আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০১৯
একটা প্রশ্ন দিয়ে এ আলাপ শুরু করা যায়। এই দিবস আসলে কি জিনিস, আমরা দিবস বলতে কি বুঝি? আমরা বলতে পারি, দিবস মাত্রই কোনো নির্দিষ্ট দর্শনচর্চাকে জাতীয়করণ করা বা জনগণকে সে চর্চায় সংযুক্ত করা। এখানে অবশ্য জনগণ খুব সরলীকরণ শব্দ হয়ে যায়। কারণ নারী দিবসের সাথে এই সরলীকরণের ইতিহাস জটিলভাবে জড়িত। কিভাবে জড়িত সে প্রশ্নও উঠে আসে, জনতা বা জনগণ শব্দ দ্বারা আসলে যা করা হয়, তা হলো ‘শ্রেণি’ উপেক্ষা করা। তাই সমাজে শ্রেণি বিলুপ্ত করতে হলে শ্রেণিকে আলাদাভাবে দেখতে হবে আগে।
তাই একটা গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে, নারী কি আলাদা কোনো শ্রেণি? অবশ্যই না, নারীকে আলাদা শ্রেণি বলার অবকাশ নাই। হ্যাঁ, শারীরিক গঠনে নারীর ভিন্নতা আছে। তাহলে আরেকটা প্রশ্ন উঠে আসে, নারী কি তাহলে অর্থনৈতিকভাবে আলাদা শ্রেণি? এখানেই আলাপ শুরু হয়। কারণ সভ্যতা যতই অগ্রসর হয়েছে, উৎপাদনের সাথে সাথে যে বড় ঘটনা ঘটেছে, সেটা হলো শ্রেণির উদ্ভব। ফলে আগে এই সিদ্ধান্তে আমাদের আসতে হবে যে, নারী আজ ভিন্ন এক শ্রেণিতে এসে উপস্থিত হলো সেটার কারণ ওই ‘উৎপাদ সম্পর্ক’।
ফলে নারী দিবস মাত্রই নারীর শ্রেণি আলাপ। তাহলে কোন নারীর আলাপ জরুরি এখন? কারণ প্রতি শ্রেণিতে তার নিজের ক্রাইসিস আছে। উদাহরণ টানা যায়, যেমন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী যে স্বাধীনতা জরুরি, হয়তো একই সময় শ্রমিক শ্রেণির নারীর সে স্বাধীনতা জরুরি না, বরং তার দাবি অন্যকিছু।
আর শ্রেণির প্রশ্নে সবচেয়ে নিচের শ্রেণির বিকাশ সবার আগে জরুরি, তবেই উপরের শ্রেণির সাথে ধীরে ধীরে তার সমতা হবে। তখনই পরিবর্তন সম্ভব। নারীর সর্বজনীন ধারণা পরিষ্কার করা জরুরি। আমরা প্রচলিত ধারণা দিয়েই নারীকে বোঝার চেষ্টা করি। আর সেটা কিছুটা এমন—
যা একটি মেয়েকে নারীত্বে পৌঁছে দেয় সেই রজঃস্রাবের শুরুকেই সাধারণত নারীত্ব শুরু বলে ধরা হয়। অর্থাৎ শারীরিকভাবে মেয়েটির জন্মদানের সক্ষমতার প্রাকৃতিক সাক্ষ্য সদ্যকিশোরীটিকে নারীহিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। অনেক দেশেই নারীত্বে পদার্পণকে বিভিন্ন সামাজিক বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়। যেমন, হিন্দুদের ঋতুশুদ্ধি উদযাপন এমন এক অনুষ্ঠান। এছাড়া ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান সমাজের কোনো কোনো স্থানে এরকম অনুষ্ঠানাদি দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ থেকে ২১ বছর মধ্যবর্তী কোনো একটি নির্দিষ্ট বয়সের জন্মদিন পালনের সময় বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপনের মাধ্যমেও নারীত্বে পদার্পণমূলক অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
প্রায় সকল সংষ্কৃতিতেই কুমারীত্বের সাথে পারিবারিক সম্মান জড়িত থাকায় সেখানে মেয়ে শব্দটি কখনো বিয়ে হয়নি এমন নারীকে পরিচয় করাতে ব্যবহৃত হয়। বিয়ের আগে কোনো নারী যৌনসম্পর্ক করেছে বলে প্রমাণিত হয়, তবে তা পরিবারের জন্য অসম্মানকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ইংরেজি `মেইডেন` শব্দটি অবিবাহিত নারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
এটাই মোটামোটি নারী সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা। দর্শনের ছাত্র হিসেবে এই আলাপ আরো দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু আজ দিবস বিষয়ক আলাপ যেহেতু সেজন্য আমরা উপরের শ্রেণি আলাপের পর সরাসরি একটা অনুবাদ দিয়েই আপাতত আলাপ শেষ করব।
যার লেখার অনুবাদ এখন আমরা পড়ব, তার নাম অনুরাধা গান্ধী (১৯৫৪- ১২ই এপ্রিল, ২০০৮)। তিনি ভারতীয় বিপ্লবের একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক ও চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন মুম্বাই ও নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং এই দুই শহরে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীতে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় বনাঞ্চলে জনগণের উপর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধ আন্দোলনে যুক্ত হন এবং সিপিআই’র (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় সদস্য ও কেন্দ্রীয় মহিলা উপ কমিটির প্রধান হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ছিলেন দৃঢ়, নির্ভীক এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দূরদর্শী বিবেচক। ১৯৮৩ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সদস্য কোবাদ গান্ধীকে বিয়ে করেন। দুঃখজনক ভাবে ২০০৮ সালের এপ্রিলে দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলের গেরিলা জোনে সেরেব্রাল ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দিনটিতেও তিনি নারী ক্যাডারদের নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নয়নের উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। উনার মূল লেখার এই অনুবাদ ‘লাল সংবাদ’ এ প্রকাশিত হয় প্রায় তিন বছর আগে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস: অতীত ও বর্তমান
