আপনার বাসা আগে বুনি

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১২, ২০২৩

সত্তরের দশকের শুরুর দিকের কথা। তখন আমি ক্লাস ওয়ানে বা টুয়ে পড়ি। সেই সময় সবুজ সাথী প্রথম বা দ্বিথীয় ভাগ বইয়ে একটি ছড়া পাঠ্যভুক্ত ছিল। ছড়াটির নাম ‘কাজের লোক’। লিখেছেন নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ছড়াটি এরকম :

কাজের লোক

মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।

ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।

ছোট পাখি, ছোট পাখি
কিচিমিচি ডাকি ডাকি
কোথা যাও বলে যাও শুনি।

এখন না কব কথা
আনিয়াছি তৃণলতা
আপনার বাসা আগে বুনি।

পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।

শীতের সঞ্চয় চাই
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিলপিল চলি।

এই ছড়ার অনেকগুলো শব্দ আমি বুঝতাম না। যেমন ‘আহরণে’, ‘কব’, ‘তৃণলতা’, ‘সঞ্চয়’ ইত্যাদি। আর বুঝতাম না “ওই ফুল ফোটে বনে” পঙ্ক্তির ‘ওই ফুল’। ‘ফুল’ বুঝতাম। কিন্তু ‘ওই ফুল’ কী?  এই সব না-বোঝা কোনো বিষয় ছিল না। ঝামেলা ছিল অন্য জায়গায়। ছড়াটি যখন আমি  উচ্চৈঃস্বরে পড়ছিলাম তখন হঠাৎ থেমে গেলাম। শব্দটি দেখে আমার খুবই হাসি পাচ্ছিল, আবার লজ্জাও লাগছিল। আমি যখন বার বার ওই একই জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছিলাম, তখন আমার বড় ভাই ঘরে ঢুকে প্রথমে আমাকে একটি চর লাগাল। বলল, “কিরে, পড়ছস না কিলিগা? সমস্যা কী?” আমি খুব লাজুক হাসি দিয়ে বড় ভাইকে ওই শব্দটি দেখালাম। শব্দটি  ‘বুনি’।

আমাদের গ্রামে মেয়েদের স্তনকে ‘বুনি’ বলে। ওই শব্দটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত, কারণ গ্রামীণ জীবনে এই শব্দটির বহুল ব্যবহার ছিল। কিন্তু এমন একটি লজ্জাকর শব্দ ছড়াটির মধ্যে আছে, এটাই আমার কাছে খুব লজ্জা আর হাসির বিষয় ছিল। ভাই খেয়াল করেছে, ওখানে এসে আমি থেমে যাই আর লজ্জা পেয়ে মিটমিট করে হাসি। ভাই বলল, “খুব পাকনা হইছস, না! তুই যে মা-র বুকু দুধু খাতি এইটা হেই বুনি না। এইডা অইল মা যে কাঁথা সেলাই করে হেই বুনন। কাকু যে জাল বানায়, হেইডা অইল বুনন। বুনি মানে অইল বুনন করি। বুঝলি, ফাজিল কোথাকার।” কাঁথা সেলাই করা বা জাল বানানো আমি বুঝেছি। কিন্তু বুনন শব্দটা তখনো বুঝিনি। জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, বুনন কী?” ভাই বলল,  “সেলাই করা। পাখিরা খরকুটু এনে ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে করে বাসা বানায়। ওডারেও কয় বুনন। কাকু যে জাল বানায় ওইডাও বুনন। খেতে ফসলও বোনা হয়, বুঝলি? শব্দটার অর্থ তখনো যে আমার কাছে  খুব পরিষ্কার হয়েছে, তা নয়। তবে আমি এইটুকু বুঝেছি যে, শব্দটির অর্থ আর যাই হোক, মেয়েদের স্তন নয়।

এক দাদি কাঁথা বুনছিলেন। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদি আমনে কী করেন?” দাদি খুব রেগে গেলেন। বললেন, “তুই কি কানা, দেহস না আমি কী করি?  খ্যাতা সিলাই।” শীতের সেই দিনগুলোতে আমি কাঁথা সেলাই করা অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু তারা কেউই বলেনি যে কাঁথা বুনছে। সবাই বলেছে কাঁথা সেলায় করছে বা কাঁথা বানাচ্ছে। কাকুকেও একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কাকু, আমনে কী করেন?” কাকু খুব অবাক হয়েছিল। বলেছিল, “কিরে বাবা, তোর কী অইছে? দেহস না জাল বানাই? এইডা জিগানের কী আছে।” পাখিদের  তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না যে, “হে পাখি, তুমি কি করছ, বাসা বুনছ?” সুতরাং বাস্তব জীবনে বুনন শব্দটি প্রয়োগ একেবারেই ছিল না। এমন কি ফসল বোনার কথাও আমি কখনো শুনিনি।

