আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘ইবলিসনামা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০২১

অফিসের নিচে এসে দেখি, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কামরুল। আমাকে দেখতে পেয়ে হাসল, চল চা খাই।
কতক্ষণ?
বেশি সময় না।
একটা কল দিলে পারতি। কিংবা সরাসরি ওপরেও তো...
দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়ালাম এসে ফুটপাথে। কামরুল তার ময়লাটে দাঁত বের করে খ্যাকখ্যাক করে হাসল, তোর ওই নিউজ এডিটর লোকটাকে দেখলে না মাম্মা আমার হাগু পায়। পড়াশোনা নাই, হুদাহুদি পাবলিকরে জ্ঞান বিতরণ করে।
কল দিতি।
ধুর ধুর। আমি তো জানিই এ সময় তুই বেরোবি।
শুটিং শেষ?
হুঁ।
ফিরেছিস কবে?
আজ দুপুরে। বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে সরাসরি তোর এখানে।  
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, মাহমুদুল হকের চিক্কর মারন চাবুক বানালি না?
হুঁ।
কী মনে হয়, পারবি আনতে?
দেখি, এডিটিং প্যানেলে তো আগে বসি। চা শেষ করে সিগারেট জ্বালল কামরুল। তারপর আমার ঘাড়ে একটা রদ্দা মেরে খ্যাকখ্যাক করে হাসতে লাগল। চল মামা, তোকে আজ মাল খাওয়াবো।
নিয়ে এসছিস নাকি বান্দরবান থেকে?
আছে এক বোতল। সে তো আমারই একা লাগে। চল সাকুরাতে গিয়ে বসি। আজ শালা সাঁওতাল আর আমেরিকা মিশেল দিয়ে দোব। বলেই আবার সেই খ্যাকখ্যাক।  
চমকে উঠি। কী অবলীলায় হাসতে পারে কামরুল। যেন পৃথিবীর কোথাও কোনও ভার নেই। চাইলেই এ রকম খ্যাকখ্যাক শব্দ করে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হেসে ওঠা যায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার মনে হলো, রহস্যময় একজন মানুষের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। যে হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎ এসে হাজির হয়ে যায়। যার মাথার ভেতর নানা চিত্রকল্প খেলা করে। সেলুলয়েড ফিতায় সেসব চিত্রকল্প বন্দি করতে পারলেই জীবনের অনেক প্রাপ্তি মেনে নিয়ে যে মানুষ কোনও বারে গিয়ে কোণার দিকে চুপচাপ বসে বসে মদ খায়। তিন-চারদিনের না-কাটা দাড়ি তার মুখে। পোশাক-আশাকেরও শ্রী বলতে তেমন কিছু নেই। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। বোহেমিয়ান বোহেমিয়ান দেখাচ্ছে।
তোকে দেখে এই মুহূর্তে আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?
কিরে মামা?
তুই বুঝি পৃথিবী ঘুরে এলি।
আর পৃথিবী ঘুরে এসে সরাসরি তোর কাছে চলে এলাম, তোকে মাল খাওয়াবো বলে। চল শালা, আমার একটা হাত এবার টেনে ধরে সে, ফালতু বাতচিত পরে...

ঝিম মেরে বসে আছে কামরুল। চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। টুকরো টুকরো কথা, চাপা হাসি, কখনও বেয়ারা বেয়ারা এই এদিকেÑ কারও কণ্ঠস্বর। এরই মধ্যে হালকা আওয়াজে মেহেদি হাসানের গলা ভেসে আসছে:
বান্দে আঁখো মে স্বাপ্নে থে
স্বাপ্ন মে তুম আপনে থে
আঁখ খুলি তো হাম নেহি জানা
স্বাপ্নে আঁখির স্বাপ্নে থে।
অল্প অল্প দুলছে কামরুল। নেশা চড়ে গেছে। টেবিলের ওপর বেশ খানিকটে ঝুঁকে পড়ে আঙুল দিয়ে মিউজিকের সঙ্গে তাল ঠুকছে। অস্ফুট গলায় গেয়েও উঠছে কখনও কখনও দু’একটা লাইন। অথচ এতক্ষণ শুটিংয়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা-অঘটনা ছরবেছর বলে যাচ্ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া একটার পর একটা রিং বানিয়ে আমি ঢেকে দিচ্ছি ওর মুখ। যাচ্ছালা, ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে এসছিস ধোঁয়ার ভেতর মিলিয়ে যা। গেলাশে বরফের টুকরো ফেলে একটু গুলিয়ে নিয়ে চুমুক দিলাম।
হঠাৎ করেই কামরুল বলে ওঠে, ইবলিস সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
আর আমি ভাবছিলাম, রিপা এখন কী করছে। আকাঙ্ক্ষার ছেলেটি কী এখন তাকে আদর করছে, যে বিছনায় আমি ঘুমোই। যে বিছনায় আমি রিপার শরীর অবলম্বন করে প্রতি রাত্রে বেঁচে উঠি, সে বিছনায় কে ওই ছেলেটি? আমি দেখতে পাচ্ছি, ছেলেটি রিপার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে কী অবলীলায় চুমু খেয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা। ছেলেটির একটা হাত পেঁচিয়ে আছে রিপার গলা, আরেক হাত জামার ওপর দিয়ে শক্ত হয়ে চেপে বসে আছে রিপার একটা স্তনে। মুখ উঁচু করে ছটফটিয়ে উঠছে রিপা। ঘাড় থেকে গলায়, তারপর থুতনি, তারপর ঠোঁট... চুমুর পর চুমু... এরপর ছেলেটির হাত রিপার জামার বোতাম খুলছে। বালিশে চিৎ হয়ে শুয়ে রিপা চেয়ে আছে ছেলেটির মুখের দিকে। কাম-ভালোবাসা-শরীর-মন সব একাকার তার ওই চেয়ে থাকার ভঙ্গির ভেতর। এই তো বেরিয়ে পড়েছে রিপার বুক। থকথকে মাংসের দুটো নরম ¯ত’প। ছেলেটি এবার ঠোঁট ডুবিয়ে দিল স্তূপের চুড়োয়। তিরতির কাঁপছে রিপার ঠোঁট। এই তো, সে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল নিচের ঠোঁট। ছেলেটি নেমে যাচ্ছে এবার নিচে... ভয়ংকর, ভয়ংকর এই দৃশ্য... উলটে-পালটে যাচ্ছে বিছনার চাদর। করাত কলের চাকা, তুমি আমার শরীর কয়েক খণ্ডে ভাগ করে দাও। এ শরীর আমি তোমাকে দিলাম...

টের পাই, টেবিলের ওপর ফেলে রাখা আমার একটা হাতের ওপর হাত রাখল কামরুল। ফিসফিসিয়ে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না, না? কিন্তু বিশ্বাস কর, ঈমানছে মামা, সত্যিই আমাদের দেখা হয়েছে।
উঁ? কী বলছিলি যেন? ওর মুখের দিকে তাকাই আমি। টেবিলের অর্ধেকটা প্রায় ঝুঁকে এসেছে ও। মাথা দুলছে একটু একটু।
ইবলিসেরর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।
ইবলিস কে?
শয়তান।
তলিয়ে যেতে থাকি আমি। নানা রঙ নানা আলোর ভেতর ডুব দিয়ে উঠে এসে ফের চেয়ে দেখি কামরুলকে। চোখমুখ কী রকম লাল হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে।
বলল, জানি, তুই ভাবছিস পাগল হয়ে গেছি আমি। কিন্তু বিশ্বাস কর মামা, এক বর্ণও বানিয়ে আমি বলছি না। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কামরুল, ট্রুথ ট্রুথ ট্রুথ!
কী হলো, ক্ষেপেছিস নাকি?
