আনন্দবাড়ি

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০১৮

ছিমছাপ দোতলা বাড়ি। লাল রঙের। কীরকম শান্ত আর নির্জন। টলটলে সবুজ দিঘির মতো শান্ত যেন। চারদিকে গাছপালা। সারাক্ষণ পাখিরা ডাকাডাকি করে। এছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। খা খা রোদ আলসের মতো পড়ে থাকে লোহার গেটটাতে। ইসকুলে যেতে-আসতে ছায়াবীথি বারবার তাকিয়ে দ্যাখে ভেতরটা। নিচতলার বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার। কখনও সেখানে কাউকে বসতে দ্যাখেনি ছায়াবীথি। তবে কি চেয়ার দুটো খালিই পড়ে থাকে? আবার খালিও না। প্রায় দিনই ছায়াবীথি দেথকে পায়, চেয়ার দুটোর ওপর কয়েখটা পাখি চুপচাপ বসে থাকে। কখনও ডাকাডাকি করে। সামনে ঘেসোজমি। একদিকে ফুলের ছোটটো বাগান। বাড়িটাতে লোকজন আছে বলেও মনে হয় না। শুধু একদিন ছায়াবীথি সুন্দর চেহারার একটি তরুণীকে বসে থাকতে দেখেছিল দোতলার বারান্দায়। তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু ছায়াবীথি চেয়ে চেয়ে তাকে দেখেছিল। কী করছেন উনি? প্রথমে মনে হয়েছিল, বই পড়ছেন। কিন্তু না, উনি আসলে চেয়ে আছেন সামনের দিখে। কী রকম উদাসমুখে। যেন নিজের ভেতর ডুব দিয়ে দিয়ে আছেন।
রোদ চচ্চর হয়ে মাথায় চড়ে যাচ্ছে। ছায়াবীথি আর দাঁড়ায়নি সেদিন।
এরপর আর কাউকে সে দ্যাখেনি। তবে একদিন একটা প্রাইভেট গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার ছিল না। রোদে কী সুন্দর যে চকচক করছিল গাড়িটা! ছায়াবীথির ভালো লেগেছিল। তবে ভালো লাগেনি গাড়িটার এই একা একা থাকা। ড্রাইভার না থাকলে আর গাড়ি কেন? বাড়িটাও কীরকম অদ্ভুত! পাখিদের ছাড়া মানুষের কোনও সাড়া মেলে না। নিজের মতো একা একা থাকতেই যেন বাড়িটার আনন্দ। তাই কি বাড়িটার নাম আনন্দবাড়ি? ছায়াবীথি তা জানে না। তবে বাড়ির সামনে নেমপ্লেটে দে দেখেছে লেখা, আনন্দবাড়ি। আনন্দবাড়ির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে বোঝা যায়, একাকিত্ব নিয়েও বাড়িটার একটা গাম্ভীর্য আছে। আর নির্জনতা।
ছায়াবীথির ধারণা, বাড়িটাতে যারা থাকে তাদের কোনও দুঃখ-টুকখো নেই। এই বাড়িতে থাকলেই যেন আনন্দে থাকা যায়। নিজের মনমতো আনন্দে বেঁচে থাকা মানুষ খুব তো একটা দ্যাখা যায় না। ছায়াবীথি তাই ভাবে, আনন্দবাড়ির সুখি মানুষদেরও এ কারণে দ্যাখা যায় না। তবে তারা যে আছে, এরকম আভাস পাওয়া যায়। আনন্দবাড়ির ভেতর কখনও ঢোকেনি ছায়াবীথির। সুনসান দুপুরে গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। ভেতরটা দেখতে খুব ইচ্ছে হয়েছে কখনও কখনও। কিন্তু সাহস হয়নি।
কালরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তা তাই কাদা-কাদা। ছিঁটেফোটা মেঘ আকাশে। খেয়েদেয়ে ইসকুলে বের হলো ছায়াবীথি। তার পকেটে আম্মু দশ টাকা দিয়ে বললেন, আজেবাজে খাবার কিন্তু খেও না। চকলেট আইসক্রিম খেলে দাঁতে পোকা ধরবে। এরচে বাদাম খেয়ো।