অনুরাধা গান্ধী
২০০১ এর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ৯১তম বার্ষিকী যা ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম ঘোষিত হয়। সে বছর সমাজতান্ত্রিক শ্রমজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমেরিকার শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্লারা জেটকিন বাৎসরিকভাবে নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব পেশ করেন। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সভায় নারী অধিকারের আন্দোলনকে মর্যাদা প্রদান করতে ও সারা বিশ্বে নারীদের ভোটাধিকার অর্জনে সহায়তার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত একটি নারী দিবস চালু করা হয়। ১৭টি দেশের ১০০ জনেরও বেশি নারীদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। দিবসটি পালনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নির্বাচন করা হয়নি।
এই সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে দশ লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ এক র্যালিতে অংশগ্রহণ করে। ভোটের অধিকার ছাড়াও তারা কাজ ও কারিগরী প্রশিক্ষণের অধিকার ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বন্ধের দাবি জানায়। জার্মানিতে নারীরা ১৯ মার্চ দিনটি বেছে নেয়, কারণ ১৮৪৮ সালের এই দিনে এক সশস্ত্র বিদ্রোহের সময় প্রুশিয়ার রাজা নারীদের ভোটাধিকারসহ অনেক রকম সংস্কার সাধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৯১৩ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনটি বদলে করা হয় ৮ মার্চ। ওই দিনে ঘটে যাওয়া দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মরণে এটি করা হয়। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের নারী শ্রমিকেরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ ও নিম্ন মজুরি প্রদান ইত্যাদি অমানবিক অবস্থার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এতে পুলিশ হামলা চালায় ও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দুই বছর পর আবারো মার্চ মাসে এই নারীরা প্রথমবারের মতো একটি ইউনিয়ন গঠন করে। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ পুনরায় সীমিত কর্মঘণ্টা, উন্নত মজুরি, ভোটাধিকার ও শিশু শ্রম বন্ধের দাবিতে ১৫,০০০ নারী নিউ ইয়র্ক শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
তাদের শ্লোগান ছিল, ‘রুটি ও গোলাপ’। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক হলো, রুটি এবং জীবনযাত্রার উন্নত মান বোঝাতে গোলাপ। সে বছরের মে মাসে আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক পার্টি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রোববার দিনটিকে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্য মনোনীত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালিত হয় ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। শীঘ্রই ইউরোপের নারীরা ফেব্রুয়ারির শেষ রোববার দিনটিতে নারী দিবস উদযাপন করতে আরম্ভ করে। এই পটভূমিতে ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রস্তাব পেশ করেন।
১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো এ দিবস উদযাপনের এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্র্যাজিক ট্রায়াঙ্গেল ফায়ারে’ (‘Triangle Shirtwaist Factory’তে সঙ্ঘটিত অগ্নিকাণ্ডে) ১৪০ জন শ্রমজীবী নারী নিহত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম আইনে এই ঘটনা সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে আরো বেগবান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯১৩ সালে রুশ নারীরা প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। পরের বছর ৮ মার্চ কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে ইউরোপে নিপীড়িত নারীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে নারীরা র্যালির আয়োজন করে। সব থেকে বিখ্যাত শ্রমজীবী নারী দিবস ছিল ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ (রুশ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি)। এদিন সেন্ট পিটার্সবার্গের রুশ নারীদের নেতৃত্বে ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে হরতাল পালিত হয়। ক্লারা জেটকিন এবং আলেকজান্দ্রা কোল্লনতাই উভয়েই এতে অংশগ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের হরতালে দাঙ্গা তৈরি হয় যা ৮ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (এটি এ নামেই পরিচিত) ফলে জারের পতন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ৮ মার্চকে বীর নারী শ্রমিকদের বীরত্ব উদযাপনের পাশাপাশি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। তখন থেকে ৮ মার্চ এর তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পৃথিবীজুড়ে দিনটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার প্রসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় যা সারা বিশ্বের নারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা ছিল।
