আনোয়ারা আল্পনার গল্প ‘এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফির ক্লাস থেকে বেরিয়েই অরা উল্টো হাঁটা ধরে।
আজও ধরল।
বলল, আজ বাসায় যাব না। হলে থাকব। কহিনূর হীরা যেতে বলেছে। সকালে আম্মাকে ফোন করেছে। আম্মা আল্লাদ করে বলছিল, কেন গো মা? তখনি বুঝেছি কহিনূর হীরা ফোন করেছে।
আমি চোখের পাতা কাঁপতে দেই না। গলার স্বর একজায়গায় রেখে বলি, চল, তোকে হলে এগিয়ে দিয়ে বাসায় যাই।
অরা বলতে থাকে, আম্মা তখন আমাকে কিছু বলেনি। ক্লাস শেষ করে এখানে এলাম যখন, তখন ফোন করল। বলল, কহিনূর তোকে হলে যেতে বলেছে।
রাতে থাকব? আম্মা বলল, হু।
এরপরই ধাম করে অরা বলল, বুঝলি শুভ্র, এই দুই মহিলা আর তুই না থাকলে আমি গৌতম বুদ্ধ হতে পারতাম।
আমি হো হো করে হাসলাম, তুই গৌতম বুদ্ধ হয়ে গেছিস অলরেডি। যে মেয়ে রাশেদ ভাইকে বিয়ে করে না সে গৌতম বুদ্ধই।
অরা বলল, আমি তো করতে চাইলাম বিয়ে। সেদিন হলো কী, ফটোগ্রাফির ক্লাসে মিথিলা আপা রুল অব থার্ড পড়াইল না? সেদিনই রাশেদ ভাই বলল, বিয়ের কথা। আমি বললাম, ভাই রাশেদ, আমার জীবন চলবে রুল অব থার্ড মেনে। মানে জীবনের তিন ভাগের একভাগ যাপন করব আমি। যখন পুরা একগ্লাস পানির তৃষ্ণা পাবে আমার, খাব দুই চুমুক। শুনে রাশেদ ভাই কী বলল জানিস?
কী বলল?
বলল, অপরাজিতা শোনো, লোকে তোমাকে অরা ডাকে। বিশ্রি লাগে শুনতে। অরা মানে কী, তুমি কি অরাজনৈতিক? তোমার কহিনূর হীরা তোমাকে অপু ডাকে, সেটাও বাজে। তুমি হলে অপরাজিতা। তুমি জীবনযাপন করবে তিন গুণ চার গুণ করে। আমি বললাম, ফটোগ্রাফি শিখতে গিয়ে আমার জীবনদর্শন বদলে গেছে। আমি ওয়ান থার্ড জীবনযাপন করব। আর বাকি টু থার্ডের দিকে গভীর তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকব।
রোকেয়া হল এসে গেল। অরা ভেতরে ঢুকে গেলে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। টিএসসিতে এসে বসে ফেসবুক খুলতেই অরা নক করল, কদ্দূর গেলি?
রাজু। তুই কী করিস?
হীরাকে চুমু খাই। আচ্ছা একটা কথা বল, তুই মনে মনে কখনো আমাকে চুমু খেতে চেয়েছিস?
যে ঠোঁট কখনো কোনো নারীর ঠোঁট চুমেছে, আমি কভু সে ঠোঁট চুমিব না।
অরা উপরে নীচে দুটো ফোঁটা দিয়ে পাশে ফাস্ট ব্র্যাকেটের ডানদিকের ব্যাকা আঁকে। মানে হাসে।
তুই এক কাজ কর। ওয়ান বাই হান্ড্রেডে চলে যা।
আমি হোয়াট চিহ্ন আঁকি।
যেখানে হীরার ছোঁয়া লাগেনি সেখানে বাঁচ।
কোথায় লাগেনি?
পায়ে। হীরা কখনো আমার পায়ে চুমু খায়নি।
যা ভাগ!
আমি আর সক্রিয় থাকি না। নিষ্ক্রিয় হয়ে বাসার দিকে হাঁটা ধরি।
শিস দিয়ে একটা সুর ভাঁজছি। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম, হায়রে, চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না সরায়ে! একটাই আশার কথা সুরটা তুলতে পারিনি।
অরা আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ইংলিশে। অনার্স হয়ে গেছে। সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। মানে আমাদের বয়স পঁচিশের আশপাশে। যদিও ক্লাসমেট তবুও আমাদের পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। পুরো ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার অরা বলতে গেলে ক্লাসই করেনি। সপ্তাহে এক দুদিন। অবশ্য পরীক্ষা দিয়েছে ঠিকঠাক।
প্রথম দুবছর ক্লাসের কারো সাথেই তেমন কথা হয়নি ওর। আমার সাথে একদম না। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে হঠাৎ একদিন ফেসবুকে নক করল। তারপর টুকটাক কথাবার্তা। কিন্তু কেউ কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই না। বছর খানেক পরে সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে অরা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। সপ্তাহখানেক পরে একসেপ্ট করলাম আমি। তারপর ক্লাসের শেষে একদিন আমাদের অভারচুয়াল পরিচয় হরো। খুবই সাধারণ দেখতে সে। সাজগোজ প্রায় করেই না। শুধু চুলে রঙ করে। প্রায় প্রত্যেক মাসে। আজব সব রঙ। ক্লাসের সবার সাথে একটু একটু করে খাতির হলো ওর। আমারও। থার্ড ইয়ারে উঠে আমরা ফার্স্ট ইয়ারের মতো হই হল্লা শুরু করলাম। সেই সময় অরা আর আমি ঠিক করলাম ফটোগ্রাফি শিখব।
কিছু দিন আগে হীরার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। আমি আর অরা হাঁটছিলাম পাবলিক লাইব্রেরির দিকে। হীরা আসছিল শাহবাগের দিক থেকে। হীরাকে দেখে আমি খুব চমকেছিলাম। এত সুন্দর কেউ হতে পারে ধারণা ছিল না আমার। মাথায় হিজাব যে এত কায়দা করে পেঁচানো যায়, জানিনি। পাঁচ ফিট পাঁচ হবে হাইট। আমি আর অরা দুজনের চেয়েই লম্বা। তার জামাকাপড়, কথাব লা, কাঁধের ব্যাগ সবকিছুই সুন্দর। আমরা তিনজন পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসেছিলাম। হীরা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, অরা কী তোমাকে বলেছে আমি কে?
দুই সেকেন্ডের একটা পজ দিয়ে আমাকে দুই দিকে মাথা নাড়ানোর সময় না দিয়ে বলেছিল, আমি অরার মায়ের প্রেমিকের মেয়ে! কম্পিউটার সায়েন্স, রোকেয়া হল। এমফিল করছি। আর হ্যাঁ, আমি লেখাপড়ায় ভালো। অরার মতো গোল্লা না!
সেদিনের পর হীরা বিষয়ে বয়ান দিয়েছিল অরা, হীরা হলো সেই মেয়ে দুনিয়ার কোনো জটিলতা যাকে স্পর্শ করে না। পাশে বসলেই মনের কষ্ট অর্ধেক কমে যায়। কথা বললে বাকিটা। আর ছুঁয়ে দিলে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু থাকে না। জড়িয়ে ধরলে স্বর্গ। চুমু খেলে স্বপ্তস্বর্গ। যেদিন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস করতে এলাম, সেদিন আম্মা আমাকে নামিয়ে দিয়ে অফিস চলে গেল। ক্লাস শেষ করে অপারাজেয় বাংলা পর্যন্ত কেবল এসেছি, হঠাৎ একটা মেয়ে এসে আমার হাত ধরল। হীরা, সঙ্গে ওর বাবা। নিজের পরিচয় দিয়ে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, আপনারা আমাকে চেনেন? এক রকম হাসি হেসে দুজনে একসঙ্গে বলল, চিনিতো। তুমি হলে অপরাজিতা। কিছুক্ষণ পর হীরার বাবা চলে গেলেন। হীরা আর আমি আরো কিছুক্ষণ বসলাম। হীরা আমাকে বলল, শোনো অরা, আমার বাবা আর তোমার মা দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করে। আমি আঁতকে উঠে প্রশ্ন করলাম, ওরা কী বিয়ে করবে? হীরা বলল, সেটা তারা চাইলেও আমাদের আটকাতে হবে। এই বয়সের দুজন মানুষ একসঙ্গে একবাড়িতে থাকতে গেলে খুব তাড়াতাড়ি আকর্ষণ হারাবে। আমি চাই তারা প্রেম করুক, বিয়ে নয়।
আমার কেমন অদ্ভুত লাগল। বললাম, বাসায় যাব। আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।
প্রায় দুই বছর অরা পালিয়ে বেরিয়েছে। মা থেকে, হীরা থেকে, পড়া থেকে। তারপর একদিন হীরা তাকে জোড় করে ধরে নিয়ে গেছে রোকেয়া হলে। পাশে বসেছে, কথা বলেছে, ছুঁয়েছে, জড়িয়ে ধরেছে, চুমু খেয়েছে। স্বপ্তসর্গ নিয়ে বাসায় ফিরেছে অরা।
অরার হীরাবয়ান শুনে সেদিনই বুঝেছি, অরা এবং হীরা দুজনের কাউকেই পাব না আমি। হীরার সাথে আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে আমার। ওদের বাবা মায়ের সঙ্গে একবার।
রোকেয়া হলের সামনে বসেছিলাম আমি আর অরা। হীরাকে ডাকিনি। হঠাৎ অরার মায়ের ফোন। অরা রোকেয়া হলের সামনেই আছে শুনে বলল, ওখানেই থাক, আমি আসছি, তোমাদের নিয়ে খেতে যাব। কিছুক্ষণ পরেই এলেন, সঙ্গে হীরার বাবা। হীরাকে ফোন করল অরা। গেটে আসো এখনি। আমি অবাক হয়ে ওদের বাবা মাকে দেখলাম। অরার মা অরার মতোই খুব সাধারণ। আর হীরার বাবা অতিসুপুরুষ। অরার মা বয়েসে বড় হবেন। এদের দুজনকেই তাদের প্রথম পার্টনার ছেড়ে গেছেন। একটি করে কন্যাসন্তান দিয়ে গেছেন। তাদের কন্যাদের ছাড়া এই ঢাকা শহর ভাবতেও পারি না আমি শুভ্রকান্তি দাশ। হীরাকে দেখে আবারো ধাক্কা খেলাম আমি। হিজাব ছাড়া। কেবল স্নান করেছে মনে হয়। পিঠে ভেজা চুল। জল পড়ছে এখনো। আমি ওদের চারজনের থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। আমার দিকে পেছন ফিরে হীরা। সাদা জামা পড়েছে, চুল দিয়ে যেখানে জল পড়ছে, সেখানে এই দুপুরবেলা সূর্যের বদলে চাঁদ উঠেছে। তবে হিজাব পড়লে যে মুখটা গোল চাঁদের মতো দেখায়, সেটা বেশি সুন্দর। খেতে যাবে ওরা। আমি এবার এগিয়ে গেলাম। বললাম, আমি এবার যাই। বাসায় খুব কাজ আছে। হীরা বলল, তোমরা দুজনই তো যেতে পারতে। আমরা কেন? পড়িমরি করে এলাম। রেডি হতেও পারিনি, চুল খোলা। অরার মা বলল, কিচ্ছু হবে না, চল। আজ তোমাদের নিয়ে খেতে যাব বলে বেরিয়েছি আমরা। আমি আবার বললাম, আমি বাসায় যাই, মা অপেক্ষা করবে। কিন্তু যুগল আমাদের তিনজনের কাউকেই ছাড়ল না। অরাদের গাড়ি ওর মা ড্রাইভ করে। হীরাদের গাড়ি ড্রাইভার। অরার মা প্রেমিককে নিয়ে নিজের গাড়িতে আর আমরা তিনজন হীরাদের গাড়িতে। গেলাম ফকিরাপুল। নীরবের তিন তলায়। চুল শুকিয়ে গেছে হীরার। বেঁধেও ফেলেছে। হীরা সামনে থাকলে অরাকে তেমন দেখি না আমি। অরার মা আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করছে, আমি জবাব দিচ্ছি। আমাদের বাসা জুরাইন। আমরা দুই ভাই। মা আছে, বাবা নেই। মানে মারা গেছে। একটা টিনশেড দোতলা বাড়িতে থাকি। টিনশেড দোতলা শুনে হীরা হেসে উঠল, কিন্তু পুরোটা হাসতে পারল না। অরা বলল, কী হচ্ছে হীরা? আমি টিনশেড দোতলার ব্যাখ্যা দিলাম। এল আকৃতির একটা একতলা ছিল আমাদের। পরে টিন দিয়ে ওপরে তিনটা ঘর করা হয়েছে। সেগুলো ভাড়া দেয়া হয়। তারপর তাদের চারজনকে আমাদের বাসায় দাওয়াত দিলাম।
আমি অরাদের ঝিকাতলার বাসায় একবার গেছি। আগের দিন রাতে অরা রোকেয়া হলে ছিল। পরের দিন বিকেলে ফটোগ্রাফির ক্লাস শেষে অরা বলল, বাসায় চল।
কেন?
চলই না।
যাব না।
কী হয় গেলে?
কিছুই হয় না। যাব না, আমার ইচ্ছা।
অরা তখন লোভ দেখালো, চল। গেলে এমন কিছু দেখবি, যা জীবনেও দেখিসনি।
বলতে বলতে রিকশা ডাকল। আমাকে জোর করেই রিক্সায় তুলল। ধানমন্ডি থেকে ঝিকাতলা। আমি একটাও কথা বলিনি। অরা গুনগুন করে গান গেয়েছে। কারো বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না আমার। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অরাদের বাসায় ঢুকে চমকালাম। দশতলা বিল্ডিংয়ের টপ ফ্লোরে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। চারদিকে খোলা। জানালার পর্দা সরানো। বাতাস খেলছে পুরো ঘরে। আর বসার ঘর ফুলে ফুলে সাজানো। বাসায় কেউ নেই। অরার মা অফিসে। অরা বলল, তুই বাসা ঘুরে দেখ। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। আমি ভেতরে গেলাম না। বসার ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালাম। একপাশে একটা সাদা গোলটেবিল, তার উপরে একটা বিরাট মোমদানি, অনেক মোমবাতি ফিট করা তাতে। এত বাহারি মোমও আছে! এত বিভিন্ন রঙ! টেবিলের দুই পাশে দুইটা মোড়া। মোমগুলি জ্বলেছে অনেক নিভে যাওয়ার আগে।
অরা এসে দাঁড়াল আমার পাশে। বলল, কালরাতে হীরার বাবা ছিল আমাদের বাসায়। তার খুব ফুল আর মোম পছন্দ। কী যে সুখে আছে ওরা! তবে ওদের ঘন ঘন দেখা হওয়া আটকায় হীরা। আমার সাথে হীরারও ঘন ঘন দেখা হওয়া থামায়। না হলে আমি আর আম্মা দুজনেই ওদের বাপবেটির মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকতাম।
হীরা বলে, প্রেম কেন টেকে না, জানো? প্রেম হলো টবে লাগানো একটা মাধবীলতা গাছ। দেখা হওয়া, পানি। স্পর্শ আর কথা হলো মাটি, আলো। কোনো একটা বেশি হলেই প্রথমে গাছের পাতা হলুদ হবে। ধীরে ধীরে মরে যাবে। টেরও পাওয়া যাবে না কেন মরল।
এরকম একটা রোমান্টিক বাসায় আমি আর অরা একা। অরা বলে, তোর মনে কী আছে বল আমাকে।
আমি হাসি, মনে তো কত কিছু আছে, তোকে বলা যাবে না।
অরা বলে, কিছু হবেটবে নাকি?
যা ভাগ!
অরা খুব সিরিয়াস মুখে বলে, আমি একবার দেখতে চাই, হীরা ছাড়া আর কারো স্পর্শ আমার ভালো লাগে কিনা! শুভ্র, প্রিজ হেল্প।
আমার অস্থির লাগতে থাকে।আমি মনে মনে ঠিক করি, এই দুই জনের থেকে দূরে থাকব। কাল থেকেই। আজকের দিনটা যাক। আমি বললাম, তোদের বাসায় আসছি, কফি খাওয়া, খেয়ে বিদায় হই। খবরদার আমাকে এক্সপেরিমেন্টের টুল বানাবি না।
অরা হাল ছেড়ে দিল। কফি খাওয়ালো। আমি ওদের বাসা থেকে বেরিয়ে হীরাকে ফোন দিলাম, কই তুমি?
হীরা বলল, ইউএস এম্বেসিতে। ভিসার ইন্টারভিউ দিতে আসছি। তুমি কই? আমি ক্যাম্পাসে, ভ্যাবলার মতো মার সাথে দেখা করি। মনে মনে ভাবলাম, আজই শেষদিন, তাই দেখা করতে চাইলাম। কী আর করা! হীরার ফিরতে দেরি হবে। তাই আমি বাসায় রওনা দেই।
হাঁটতে হাঁটতে রাশেদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। রাশেদ ভাই অরার মায়ের কলিগের ছেলে। বুয়েট থেকে পাশ করে জার্মানির কোনও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করে। মায়েদের পছন্দে তারা পরিচিত হয়েছিল। অরাকে পছন্দ করেছিল রাশেদ ভাই। শেষপর্যন্ত আর বিয়েটা হয়নি। অরার আবোল তাবোল কথা, হীরাজটিলতা, অরার মা আর হীরার বাবার প্রেম, এসব ভেবে আর এগোনোর সাহস পায়নি রাশেদের বাবা-মা। রাশেদ ভাই তার পরেও অনেক চেষ্টা করেছে। অরা রাজি হয়নি। অরার মাও খুব চেয়েছিল বিয়েটা হোক। কারণ অরার বাবাও জার্মানিতে থাকে।
আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষার আগে আগে হীরা পিএইচডি করতে ইউএস চলে গেল। যাবার আগে অরা আর আমাকে নিয়ে বসেছিল একদিন।
পাশ করে কী করবে শুভ্র?
আম্মা স্টাইলের এই প্রশ্ন অপছন্দ করেছি আমি। উত্তর দেইনি। অরা বলেছিল, আমরা সিনেমা বানাব। তুমি আমাদের টাকা পাঠাইও। হীরা হেসে বলেছিল,আচ্ছা আমি তোমাদের ফিল্মের প্রডুসার। তার আগে তোমরা কাউকে এসিস্ট করতে পারো। বাবার সঙ্গে এক এফডিসি ডিরেক্টরের খাতির আছে। আরো কী কী যেন বলেছিল। আমি শুনি নাই। অরা শুনেছে মন দিয়ে। কিছুক্ষণ পর শুনি হীরা বলছে, আমি ইউএস গিয়ে মাকে কিছু দিনের জন্য নিয়ে আসব আমার কাছে। মাকে জড়িয়ে কয়েকটা দিন কাটাতে চাই। মায়ের বর আর ছেলেমেয়েরা যদি কিছু বলে, যদি আসতে দিতে না চায়, মাইর দিয়া মাকে নিয়ে একবারে চলে আসব। দেখি রাগে হীরার মুখ জ্বলজ্বল করছে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এই হীরা বাবার প্রেমকে কত না সহজে নিয়েছে। আর মায়ের বেলায় সে এতটা স্বার্থপর! হীরা প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, মাকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না!
হীরার চোখে জল আসে আসে, এমন সময় অরা বলেছিল, তোমার মায়ের বর আর ছেলেমেয়েরা চায় না বলে তুমি মাকে কাছে পাও না? তাতো নয় হীরা। তিনি নিজে তোমাকে ছেড়ে গেছেন! তোমার বাবার সঙ্গে তার সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু এই এত বছরে তোমার সঙ্গে কতটা যোগাযোগ রেখেছেন তিনি? এই অরাকেও চিনি না আমি। এভাবে সে হীরাকে আঘাত করতে পারে ভাবতে পারিনি। হীরা চোখের জল গিলে বলেছিল, ঠিক! মা আমাকে ভালোবাসে না! আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাব না!
নিষ্ঠুরের মতো অরা বলেছিল, যাবা না কেন? যাইও। জোর কইরো না। আর এখানকার যুগলকে কী বলে গেলা?
বলেছি যা বলার। এখন তোমার দায়িত্ব। তবে এবার থেকে তারা আমাদের বাসায় ডেট করবে। তোমাকে বাসা ছাড়তে হবে না।
হীরাকে সি অফ করতে আমি আর অরা গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। হীরার বাবা বা অরার মায়ের যাওয়া আটকেছে হীরা। আমারও সেদিন যাওয়া উচিত হয়নি। ওদের একলা ছাড়া দরকার ছিল। কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়েনি, আমিও ওদের ছাড়তে চাইনি। হীরা একা পেয়ে একফাঁকে আমাকে বলেছিল, অরা তোমাকে বিয়ে করতে চাইলে, কোরো। ও লেসবিয়ান নয়।
ও তোমাকেই ভালোবাসে!
ভুল! ওর এটা মনে হয়, তোমারো মনে হয় আমি জানি। তোমরা দুজন আমাতে সম্মোহিত!
চলে গেল হীরা। আমার আর অরার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সে। কিন্তু বাকি দুই-তৃতীয়াংশের উপরও তারই নিয়ন্ত্রণ।