পাশের টেবিল থেকে মন্তব্য ছুটে এলো, অত বেশি খাবেন না ভায়েরা, হেডকোয়ার্টারে গণ্ডগোল দেখা দেবে। ছুটে এলো বেয়ারা। হাত ইশারায় তাকে চলে যেতে বললাম।

চেয়ারে সোজা হয়ে একটু নড়েচড়ে বসল কামরুল। চুপচাপ বসে রইল কিছু সময়। বোতল থেকে গেলাশে তরল ঢেলে এক নিশ্বাসে মেরে দিল পুরোটা। ঠক করে শব্দ হলো গেলাশ রাখার। মাথাটা একটু দুলিয়ে বলে উঠল, আমি ঘুমোতে পারিনি এই তিন রাত। শুটিং হয়নি। প্যাকাপ করে দিয়েছি। কেবলই মনে হচ্ছিল, কাউকে বলা দরকার... কাউকে বলা দরকার। শেষমেষ তোর কথাই মনে এলো। এখন তুই মামা আমাকে পাগল ঠাউরে নিচ্ছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না। বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কামরুল।
ঝুঁকে পড়ে তার কাঁধে একটা হাত রাখলাম, কাঁদছিস কেন? আমি তোকে মোটেও পাগল ভাবছি না। তুই বল, আমি শুনব।
একটু ধাতস্থ হয়ে সে বলল, আমাদের প্রধান প্রব্লেম কী জানিস, খালি চোখে যা দেখি, আমরা ভাবি, এর বাইরে বুঝি আর কিছু নেই। কিন্তু কখনও কখনও কেউ না কেউ তো ওই বাইরের জগতে ঢুকে পড়তে পারে। সে কথা যদি কাউকে বলা হয় তবে ভাবে, লোকটা পাগল হয়ে গেছে।
আমার পা কাঁপছে। মাথার ভেতর টলোমলো। নেশা চড়ে গেছে আজ। সাঁওতাল আর আমেরিকা মিলেমিশে গেছে মাথার ভেতর। সাঁওতাল আর আমেরিকা... আমেরিকা আর সাঁওতাল... তীর-ধনুক আর এ্যাটম বোমা...
এ রকম কি হয়, তুই বল? আমার একটা হাত ধরে কামরুল।
হয়। তুই বল। কীভাবে ঘটনাটা ঘটে গেল?
সিগারেট ধরাল এবার কামরুল। লম্বা একটা টানে বুকের ভেতর ধোঁয়া নিয়ে নাকমুখ দিয়ে বের করে দিল। ঝুঁকে এলো আরও আমার দিকে। দোস্ত, আজ কী বার?
সোম।
শুক্রবার ভোরের ঘটনা। ঘুম ভেঙে গেলে এসে দাঁড়ালাম বাংলোর বারান্দায়। বাংলোটা পাহাড়ের সমতল থেকে বেশ উঁচুতে, পাহাড়ের গা কেটে বানানো। নিচের সমতলে জনবসতি। চারদিকে তখনও অন্ধকার। ভোরের আলোর সাড়া পেয়ে একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। একটা-দুটো পাখি ডেকে ডেকে উঠছে কোথাও। হিমহিম পাহাড়ি হাওয়া ছুটোছুটি করছে। কী যে হলো আমার, বেরিয়ে এলাম বাংলো থেকে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে পাথর কেটে বানানো পায়ে চলা রাস্তা ধরে বাংলোর পেছন দিকে হাঁটতে লাগলাম। একটু পর শুরু হলো মাটির রাস্তা। দু’পাশে গজারি, শাল, সেগুন আর নানা প্রজাতির উঁচু উঁচু গাছ। সারা চৈত্রে পাতা ঝরে ঝরে সবুজ কচি পাতা গজিয়েছে। ভোরের নরম রঙে কচি সবুজ রঙ মিলেমিশে কী যে দেখাচ্ছিল, তোকে বোঝাতে পারব না।

একটু থেমে দুলতে লাগল কামরুল। দুলতে দুলতেই বলল, এসব দেখতে দেখতে হাঁটছি, খেয়াল করিনি আমার সামনের দিকের রাস্তা ধরে একজন হেঁটে আসছেন। যখন দেখলাম চমকে উঠলাম। লোকটার পরনে তাবলিগি পোশাক-আশাক। কী যে লম্বা, সচরাচর ও রকম লম্বা দেখা যায় না। জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে চোখমুখ থেকে। আমাকে দেখে হাসলেন তিনি। দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, ওদিকে বেশি দূর যাবেন না। পাহাড়ি জানোয়ার আছে। বলেই হাঁটতে আরম্ভ করলেন।
আমি এবার তার পিছু নিলাম। পাশাপাশি গিয়ে বললাম, আপনি কি পর্যটক?