ছায়াবীথিও ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিকাছে আম্মু।
এরপর আম্মু তার থুতনি ধরে একটু নেড়ে দিলেন। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে এই এক আদর আম্মুর। ভারি ভালো লাগে ছায়াবীথির। আম্মুকে তখন মনে হয় রানি। তার রাজকন্যাকে ইসকুলে পড়তে পাঠাচ্ছেন।
আনন্দবাড়ির সামনে এসে ছায়াবীথি থমকে দাঁড়ালো। দোতলার বারান্দায় একজন লোক। জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা। চোখে সানগ্লাস। মোবাইলে কথা বলছেন। হাত নাড়ছেন। দেখে মনে হচ্ছে, উত্তেজিত। কথা শোনা যাচ্ছে না, তবু ফুরফুরে লাগল ছায়াবীথির ভেতর। বাড়িটাকে এ মুহূর্তে আর মনে হলো না যে, সে একা। আড়মোড়া ভেঙে বাড়িটা যেন জানিয়ে দিচ্ছে সুখি মানুষের উপস্থিতি। ভেতর থেকে বারান্দায় এলেন আগের দ্যাখা সেই তরুণী। শাড়ি পরে আছেন। সবুজ শাড়ি। মায়াবী দেখাচ্ছে তাকে। মুগ্ধ হলো ছায়াবীথি। ও আচ্ছা, এনারা তাহলে এ বাড়িতে থাকেন। নিচে ঘাসের জমিতে নীলরঙের একটি প্রাইভেট গাড়ি। আগের গাড়িটা নয়, আরেকটি। তরুণীর চোখ হঠাৎ ছায়াবীথির দিকে পড়ল। ছায়াবীথি গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই কেন যেন লজ্জা পেল ছায়াবীথি। তরুণীর আঙুলের ইশারায় লোকটি তার দিকে ফিরতেই ছায়াবীথি মুখ সরিয়ে নিল। এরপর হাঁটতে আরম্ভ করল। একটি ডাক শুনতে পেল সে। তরুণী মেয়েটি ডাকছেন, এই যে মেয়ে, এই...। ছায়াবীথি দাঁড়ালো না।
ইসকুল থেকে ফেরার সময় গাড়ি আর ওই দুজনকে দেখতে পেল না ছায়াবীথি। তবে মনে হলো না যে, বাড়িটা আগের মতো একা। গাছপালা ঘাস পাখি নিচের বারান্দার দুটো চেয়ার, সবকিছু যেন আনন্দের এক একটা ছবি। দুঃখ যেখানে ঢুকতে পারে না। বাড়িটার প্রতিটি ছবি ঝকঝকে সুন্দর।
বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে সে আঁকতে বসল বাড়িটার আজকের ছবি। প্রায়-প্রায়ই সে আনন্দবাড়ির ছবি আঁকে। একই বাড়ি, কিন্তু প্রতিবার সে আঁকে। কেন আঁকে, তা সে জানে না। দুটো খাতাভর্তি তার এসব ছবি। আম্মু-আব্বু জানেন, ছায়াবীথি ছবি আঁকে। বাড়ির ছবি। কিন্তু কোন বাড়ির ছবি, তা জানেন না। ছায়াবীথি কাউকে বলেও না। বাড়িটার সুখি সুখি চেহারার মানুষজন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে যেন তাদের দেখতে পায়। ঘরগুলো পরিষ্কার তকতকে। কোথাও এতটুকু ময়লা পড়ে নেই। দেয়াল ও মেঝে থেকে হিম হিম শিহরণ জড়ানো শীতলতা উঠে আসে। আরাম লাগে।
ছায়াবীথি? ছায়াবীথি?
খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বাড়ির ছবি দেখতে দেখতে ছায়াবীথি জবাব দিল, এই যে আম্মু।
আয়তো মা এদিকে।
ছায়াবীথি রান্নাঘরে গেল। বটিতে আম কাটছেন আম্মু। বসে বসে আম খেতে থাকে ছায়াবীথি। আম্মু জিগেশ করলেন, কী করছিলে মা?
আম খেতে খেতে ছায়াবীথি বলল, ছবি আঁকছিলাম।
কিসের ছবি?