১৯৪৯ সালের চীন বিপ্লব দেখিয়ে দিল সামন্তীয় মূল্যবোধ ও পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটিতে নারীরা পরিবর্তনের জন্য কী করে জেগে উঠতে পারে। সমাজতান্ত্রিক চীনে নারীরা যে বিরাট পদক্ষেপটি নিয়েছিল তা ছিল গোটা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের জন্য একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত। চীনে নারীদের ক্ষমতায়নের একটি বড় উৎস্য হিসেবে বিশেষ ভাবে কাজ করেছে মহান প্রলেতারিয়েত সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও সামন্তীয় কনফুসিয় ধ্যান ধারণার উপর এর নিরন্তর আক্রমণ। কমরেড চিয়াং চিয়াং ছিলেন এর জীবন্ত প্রতীক।
১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক উত্থান ঘটে এবং তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতাশালী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠে এবং এসময় নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনেও পুনর্জাগরণ ঘটে। গোটা বিশ্বে এই আন্দোলন এত বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল যে সাম্রাজ্যবাদীরা আত্তীকরণের মাধ্যমে একে স্বপক্ষে এনে ও নিজেদের গ্রহণযোগ্য পথে এর গতি পরিবর্তন করে একে ধ্বংস করতে চাইল। আত্মীকরণের মাধ্যমে স্বপক্ষে টানার এই প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ রূপ হলো ১৯৭৭ সালে ৮ মার্চকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি প্রদান।
সেই থেকে চরম বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোও ৮ মার্চ ‘উদযাপন’ করে আসছে। অবশ্য যে বিপ্লবী উপাদান ও সংগ্রামের ইতিহাস থেকে এর উদ্ভব সেটুকু তারা বর্জন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে চীনে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটে যা এই অবস্থার পিছনে অনুঘটকের কাজ করে। এই সব পরিবর্তনের ফলে প্রথম যে ক্ষতিটা হয় তা হলো সমাজতন্ত্রের অধীনে নারীদের অর্জিত কিছু অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানানো। তারপরেও বিশ্বের নিপীড়িত নারীদের মাঝে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বেঁচে আছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রের সাময়িক অবনতি এবং পুঁজিবাদের/সাম্রাজ্যবাদের পুনর্বহাল নারীদের কঠিন আঘাত করেছিল।
বিশ্বায়ন ও এর সাথে চূড়ান্ত ভোগবাদের ফলে নারীদের যে মাত্রায় পণ্যায়ন ঘটেছে তা আগে শোনা যায়নি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতি কোনো ধরনের সম্মান না দেখিয়ে প্রসাধনী শিল্প, পর্যটন ও বুর্জোয়া গণমাধ্যম এমনভাবে নারীদের মর্যাদার হানি করেছে যা পূর্বে কখনো ঘটেনি। এর সাথে গণ দারিদ্র্য যোগ হয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে দেহব্যবসার দিকে ঠেলে দিয়েছে যেমনটা ঘটেছে পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, নেপাল ইত্যদি স্থানে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং বিভিন্ন উপদলের উত্থান যা নারীদের আরেকটি অংশকে প্রাচীন অন্ধকার যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দুই চরমপন্থীর মাঝখানে চাপা পড়ে নারীরা আজ তাদের পুরুষ প্রতিমূর্তির সাথে স্বাধিকারের, আত্মমর্যাদার ও সমতার প্রয়োজনীয়তা আগের থেকে অনেক বেশি করে অনুভব করছে। সুতরাং, আজ ৮ মার্চের তাৎপর্য আরো বেশি।
সংশোধনবাদী ও বুর্জোয়া উদারবাদীরা সহানুভূতিশীল ত্রাতার ভূমিকায় অভিনয় করে ও ছদ্ম ‘উদ্বিগ্নতা’ দেখিয়ে নারীদেরকে গৃহবন্দি করে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্তিমিত করার পায়তারা খোঁজে। তারা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামন্তীয় ধ্যান ধারণার সাথে আপোষ করে আর নারীদের ক্ষমতায়ন ও স্বাধিকারকে ভয় পায়। অবশ্য এরাও রুটিনমাফিক নারী দিবস ‘উদযাপন’ করে এবং নিয়মিত ভণ্ডামিপূর্ণ বিবৃতি দেয়। পৃথিবীজুড়ে বিপ্লবী শক্তি বিশেষ করে মাওবাদীরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মাঝে জীবনীশক্তি ফিরিয়ে এনেছে; দিনটিকে তারা আরো একবার সকল পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শোষণমূলক রীতি থেকে মুক্তির জন্য, আত্মমর্যাদার জন্য, সমতা ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভারতসহ সারা পৃথিবীর নিপীড়িত নারীদের মাঝে ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে এই বিপ্লবী চেতনা।
অনুবাদ সূত্র: Scripting the Change- Selected writings of Anuradha Ghandy