আফিফ উদ্দিন শাওনের প্রবন্ধ ‘কবিতায় মোহাম্মদ (সা.)’
প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২১
পৃথিবীর অসংখ্য ভাষার কবিরা রাসূলের (সা.) প্রশংসায় নিজেদের রচনাসম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালি কবি রাও এতে কম পিছিয়ে নেয়। ঠিক এমন কিছু কবির কিছু কবিতার খণ্ডাংশ আজ আলোচনা করছি।
১.
জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়:
বক্ষে আমার কাবার ছবি
চক্ষে মোহাম্মদ রসূল
শিরোপরি মোর খোদার আরশ
গাই তারি গান পথ বেভুল।
২.
আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ
এই পথে মোর চলে যেতেন নুরনবী হযরত।
৩.
ত্রিভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলরে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়
ধূলির ধরা বেহেশত আজ, জয় করিল গেলরে লাজ
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারা।
৪.
সাহারাতে ফুটলরে রঙীনগুলে লালা
সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা
চেনে রসিক ভোমরা বুলবুল সেই ফুলের ঠিকানা
কেউ বলে হযরত মোহাম্মদ কেউ বা কমলী ওয়ালা।
৫.
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে।
৬.
তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি, খোদায়ী-কালাম
ঐনামের দামন ধ’রে আছি- আমার কিসের ভয়
ঐ নামের গুনে পাবো আমি খোদার পরিচয়
তাঁর কদম মোবারক যে আমার বেহেশতী আঞ্জাম
মুর্দিশ মোহাম্মদের নাম।
আল্লাহকে পেতে হলে রসূলের অছিলা চাইতে হবে। কবি বলেন:
আল্লাকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালবেসে
আরশ কুরসি লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।
রসূল নামের রশি ধরে
যেতে হবে খোদার ঘরে।
কবি আল মাহমুদের ভাষায়:
১.
দূর হোক কালো
সামনে পেছনে জ্বালো
আলো আর আলো।
আলোতে আলোর মেলা
তুমি নবী ভালো
তোমার পরশে ভালো
হয় আরও আলো।
(আলো, সাহিত্য সংস্কৃতি: সীরাতুন্নবী (সা.) সংখ্যা ২০১৫)
২.
লাঞ্ছিতের আসমানে তিনি যেন সোনালী ঈগল
ডানার আওয়াজে তার কেঁপে ওঠে বন্দীর দুয়ার;
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাহেলের সামান্য শিকল
আদিগন্ত ভেদ করে চলে সেই আলোর জোয়ার।
৩.
গভীর আঁধার কেটে ভেসে ওঠে আলোর গোলক,
সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ;
তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের দোলক
বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।
(হযরত মোহাম্মদ, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)
কবি ফররুখ আহমদ তার কাব্যগ্রন্থ `সিরাজাম মুনীরায়` লিখেছেন:
তুমি না আসিলে মধুভার ধরায় কখনো হত না লুট,
তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতো না তার পত্রপুঠ,
সেদিন পূর্ণ মাটির মানুষ আনলে যে দান পূর্ণতার
আরব ঊষার নিখিল চিত্তে আজোও সে জাগায় গুলে আনার
মক্কার মরু নিল না তোমার প্রাণ রসে ভরা আবহায়াত
দূর ওয়েসিস পারে, মদিনার দরদি আকাশ বাড়ালো হাত।
গলেছে পাহাড়, জ্বলেছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তোমার সাথে,