একটা বাড়ির ছবি। ছায়াবীথির থুতনি আমের রসে মাখামাখি হয়ে গেছে। আম্মু আর কিছু জিগেশ করলেন না। রান্নাঘরের চালার ওপর কাঁঠালগাছে ডেকে উঠল একটা ঘুঘু। বিকেলের নরম রোদ উঠোনের ঘাসে। উঠোনের পরেই বাঁশবাগান। বনজঙ্গল।
আম্মু বললেন, যা তো ছায়া, জগটা ভরে নিয়ায়।
আম খাওয়া শেষ করে ছায়াবীধি জগ নিয়ে গেল টিউবঅয়েলে। পানি খেয়ে জগ ভরে নিয়ে এলো।  বসতে বসতে জিগেশ করল, রুটি বানাবা আম্মু?
আম্মু জবাব দিলেন, হুঁ।
পরোটা খাব।
খেয়ো মা।
আম্মু রুটি বেলতে থাকেন। ছায়াবীথি ছোটটো একটু আটার দলা নিয়ে খেলতে খেলতে জিগেশ করল, আচ্ছা আম্মু বলো তো, কোনও বাড়ির নাম যদি আনন্দবাড়ি হয়, তবে কি বাড়ির লোকজনও আনন্দে থাকে? কখনোই তারা অসুখি হয় না?
একটু অবাক চোখে আম্মু জিগেশ করলেন, কেন রে?
না এমনি, বলো না!
আম্মু এক টুকরো আম মুখে দিয়ে বললেন, হয়। মানুষ বাড়ির নাম এমনি ওরকম রাখে। কিন্তু ধর, সত্যিই যদি আনন্দবাড়ির লোকজন সদাসর্বদা সুখে-শান্তিতে থাকিত, তাহা হইলে কেমন হইত বল তো খুকি?
আম্মুর কথা শুনে ছায়াবীথির সারামুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। জিগেশ করল, তুমি সুখি মানুষ দেখেছো আম্মু?
সে কী আর দ্যাখা যায় রে মা! আল্লার এই দুনিয়ায় সুখ আর দুঃখ সমানে সমান। সুখ থাকলে দুঃখ আছে। দুঃখ থাকলে সুখ আছে। আর তাই কোনও মানুষ পুরোপুরি সুখি হয় না। আম্মু হাসলেন। জিগেশ করলেন, হঠাৎ এই ভাবনা মাথায় কেন রে?
না এমনি। সুকুমার রায়ের গল্পে সুখি মানুষের কথা লেখা আছে। তুমি পড়োনি?
হ্যাঁ, ওই যে রাজার একবার কঠিন অসুখ হলো। চিকিৎসক জানালো সুখি মানুষের জামা পরলে রাজা সুস্থ হবেন। সুখি মানুষ পাওয়া গেল, কিন্তু পাওয়া গেল না তার জামা। সুখি মানুষটার কোনও জামাই ছিল না।
হ্যাঁ আম্মু। কিন্তু সুখি মানুষটির বাড়িটা অনেক সুন্দর। ঝকঝকে। বাড়ির নাম কি জানো আম্মু?
আম্মু মিটিমিটি হাসেন। বলতো শুনি।
আনন্দবাড়ি।
রহস্য ছড়ানো মুখে হাসি ছড়িয়ে আম্মু জানতে চাইলেন, আছে নাকি সত্যি এরকম বাড়ি? কোথায় রে? আব্বুর গল্পে? নতুন গল্প লিখছে বুঝি? তোর আব্বু  শুধু তোকেই গল্প শোনায়, আমাকে তো আর শোনায় না।
ছায়াবীথি ভাবছিল, আনন্দবাড়ি সত্যি সত্যি তো একটা বাড়ির নাম। এ বাড়িতে একজন পুরুষ আর একজন নারী থাকেন। বলবে নাকি সে আব্বুকে? চাইলে আব্বুও এ গল্পটা লিখে ফেলতে পারবেন।
মাগরিবের আজানের পরপরই ফিরল সাবের। পিঠে বইয়ের ব্যাগ। ব্যাগটা নামিয়েই ছায়াবীথির মাথায় ছোটটো একটা টোকা দিয়ে বলল, যা তো মা, গামছাটা নিয়ায়। সাবের টিউবঅয়েলে গেল। ছায়াবীথি নয়, গামছা নিয়ে এলো সূর্যবান। জিগেশ করল, আজ কোথায় গেছিলা?
