুতে ধুলো-বালির বাইরে একটা জগৎ যেন। দেয়ালে ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত জলরঙ করা বিশাল সাইজের ওয়াল-পেইন্টিং। বিজ বিজ আওয়াজ তুলে এসি চলছে। ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা একটা স্রোত। অ্যাকুরিয়ামের পরিষ্কার পানিতে চমৎকার দেখতে নীল রঙের দুটো মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মার্বেলের মতো সাংঘাতিক সুন্দর চোখ। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

কয়েকটি চীনে পুতুল ঝকঝকে পালিশ করা তাকের ওপর। পৃথিবীর বাইরের এই ঘরটার নির্জনতা ভেঙে এখুনি যেন কথা বলে উঠবে। অথচ তারা কথা বলে না। বোবা চোখে চেয়ে থাকে। কথা বললে সুবিধে হতো। অন্তত কথা বলার মতো কয়েকটা পুতুল পাওয়া যেত সময়টা কাটানোর জন্যে।

এই যে পুতুল সাহেব, আপনার কি কোনও নাম আছে?
টুনু।
বাহ, সুন্দর নাম। তোমার আশপাশে যারা তাদেরও নিশ্চয়ই নাম আছে।
আছে।
তোমরা কী সারাক্ষণ এইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো?
না।
নিজেদের ভেতর গল্পচাটাম করো?
করি।
কী গল্প করো তোমরা?
বলব না।
আচ্ছা বলো না। আচ্ছা টুনু, তুমি কোন দেশ থেকে এসছো?
লন্ডন।
বাহ, তুমি তাহলে লন্ডনি মাল।
খারাপ।
কী খারাপ?
মাল।
সরি, আর বলব না। আচ্ছা টুনু, তোমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কী?
আমরা হাওয়া খাই।
চমৎকার। হাওয়া ভালো জিনিস। তোমাদের মতো মানুষও যদি হাওয়া খেতে পারত তবে অনেক ঝামেলা চুকে যেত।
খেলেই তো পারো।
না রে টুনু, যত সহজ ভাবছ ব্যাপারটা অত সহজ না। পেঁজগি আছে।
খারাপ।
কী খারাপ?
পেঁজগি।

মেজাজ তেতে যাচ্ছে গুড্ডুর। এভাবে বানিয়ে বানিয়ে কতক্ষণ আর নিজের সঙ্গে কথা বলা যায়! প্রায় দু’ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, গুড্ডু বসে আছে। এ পর্যন্ত কারো মুখ দর্শন হয়নি। কাজের মেয়ে জোছনা এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। কোনও কথা বলেনি। বড় লোকের বাড়ির গাধাটিও দেমাগি হয়। কিছু মনে করেনি গুড্ডু। জোছনা বসার ঘরের কাচের পাল্লা টেনে ভেতরে চলে যায়। ভেতরে ঢুকে বসে রইল গুড্ডু। একবার ইচ্ছে হয়েছিল, অ্যাকুরিয়ামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা মাছ বের করে চোখ ট্যারা করে আবার অ্যাকুরিয়ামে ছেড়ে দিতে। কিন্তু ভেবে দেখল, কাজটা ঠিক হবে না। এ বাড়িতে তাকে আবার আসতে হবে। আসতে হবে নিজের গরজে। ভদ্রমহিলাকে চটিয়ে দেয়া উচিত হবে না।

কি খবর?
একটু ঝিঁমুনি মতো এসেছিল। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল গুড্ড। মামি বসলেন না। দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে।
এই তো, কেমন আছেন মামি?
বসো।
মামি বসলেন না। গুড্ডুও দাঁড়িয়ে রইল।
বাড়িতে গেছিলি এর ভেতর?
না, যাওয়া হয়নি।
বোস। দুপুরে খেয়ে যাস।
মামি চলে যাওয়ার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে যান। গুড্ডু এগিয়ে আসে।
মামি?
কিছু বলবে?

কেস খারাপ। তুমি থেকে তুই। তার মানে তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন গুড্ডু মিয়ার পরের কথাটা কি। বুঝলেও সমস্যা নেই। যা দরকার তা চট করে বলে ফেলতে হয়। গুড্ডু তাই চট করে বলল, খাব না।

আচ্ছা আবার আসিস।
মামি, দু’হাজার টাকা দরকার ছিল।
গত মাসেও পাঁচশো নিয়ে গেছ গুড্ডু।
কী করবো মামি, ভীষণ দরকার।
মুখ ফিরিয়ে নিলেন মামি। কিছু বললেন না। চলে গেলেন।

সেদিকে চেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল গুড্ডুর। দাঁড়িয়ে রইল সে। ভাবতে লাগল। অপমানিত হলো। কিন্তু চলে গেল না। টাকা দরকার। চলে যাওয়া যাবে না। সে তো আর ভিক্ষাবৃত্তি করছে না। আপন মামা। চলে যাবে কেন? বেশ কিছুক্ষণ পর জোছনা আসে টাকা নিয়ে।
এই লন টেকা। আফনেরে খালাম্মা দুফরে খায়া যাইতে কইছে।
টাকাটা পেয়ে খুশি হলো গুড্ডু। বলল, না রে জোছনা, আজ যাই।

বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে দেখা হলো মেরিনার সঙ্গে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো গুড্ডু। মুখ ফেরালো না মেয়েটি। সে-ই কথা বলল, কেমন আছিস মেরিন?

ভালো। খুবই হালকা গলায় বললো মেয়েটা। তারপর স্যাণ্ডউইচ হাতে ঢুকে গেল বেডরুমে। আহত হলো না গুড্ডু। স্বাভাবিক ভাবেই হাসলো। নিজের রক্তের মামাতো বোন, অথচ কত দূরের সম্পর্ক মনের। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আসলে এদের যোগাযোগ তেমনভাবে নেই। এই টাইপের পরিবারের কাছে বাইরের পৃথিবী বলতে বিভিন্ন চ্যানেলে দেখা সিরিয়াল আর সুন্দর সুন্দর দেখতে মেয়ে-পুরুষ। এর বাইরে এদের দেখার চোখ নেই। গুড্ডু জানে এসব। আর তাই ক্ষমা করে দিয়ে পারে অনায়াসে। করুণা করতে পারেন বুকের খুব ভেতর থেকে।

আর ভেবে আনন্দ পায় নিজের খোলামেলা জগতের কথা ভেবে। মানুষের কথা ভেবে। মানুষের পৃথিবীর কথা ভেবে।

রাস্তায় নেমে এককাপ চা খেলো ফুটপাতের বেঞ্চে বসে। চায়ের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছিল। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো।

চড়া রোদ। ঝকমকাচ্ছে চারদিক। ঘাম দিচ্ছে শরীরে। গায়ের জামা ভিজে জবজবে। মার্কেটের সামনে দিয়ে ফুটপাত ধরে সাবধানে মানুষের শরীর বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে হাটতে লাগলেন গুড্ডু। কেউ কেউ তবু ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছে কেউ। সরি বলছে না। মানুষের শরীরের ব্রেক কমে আসছে আজকাল। সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন টাইপ ট্রাকের ব্রেক এখন উচিত মানুষের পাছায় লাগিয়ে দেয়া। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো গুড্ডু।