আনাইস নিন
আনাইস নিনের গল্প ‘টোকানোর সময়’
অনুবাদ: রথো রাফিপ্রকাশিত : এপ্রিল ০২, ২০২০
নোংরা দুর্গন্ধের মাঝে টোকানোর কাজ করে চলতো লোকটা। ছালাটা ফুলেফেঁপে উঠছিল। বামদিকে ধীরে বাঁক নিতো শহরটা। বাঁক নিলেও বাড়িঘরের চোখগুলা বন্ধ থাকতো, আর সেতুগুলাও থাকতো বিচ্ছিন্ন। টোকাই লোকটা কাজ করতো নীরবে, কখনো আস্ত জিনিসপত্তরের দিকে তাকাতো না। তার চোখ ছুটে মরতো শুধু ভাঙা, দুমড়ানো, জীর্ণশীর্ণ, বিবর্ণ যত টুকরাটাকরির দিকেই। আস্ত জিনিস মাত্রই তার মনে বিষাদ সৃষ্টি করতো। আস্ত জিনিস দিয়ে কী করে লোকজন? তাকে জাদুঘরেই রেখে দাও না বাপু। কখনও স্পর্শ করো না। কিন্তু ছেঁড়া কাগজটা, জুতোর জোড়হারা ফিতেটা, পিরিচহারা কাপটা, মন লাফিয়ে ওঠার মতোই জিনিস বটে একেকটা। এদেরই না গলিয়েগালিয়ে ভিন্ন জিনিসে রূপ পাল্টে নেয়া যায়। পাইপের বাঁকাচোরা টুকরোটা। অপূর্ব, হাতলহারা ঝুড়িটা। অপূর্ব, ছিপি ছাড়া এই বোতলটা। চাবিহারা এই বাকসোটা অপূর্ব। অপূর্ব জামার এই আধটা। টুপি থেকে খসে পড়া ফিতেটা, একটা ব্লেড ছাড়া ফ্যানটা। আর কী অপূর্ব ওই ক্যামেরাহীন ক্যমেরার প্লেটটা, সাইকেলের একমাত্র চাকাটা, ফোনোগ্রাফের আধ্ধেকটা।
কত টুকরোটাকরা, একটা সম্পূর্ণ পৃথিবীতে, ন্যাকড়া, ক্ষয়-হওয়া জিনিস, জিনিসের অবশেষ, আর রূপ পাল্টে নেয়ার শুরু... চালাঘরের ভেতরে ন্যাকড়ার টুকরো। বিছানার চাদর হিসেবে ন্যাকড়া কাপড়। চেয়ারের কভার হিসেবে ন্যাকড়াকানি। টেবিল ক্লথ হিসেবে ন্যাকড়ার টুকরাটাকরি। ন্যাকড়ার টুকরোটাকরির ওপর পুরুষগুলা, মহিলাগুলা আর বাচ্চাগুলাও। মহিলাদের ভেতরেও আরো বাচ্চা। রক্তখোর মাছি। পুরোনো শ্যুর ভেতর পড়ে থাকা গোড়ালি। স্টাফড হরিণের ওপর মাথাটা, চোখটা ঢিলে হয়ে ঝুলে আছে তারে।
কাদার ওপর বসে পুরোনো একটা শ্যুকে নৌকোর মতো ভাসানোর চেষ্টা করছে শিশুরা। মহিলাটা কাঁচির একমাত্র ব্লেডটা দিয়ে সূতো কাটে। ভাঙা অক্ষরের এক সংবাদপত্র পড়ে লোকটা। ময়লাভরা বালতিগুলা নিয়ে শিশুরা ঝর্ণার কাছে যায়। তারা আবার লাইম করে, বালতিগুলা ফাঁকা হয়ে পড়ে। তাদের ছালা নিয়ে টোকানে লোকরা জবুথবু হয়ে চলে। ব্যাগ থেকে তারকাটা পড়ে যায়। ছাদের একটা টালি। অক্ষর মুছে যাওয়া একটা বিজ্ঞাপন খুঁটি...
ভাঙা শাটার, জানালার চৌকাঠ, নকল দাঁড়ি, নারকেল, ঘোড়ার লেজ, গত বছরের পবিত্র তালপাতার রাশ দিয়ে ধরানো আগুনের পাশে জড়ো হয়েছে টোকানে লোকগুলা... খুঁড়ো লোকটাও তার কাটাপায়ের গোড়ায় ভর দিয়ে বসে, পা হিসেবে ব্যবহারের লাঠি দুটি পাশে নিয়ে। য্যানত্যান রকম একটা চালাঘর ও জিপসি ঠেলা গাড়িটার ভেতর থেকে বালবাচ্চাসহ মহিলাগুলা বেরিয়ে আসে।
আমি জিগ্যেস করলাম, কেউ কি কোনও কিছু চিরকালেরর জন্য ফেলে দিতে পারে না?
টোকানে লোকটার মুখের কোনায় হাসির ছটা দেখা দেয়, হাসির আধেকটা, হাসির ভাঙা টুকরাই একটা, আর সবাই মিলে গাইতে থাকে।
প্রথমে রসুন-গন্ধা-নিঃশ্বাস ভেসে এলো। রসুন তারা ডেরাগুলার গায়ে ছোট্ট লাল চীনা লণ্ঠনের মতো ঝুলিয়ে রাখে। আর সাপের মতো জড়ানোপ্যাচানো গানটার পিছু পিছু আসতে লাগলো রসুন-নিঃশ্বাস:
হারায় না রে কিছু্ই, পাল্টায় শুধু
পুরানা দড়ি থেকেই নতুন দড়ি
পুরানা ছালা পাল্টায় নতুন ছালায়
পুরানা টিনেই তো নতুন কড়াই
পুরানা খড়েই দেখো নতুন টুপি
শিশুটিই তো হবে রে নতুন মানুষ...
আর নতুন, নতুন নয় রে কখনো
নতুন, নয় রে নতুন
নতুন, নয় রে নতুন
লেখক পরিচিতি: আনাইস নিনের জন্ম ১৯০৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সে। মৃত্যু ১৯৭৭ সালের ১৪ জানুয়ারি। তিনি উপন্যাস, ডায়েরী ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।