টিউবঅয়েল চেপে হাতমুখ ধুতে ধুতে সাবের জবাব দিল, শঙ্খডাঙা গ্রামে।
সূর্যবান জিগেশ করল, বই বেচতে পারছ?
সাবের বলল, হইছে কিছু। মানুষ তো এখন আর বইটই পড়ে না। প্রত্যেকে যার যার ধান্দায় ঘোরে। এই যে দ্যাখো, আমি ভেবেছিলাম শঙ্খডাঙা নামটার প্রশংসা করবে তুমি। কিন্তু জিগেশ করলে বাণিজ্যের খবর। শঙ্খডাঙা এলাকাটা আমি ঘুরে এলাম, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষজনের সঙ্গে কথা বললাম। তাদেরকে আমার লেখা বই দেখালাম। বেশিরভাগই মানুষই কেনেনি। যারা কিনেছে তারা আমাকে দেখেই কিনেছে। এটাও আনন্দ বউ। আমি আনন্দের মানুষ, তাই আনন্দে থাকি।
সূর্যবানের হাত থেকে গামছা নিয়ে, কই রে আমার জননী... বলতে বলতে সাবের ঘরে ঢোকে।
রাতে আধেক চাঁদ লটকে রইল বাঁশবাগানের মাথার ওপর। ঝোপঝাড়ের ওদিকে জোনাক জ্বলছে। ডাহুক ডেকে চলেছে কোথাও। উঠোনের এককোণে বাঁশের মাঁচায় বসে ছায়াবীথির সঙ্গে গল্প করছে সাবের।
জানিস মা, শঙ্খডাঙা গ্রামে একটা নদী আছে। নদীর পারে শনের একটা ঘরে থাকে সুখিয়া।
ছায়াবীথি জিগেশ করল, সুখিয়া কে আব্বু?
সুখিয়া তোর মতো একটা মেয়ে। ওর মা ধানভানা চাতালে কাজ করে। সুখিয়া আর তার বুড়ো দাদু বাড়িতে থাকে। সারাদিন সে খকখক করে কাঁশে। সুখিয়া ইসকুলে পড়ে। খুদে বই সে কিনেছে। ওর কাছে জমানো টাকা ছিল। ছায়াবীথির ছড়া পড়ে সে তো ছায়াবীথিকে দেখতে চাইল।
খুশি হলো ছায়াবীথি। মাঁচার ওপর বসে পা দুলিয়ে জিগেশ করল, তাই আব্বু?
সাবের বলল, হ্যাঁ। আরও কি বলল জানিস?
কি বলল আব্বু?
বলল, ছায়াবীথিকে নিয়ে লেখা ছড়া সুন্দর হয়েছে।
বলল বুঝি?
হ্যাঁ। তাই তো বলল। তোর কি মনে হচ্ছে, আমি বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছি?
মাথা নাড়ল ছায়াবীথি। না-না, আমি তা বলিনি। আমি তো জানিই, ছড়াগুলো সুন্দর। আচ্ছা বাবা, সুখি মানুষ নিয়ে তুমি একটা গল্প লিখতে পারবে?
ছায়াবীথির মাথায় টোকা মেরে সাবের জিগেশ করল, সে আবার ক্যামন গল্প রে মা?
ভালো গল্প আব্বু। আমি তোমাকে গল্পটা বলি? এরপর তুমি লিখে ফেলতে পারবে না?
তুই বানিয়েছিস বুঝি?
হ্যাঁ।
হাসি ছড়ালো সাবেরের মুখে। বলল, কস কীরে! আমার ছোটটো ছায়াবীথিও তাইলে গল্প বানাইতে পারে! আম্মুকে বলেছিস?
ঘাড় নাড়ে ছায়াবীথি। না, বলিনি।
তাইলে আমারেই বল। দেখি গল্প লেখা যায় কীনা।
ছায়াবীথি বলতে থাকে, বাড়িটার নাম আনন্দবাড়ি। মাঝ বয়েসী একজন পুরুষ আর একজন নারী থাকেন বাড়িটায়। তারা দুজনই দেখতে খুবই সুন্দর। মানুষের দ্যাখা স্বপ্নের মতো। এই হচ্ছে আমার গল্প। এরপর বাদবাকি তোমাকে লিখতে হবে।
সাবের মেয়েটাকে টেনে নিলেন বুকের ভেতর। তুই যে অনেক কিছু ভাবতে পারিস খুকি? ওরে আমার ছায়াবতী শ্যামলিমারে...
ছায়াবীথি দু’হাত দিয়ে আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর রাখাল ছেলে।
হ্যাঁ, আমার মেয়েটার আরেক নাম তো রাখালছেলে। আর যেন কি নাম রে?
ছায়াবীথির জবাব, আর সবুজপরি আর রাঙাপরি মেহেদি গোল্ড...। জানো আব্বু, আজ ফেরিঅলার কাছ থেকে আম্মু আমাকে রাঙাপরি মেহেদি গোল্ড কিনে দিয়েছে। এই যে হাতে আল্পনা এঁকেছে আম্মু।
ছায়াবীথি দু’হাত সামনে এনে আব্বুকে হাতের আল্পনা দ্যাখায়। চাঁদের আলোয় সাবের মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ছায়াবীথির হাতের আল্পনায়। তার মেয়েটি সারামুখে হাসি ছড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
ঘর থেকে সূর্যবানের ডাক শোনা গেল, কই খাইতে আসো। ভাত বাড়ছি।

খাড়া রোদ। ঝাঁ ঝাঁ করছে চারদিক। ছায়াবীথি ইসকুল থেকে ফিরছে। আনন্দবাড়ির গেটের সামনে দুটো প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়ানো। তিনটে মোটরসাইকেল। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। গেট খোলা। ভেতরেও লোকজন। দোতলার বারান্দাতেও দু’চারজন। সবারই কী রকম যেন দুখি দুখি চেহারা। কেউ কেউ মোবাইলে থমথমে স্বরে কথা বলছে।
অকস্মাৎ নির্জনতা ভেঙে পড়েছে বাড়িটার। কী একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গেছে। বাড়িটার দিকে চেয়ে ছায়াবীথির মনে হলো, আনন্দবাড়িকে সে এই প্রথম যেন দেখছে। গুটি গুটি পা ফেলে গেটের ভেতরে ঢুলক ছায়াবীথি। তার দিকে কেউ ফিরেও দেখল না। নিচতলায় তেমন কিছু সে দেখল না। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে লোকজন উঠছে-নামছে। সবার চোখমুখে কী যেন একটা ইঙ্গিত। পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে সে উঠে এলো। সিঁড়ির পাশেই ঘরটার সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কান্নার শব্দ। উঁকি দিয়ে সে দেখল, বিছনায় ধবধবে শাদা চাদরে ঢাকা একটা মৃতদেহ। লোকজন আড়াল করে থাকায় ছায়াবীথি মুখ দেখতে পেল না।  
কী এক পাথর যেন চেপে বসল ছায়াবীথির বুকের ভেতর। হিম হয়ে গেল সে। কী হুটহাট চলে আসে মৃত্যু। যে কোনও মুহূর্তে, ভাবনারও আগে। পায়ে-পায়ে সে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে ছায়াবীথি ভাবল, সন্ধেয় আব্বু এলে বলতে হবে, আনন্দবাড়ি গল্পটা তুমি আর লিখো না আব্বু। কিন্তু আব্বু যদি জিগেশ করেন, কেন? তখন সে বলবে, আনন্দবাড়িতেও নিশব্দে মৃত্যু ঢুকে পড়ে। থামিয়ে দ্যায় আনন্দ। যদি তা-ই হয়, তবে আনন্দবাড়ির মানুষগুলো মানুষের দ্যাখা স্বপ্নের মতো সুন্দর হলো কীভাবে? সুতরাং সুখি মানুষও নেই। আর নেই কোনও আনন্দবাড়ি। মানুষ বাড়ির নাম এমনি ওরকম রাখে।