তোমার পথের যাত্রীরা কভু থামেনি চরম ব্যর্থতাতে
তাই সিদ্দিক পেয়েছে বক্ষে অসম সত্য সিদ্ধু দোল
তাই উমরে পাতার ডেরায় নিখিল জনেরও কলরোল
কবি শাহ মুহাম্মদ সগীরের ভাষায়:
জীবাত্মা পরমাত্মা মোহাম্মদ নাম
প্রথম প্রকাশ তথা হৈল য়নুপাম।
যত ইতি জীব আদি কৈলা ত্রিভুবন
মুহাম্মদ হস্তে ফৈলা তা সব রতন।
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত শাহ মুহাম্মদ সগীরের পুঁথির পাঠ থেকে; অধ্যাপক সুলতান আহমদ ভুইঁয়া কর্তৃক `কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর ও তাঁর আবির্ভাবকাল` প্রবন্ধে উল্লেখিত।)
সৈয়দ সুলতানের কবিতার শুরুতে আমরা রাসূলের (সা.) প্রশস্তির কিছু ছত্র লক্ষ্য করি:
আহমদ হোস্তে নূর কৈলা মকার
আহাদ আহমদ দুই এক কলেবর।
আহাদে পাইলি যদি আহমদ দর্শন
হৈয়া ভাবরূপ কৈলা নিরীক্ষণ।
(সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মহানবী (সা))
কবি হাদী মুহাম্মদ ( ১৫৫০-১৬২০ খ্রি.) তাঁর `সুরত জামাল বা নূরজামাল` কাব্যে রাসূলের (সা.) প্রশংসায় বলেন:
আল্লাহর দোস্ত নবী মুহাম্মদ পয়গাম্বর,
বহু দরূদ হৈল যাহার উপর।
সেফায়েত করিবারে যত গুনাগার।
তরিবারে আশা কর সাফাতে যাহার।
কবি শেখ চাঁদ ( ১৫৬০-১৬২৫ খ্রি.) তাঁর `তালিব নামা` কাব্যে লিখেছেন:
বন্দম নূর মোহাম্মদ হাবিব আল্লাহর,
চৌদ্দ ভুবনের পীর মহিমা অপার।
আউলিয়া আখেরে করি একিদা নূরের,
গুনা মাফ করাইব চৌদ্দ ভুবনের।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মুহাম্মদ খান ( ১৫৮০-১৬৫০ খ্রি.) তার `সত্যকলি বিবাদ সংবাদ` কাব্যে রাসূলের (সা.) স্তুতি গেয়েছেন এভাবে:
যার পদরেণু হন্তে পাতকী উদ্ধারে।
যার গুণের অন্ত কহিতে না পারে।।
সব সিদ্ধি মাহদাতা ভবকল্প চারু।
সেবক বৎসল পর উপকার চারু।
মধ্যযুগের বিশিষ্ট কবি আলাওলের রচনায় এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় `পদ্মাবতী কাব্যের` `হযরত মুহাম্মদের (সা.) সিফাতের বয়ান` কবিতায় উল্লেখ আছে:
পূর্বেতে আছিল প্রভু নৈরূপ আকার।
ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার।।
নিজ সখা মুহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা
সেই সে জ্যোতির মূলে ভুবন নির্মিলা।
সম্মুখে পুস্তক কথা আছে, অতি ভার।।
তাহান পীরিতে প্রভু সৃজিল সংসার।
অষ্টাদশ শতকের কবি হেয়াত মামুদ ( ১৬৬৩-১৭৬০ খ্রি.) তার `জঙ্গনামা কাব্যে` লিখেছেন:
নবীর চরণ বন্দো করিয়া ভকতি।
যাহার চরণ বিনে অন্য নাহি গতি।।
মুক্তি পদ হএ যার কালেমা পড়নে।
অন্তকালে উদ্ধারির উম্মত আপনে।।
তিনি তার `হিতজ্ঞান বাণী` গ্রন্থে রাসূল (সা) সম্পর্কে বলেন:
আহাদ আহম্মদ দুই এক করি জান।
মীমে মহাম্মদ শেষে কৈল উপাদান।।
স্বর্গেতে সকলে জপে নাম আহম্মদ
মর্তপুরে জপে লোক নাম মহাম্মদ।।
প্রিয় নবীর জীবনদর্শকে স্মরণ করে কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন:
হে রাসুল আজিকার এই পূন্য প্রভাতে আলোকে,
তোমার সালাম করি-দূর হতে পরম পুলকে
জাগিয়া উঠুক আজি এই দিনে আমাদের মনে
কি অসীম শক্তি আছে লুকাইয়া মানব জীবনে।
(ফাতেমা-ই-দোয়াজহম)