হ্যাঁ।
কোত্থেকে আসছেন?
আসমান থেকে।
আমি হাসলাম, মজা করছেন?
আমার দিকে তাকালেন তিনি। দেখলাম, তার চোখের ভেতর কী যেন জ্বলছে। আগুনের মতো, তবে আমি দেখেছি আগুন না, অন্য কিছু। বুক পর্যন্ত ঝোলানো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন, আমি আপনার সঙ্গে মজা করছি না। সত্যিই আমি আসমান থেকে এসেছি। আমার নাম ইবলিস। মানুষ আমাকে ইবলিস শয়তান নামে চেনে।

বিশ্বাস কর দোস্ত, একটুও ভয়টয় আমি পাইনি। তবে আশ্চর্য হয়েছিলাম। শয়তান তবে এ রকম দেখতে হয়। কই, তাকে দেখে তো শয়তান শয়তান মনে হচ্ছে না। বরং আমার তো মনে হলো, তার চেহারা বেশ নূরানি। আর কথাবার্তা বলছেন কী অমায়িক।
তিনি বললেন, কী, শয়তান বলে মনে হচ্ছে না তো আমাকে?
আমি অপ্রস্তুত ভাবে হাসলাম, হ্যাঁ।
আমি তো আসলে ফেরেস্তা ছিলাম। তখন আমার নাম ছিল আজাজিল। তারপর হয়ে গেলাম ইবলিস। ফেরেস্তাদের দেখতে তো ফেরেস্তাদের মতোই হবে, তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম, তা ঠিক।
কথা বলতে বলতে আমরা বাংলোর দিকে এগোচ্ছি। এ সময় একজনকে আমাদের দিকে হেঁটে আসতে দেখলাম। লোকটা রাস্তার একদিক দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে হেঁটে আসছে। এক চিলতে চাঁদের আলোর মতো হাসি লেগে আছে তার মুখে। এবার কিন্তু আমি অবাক হলাম। লোকটার হাসিতে কী যেন একটা ছিল। আমার মনে হলো, সে আমেরিকা অধিকার করে এইমাত্র ফিরে যাচ্ছে তার ঘরে।
ইবলিস তাকে দেখে সালাম দিলেন, আসসালামু আলাইকুম জনাব।
লোকটা সেদিকে খেয়াল করল না। নিজের ভেতর ডুবে গিয়ে চুপচাপ হেঁটে সে চলে গেল। আমি জিগেশ করলাম, লোকটা কে?
একজন মানুষ।
সে তো দেখতেই পেলাম। কিন্তু ও রকম হাসছিল কেন?