ওই কবিতাটি পরদিন স্কুলের পড়া ছিল। থার্ড স্যার আমার কণ্ঠস্বর পছন্দ করতেন। তিনি বললেন, “মান্নান, তুই পড়। বালা কইরা পড়বি, সবাই যেন ঠিকমত হোনে।” আমি ঠিক মতই পড়ছিলাম। যখন পড়লাম, “আপনার বাসা আগে বুনি” তখন কয়েকটি দুষ্ট ছেলে ফিক করে হেসে দিল। আমি পড়া থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “বুনি আইল বুনন করা। যেমন কাঁথা বোনা, জাল বোনা, বাসা বোনা, ফসল বোনা। আপনার বাসা আগে বুনি মানে অইল নিজের বাসা আগে বানাই, বুঝলি?” ভাই আমাকে এভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল।

থার্ড স্যার খুব অবাক হয়েছিলেন। বললেন, “বালা, তুই তো অনেক কিছু জানস দেহি।”
আজ বুঝি শব্দই ভ্রহ্ম। আদিতে শব্দ, অন্তে শব্দ, বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড শব্দময়। সেই শব্দ নিয়ে আমরা কী করেছি? কত রকমের অভিধান থাকতে পারত আমাদের। বয়স ভেদে শিশুদের জন্য রঙিন ছবি দিয়ে অভিধান করতে পারতাম। হাজার রকমের অভিধান থাকতে পারত। মানুষ অভিধান, বৃক্ষ অভিধান, মৎস্য অভিধান, পক্ষী অভিধান, পশু অভিধান, দেহ অভিধান, খেলনা অভিধান, খেলা অভিধান, পানি অভিধান, খাদ্য অভিধান, স্বাস্থ্য অভিধান, রং অভিধান, পোশাক অভিধান, শস্য অভিধান, বই অভিধান, গৃহস্থালি অভিধান এবং এমনকি ভূত অভিধান-  এমন অসংখ্য অভিধান রচনার প্রকল্প গ্রহণ করতে পারত শিশু একাডেমী বা বাংলা একাডেমি। সেটা তারা করেনি। শিশু একাডেমী কিশোরদের জন্য রঙিন ছবিসংবলিত অভিধান প্রণয়ন করেছে, কিন্তু সেই অভিধান প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো কাজে লাগে না। এ ধরনে অভিধান এসসিটিবিও প্রণয়ন করে বিনা পয়সায় শিশুদের মধ্যে বিতরণ করতে পারত। সেটা তারা করেনি। করার কথা ভাবেওনি।

আমাদের দেশে যারা শিশু সাহিত্যিক, তাদের অধিকাংশই শিশুদের শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা রাখেন না। শৈশবের যে জীবন একজন লেখক অতিক্রম করে এসেছেন, সেই জীবনের দিকে ফিরে তাকালেই তিনি বুঝতে পারতেন যে, শিশুদের শব্দভাণ্ডার নৈয়ায়িক সূত্রে গ্রন্থিত হয় না। ব্যাকরণ মানার কোনো দায় তাদের নেই। ভাবনার ক্ষেত্রে তারা যেমন ফেন্টাসি প্রবণ তেমনি শব্দও তাদের তৈরি হয় আজব সব যুক্তির মধ্য দিয়ে। সেই জগৎ বোঝার ক্ষমতা বয়স্কদের থাকে না। শিশু সাহিত্যিকদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তাদের লেখা ছড়া, কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাস পড়লে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, শিশুতোষ শব্দের জগৎ সম্পর্কে তারা যথেষ্ট আগ্রহী নয়। ফলে আমাদের দেশের শিশুসাহিত্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বয়স অনুযায়ী বিভাজন করা যায় না।

ওই সব সংস্থা ও প্রকাশকদের বলব, অপনারা এই উদ্যোগ নিতে পারেন। ব্যবসা খারাপ হবে না। তবে বেশি লাভবান হবে আমাদের শিশুরা।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক