আনিসুর বুলবুলের গল্প ‘মাতৃত্ব’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৯, ২০২৩
একদিনের টুকটুকে মেয়ে শিশু। শুয়ে আছে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমের সিটে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর মৃদস্বরে কান্না করছে। যাকে কাকে খাবলে খাবলে খাচ্ছিল। নাভিটার চারপাশে ক্ষতবিক্ষত, দগদগে। রক্ত পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে কাকগুলো নাভির রগটাকেই বেছে নিয়েছিল।
ডাক্তার-নার্স-আয়ারা ব্যস্ত। বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে হবে। যান, দুধ নিয়ে আসেন। একজন নার্স এসে বলে গেলেন আমাকে। আমি, সাইফুল আর আফজাল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নার্সের কথা শেষ হতে না হতেই আফজাল `আমি যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি` বলে দিলো দৌড়।
আমি ইমার্জেন্সি রুমের জানালা দিয়ে বাচ্চাটাকে দেখার চেষ্টা করছি। কেমন কাতরাচ্ছে পিচ্চিটা। ওইটুকুন নাক দিয়ে পাইপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন ডাক্তার আরশাদ উল্লাহ। তিনি এই হাসপাতালের আরএমও। পিচ্চিটার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
তুমি এই কাজটা কী করলা? কইতথেকে এই পাপ নিয়া আইছো? হাছেন মুনশির এই কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। হাসপাতালের সামনে উৎসুক লোকজনে ভরে গেছে। হাছেন মুনশির কথা শুনে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাছেন মুনশি হাসপাতাল সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা। এলাকায় মিলাদ পড়ান। আমরা শ্রদ্ধা করি লোকটারে। কিন্তু আজকের এই কথা শুনে তার ওপর খুব রাগ হয় আমার।
পাপ আনছি মানে! আপনি কি বলতে চান?
কি আর কইমু! পাপ বোঝ না তুমি?
এসব কি উল্টাপাল্টা বলছেন আপনি?
কার পাপ ফালাইয়া গেছে, সেটা তুমি নিয়া আইছো! এখন কইতাছো উল্টাপাল্টা কইতাছি!
আপনি এখান থেকে যান তো! আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ছি দেখে সাইফুল হাছেন মুনশিকে টেনে হাসপাতালের বারান্দা থেকে বাইরে নিয়ে যায়।
আমার চোখ আবারও জানালার ফাঁক দিয়ে ওই বাচ্চার দিকে যায়। আস্তে আস্তে মনে হচ্ছে নবজাতক নেতিয়ে পড়ছে। তাকে নাক দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।
কই, দুধ কই! জলদি দেন। আবারও সেই নার্স এগিয়ে এসে আমাদের তাড়া দেন। আমি বারান্দায় দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে আফজালকে খুঁজি। না পেয়ে সাইফুলকে পাঠাই হাসপাতাল গেটে চায়ের দোকানে দুধ আনতে। সাইফুল দৌড় দেয়। আমি ইমার্জেন্সি রুমের ভিতরেও যেতে পারছি না। আবার জানালার কাছ থেকে সরতেও পারছি না। একটা আতঙ্ক কাজ করছে নিজের মধ্যে।
ভাই, নিয়ে আইছি। হাঁপাতে হাঁপাতে আফজাল আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। সাথে দেখি একজন মহিলা। সেও হাপাচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে কোনো দুধের পাত্র নেই। আফজালকে আমি বলি, দুধ কোথায়? আফজাল আর সেই মহিলা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমার কথার কোনো উত্তর দেয় না। আমি আফজালকে ধমক দেই, তুই না দুধ আনতে গেলি?
আফজাল সঙ্গে থাকা সেই মহিলাকে দেখিয়ে বলে, ভাই রাগ কইরেন না। এ আমার বউ।
তোর বউ তো কী!
সাইফুল দৌড়িয়ে আমার কাছে আসে। ওর হাতে একটা ফিডার ভরা দুধ। সাইফুল ফিডার নার্সকে দিতে যায়। আফজাল সাইফুলকে বাধা দেয়। একে তো দুধ আনেনি আবার সাইফুলকে বাধা দেওয়ায় আমার রাগ হয়। আমি আফজালকে ধমক দেই, আফজাল, এসব হচ্ছে কী! তুই ওকে বাধা দিচ্ছিস কেন্?
আফজাল এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরে। বলে, ভাই, ও ভাই .. বাইরের দুধ দিয়েন না ওকে!
বাইরের দুধ দেব না মানে?
আফজাল ওর বউকে দেখিয়ে বলে, আমার দুধের মাইয়াডা কয়দিন আগে মারা গেছে। আমার বউ ওকে দুধ খাওয়াক!
আফজাল আর আফজালের বউ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আফজালের প্রতি আমার রাগটা যে কোথায় উড়ে যায় বুঝতে পারি না! চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে আমার। চোখ মুছতে মুছতে আমি আফজালের বউকে নিয়ে ইমার্জেন্সি রুমের ভেতর যাই।