সে সত্যের একটি অংশ খুঁজে পেয়েছে। এই প্রাপ্তি তাকে এই পৃথিবী অধিকার করার পরিপূর্ণ আনন্দ এনে দিয়েছে। আপনি নিশ্চিত থাকুন, এবার সে একটি মত প্রচার করবে। ধর্মমতও বলতে পারেন। এই বলে ইবলিস হাসতে লাগলেন।
কিন্তু এতে আপনি হাসছেন কেন? আপনার কাজ তো মানুষকে সত্য থেকে মিথ্যের পথে নিয়ে যাওয়া।
ইবলিস মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, সে কাজটিই এই লোকটি করে দেবে বলে হাসছি।
তারমানে? কৌতুহলী হয়ে উঠলাম আমি। বললাম, ধর্ম প্রবক্তারা তো মানুষের কল্যাণে সত্য প্রচার করেন।
তবে শোনেন, ইবলিস বলতে লাগলেন, এই লোকটি যে সত্যের সন্ধান পেয়েছে তা সত্যের একটি অংশ। অথচ সে ভাবছে পূর্ণাঙ্গ সত্যের রূপ সে দেখে ফেলেছে। এ রকম আরও আরও যারা ধর্মমত প্রচার করেছে, তারাও এ রকমই ভেবেছে। তাদের অনুসারীরা তৈরি হয়েছে সত্যের এক একটি অংশকে চূড়ান্ত সত্য মেনে নিয়ে। অথচ ভেবে দেখুন, যদি এমন হতো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ নিয়ে একক একটি মত প্রতিষ্ঠা করত তবে চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান মানুষ পেত।

আমি অবাক চোখে চেয়ে রইলাম শয়তানের দিকে। তিনি বলে যাচ্ছেন, এভাবে আলাদা আলাদা সত্য প্রতিষ্ঠায় মানুষের আরও একটি সমস্যা আছে।
কী সেটা?
মানুষ তার নিজের মতো করে সত্যের সন্ধান করার অধিকার হারাচ্ছে। এক একটি ধর্মমতের অনুসারীরা তাদের ধর্মগুরুর দেখানো পথেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। অথচ তারা নিজেরাও যদি সত্যের অনুসন্ধান করত তবে মানুষ জাতি একদিন পরিপূর্ণ সত্য আবিষ্কার করতে পারত।... বলতে বলতে কেঁপে ওঠে কামরুল। কেঁপে ওঠে টেবিলের ওপর অলসভাবে রাখা তার হাতের আঙুল।
কেঁপে উঠি আমি। শরীরের ভেতর ভয়ের একটা কালো সাপ ছুটোছুটি করতে থাকে। ঠাণ্ডা একটা স্রোত নেমে যেতে থাকে আমার মেরুদণ্ডি বেয়ে। কেঁপে কেঁপে ওঠে শরীর। ওই তো, দেখতে পাচ্ছি আমি, আধো আলো আর আধো অন্ধকারে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরছি আমি। প্রত্যেক টেবিলের কাছে থেমে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছি। আবার ঘুরছি আরেক টেবিলে। ক্রুদ্ধ চোখমুখ। ক্রোধে আর উত্তেজনায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীরের প্রতিটি শিরা। রক্ত ফুটছে চিনিকলের বয়লারের মতো।
বুকের রক্ত জমে যেতে থাকে আমার। ঠকঠক করে কাঁপছে পা। হাতের ধাক্কা লেগে উলটে পড়ে গেলাশ। রঙিন তরল গড়াতে থাকে টেবিলে। প্রায় ফিসফিসিয়ে কোনও রকমে বলে উঠি, চল কামরুল, আমরা এখান থেকে কেটে পড়ি।
কী যেন বলে যাচ্ছে কামরুল। কিছুই বুঝতে পারি না। কেবল দেখতে পাই তার হাত নড়ছে। আরও ঝুঁকে পড়েছে কামরুল টেবিলের ওপর। ঘাড়ের ওপর মাথাটাকে মনে হচ্ছে কেউ হয়তো ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। এই ভার সে আর বইতে পারছে না। আমি আবার দেখতে পাই আমাকে। টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের টেবিলের দিকেই হেঁটে আসছে চরিত্রটি।

উঠে দাঁড়াই আমি।
পা কাঁপছে আমার ঠকঠক করে। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাই কামরুলের মুখের দিকে। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিই। মুখ তোলে কামরুল, তুই বিশ্বাস কর মামা, তারপর থেকে... বলতে বলতে কাঁধের ওপর রাখা আমার হাত ধরে।
আমি বলি, চল আমরা বেরিয়ে যাই।
এখুনি? কী বলিস মাম্মা, দুদিকে মাথা নেড়ে শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে কামরুল, নেশা তো গাছে চড়ছে মাত্র, এরপর চড়ব মগডালে, তারপর চাঁদে রওনা দেব... আর শালা এখুনি যদি...
কামরুলের কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলি, চল মামা, বেরিয়ে যাই আমরা... পার্কে-টার্কে বসে না হয়...
তীব্রভাবে মাথা নাড়ে কামরুল, আরে না না... বোস না তুই... অমন করছিস কেন...
কামরুল...
বোস না, কাঁধে রাখা হাতটা এবার নামিয়ে দেয় কামরুল। বোস না, আরেকটু খেয়ে না হয়...
দরদর করে ঘাম দিচ্ছে আমার। আর মাত্র দুটো টেবিল... ওই তো এগিয়ে আসছি আমি আমারই দিকে... ক্রুদ্ধ চোখ, ভয়ংকর... খুনির মতো ওই তো হেঁটে আসছি আমি... আর মাত্র দুটো... ছুটে যাই দরজার দিকে... পেছন পেছন কামরুল, আরে শালা দাঁড়া বোতলটা মেরে নিই... মুহূর্তের জন্যে পেছন ফিরে দেখতে পাই, কামরুল বোতলে মুখ লাগিয়ে টেনে নিচ্ছে ঢকঢক করে...

পাশাপাশি হাঁটছি আমরা সোহরাওয়ার্দীর অন্ধকার গাছপালার ভেতর দিয়ে। কিছুক্ষণ আগেই সে হাতের খালি বোতল আছাড় দিয়ে ভেঙেছে রাস্তার ওপর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে কাচ। সেদিকে চেয়ে খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠেছিল কামরুল, দিলাম শালা ছড়িয়ে বাংলার ঘরে ঘরে...
এখন মাথা নিচু করে চুপচাপ হাঁটছে। থেকে থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ করছে গলার ভেতর থেকে। শিখা চিরন্তনী পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম আরও ভেতরে। অন্ধকারে ঢেকে যেতে যেতে ডাকলাম, কামরুল?
বল না শালা।
গল্পের চরিত্রের কি প্রাণ থাকে?
আলবত থাকে। থাকতেই হবে। কেন থাকবে না?
সিরিয়াস, থাকে কীনা বল।
দাঁড়া, তার আগে মুতে নিই... বলতে বলতেই কামরুল একটি গাছের দিকে এগিয়ে গিয়ে ছরছর করে হিসু করে দিল। ফিরে এলো প্যান্টের চেইন লাগাতে লাগাতে। হুঁ, কী যেন বলছিলি?
গল্পের যে সব চরিত্র, তাদের কি প্রাণ থাকে?
থাকে তো।
কী রকম?
সহজ কেস মামা, তুই বুঝতে পারছিস না? প্রাণ না থাকলে চরিত্ররা হাসে কেন, কাঁদে কেন, প্রেমই বা করে কোত্থেকে। সেই অনুভূতি তাদের ভেতর আছে বলেই তো, নাকি? এক চরিত্র আরেক চরিত্রের সঙ্গে কথা বলে যায়, আমরা যেমন বলি। কীভাবে বলে? একজন আরেকজনকে কিছু বোঝাতে চায় বলেই তো বলে...
সে রকম না, আমি বলতে চাইছি, আমাদের মতো রক্তমাংসের বাস্তব হয়ে উঠতে পারে কীনা।
তুই কি বাস্তব? হঠাৎ বিচ্ছিরি রকমের খ্যাকখ্যাক শব্দে হেসে ওঠে কামরুল। যা বলেছিস মাম্মা, তুই আমি আমরা বাস্তব আর গল্পের চরিত্ররা অবাস্তব... এইসব কে ঢুকিয়েছে তোর মাথায়?
তুই হাসছিস?
দু’পা দুদিকে ছড়িয়ে সিগারেট ধরাল কামরুল। দেশলাইয়ের আগুন না নেভা পর্যন্ত ধরে রইল মুখের ওপর। নিভে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তুই যখন গল্পে একটা চরিত্র পড়িস দেখতে পাস না তাকে?
মাথা নাড়ি, পাই।
তোর কি মনে হয় না, একটু একটু করে চরিত্রটা বাস্তব হয়ে উঠছে তোর কাছে?
হ্যাঁ, হয়।
এভাবেই জীবন্ত হয়ে ওঠে এক একটি চরিত্র। তোর কাছে যা বাস্তব চরিত্রের কাছে তাই পরাবাস্তব, আবার তোর কাছে যা পরাবাস্তব চরিত্রের কাছে তাই বাস্তব।  বাস্তব-পরাবাস্তবের এই ভেদকথা অনেকেই বোঝে না, কেন বোঝে না মাম্মা? আমার কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ে কামরুল। তুই আমাকে বহন করে নিয়ে যেতে পারবি? একশোতে একশো দশ দোব তোকে।
কামরুল?
বল না শালা।
আমাকে একজন খুন করবে বলে খুঁজছে।
বেশ তো মজা, খুন হয়ে যা।
ইয়ার্কি না, সত্যিই।
তোকে কে খুন করবে? তুই কি রাজনৈতিক নেতা... পাতিনেতা...
আমার লেখা গল্পের একটা চরিত্র।
সোজা হয়ে দাঁড়ায় কামরুল। চোখ পিটপিট করে তাকায় আমার দিকে। কেন, খুন করতে চায় কেন?
আমি তাকে লিখেছি বলে। সে তার মতো জীবন পেতে চায়। আমার নিয়ন্ত্রণ সে মানতে রাজি নয়।
ছেড়ে দে তাকে তার মতো। তুই নিয়ন্ত্রণ না করলেই তো হয়।
কিন্তু আমি যে লিখে ফেলেছি তাকে।
ওপরের দিকে চেয়ে ঘুরপাক খায় কামরুল। ঘুরতে ঘুরতে বলে, এখান থেকে চাঁদ দেখা যায় না কেন রে?
কিছুক্ষণ আগে সাকুরাতে আমি তাকে দেখতে পেয়েছিলাম। টেবিলে টেবিলে ঘুরে আমাকে খুঁজছে। কী ভয়ংকর যে তার ক্রোধ তুই যদি দেখতে পেতিস...
আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় কামরুল। তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমরা প্রত্যেকেই তো কাউকে না কাউকে খুন করার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতারণা-প্রবঞ্চনা-বিশ্বাসঘাতকতা এগুলো কি এক একটা খুন নয়? হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে কামরুল। চড়া গলায় বলে, ঋতা কি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে আমাকে খুন করেনি? আবার সেই খ্যাকখ্যাক হাসি, আসলে কী জানিস, খুন করা আর খুন হওয়া- এ দুইয়ের মাঝখানে আমরা বেঁচে আছি। তবে তুই এক কাজ করতে পারিস, গল্পটা ছেপেছিস কোথাও?
না।
ছাপতে দিয়ে দে।
দিলে কী হবে?
দিয়েই দ্যাখ না শালা। সে আরেক মজা। এখন তো তোর পেছনে কাল্লু মামা ঘুরঘুর করছে, আর যখন অনেক অনেক মানুষ পড়ে ফেলবে তাকে, তখন তো বেচারির ল্যাজেগোবরে অবস্থা।
আবার ওপরেরর দিকে চেয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে কামরুল। আর বলতে থাকে, এখান থেকে চাঁদ কেন দেখা যায় না রে...