আদর্শ বনাম সাম্প্রদায়িকতা
মাওলানা আবদুল গাফফার শাহপুরীপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩
আমরা মুসলিম। এটাই আমাদের আত্মপরিচয়। এই পরিচয়েই আমরা গর্ববোধ করি এবং আল্লাহ্ রব্বুল আলামিনের শোকরগোযারি করি। এ পরিচয়ের সূত্রে আমরা লাভ করেছি এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার এবং শামিল হয়েছি আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের অনুগত বান্দাদের মিছিলে। এই পরিচয় কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, আদর্শিক পরিচয়।
প্রথম মানব ও নবি আদমের (আলাইহিস সালাম) দ্বারা আসমানি যে শিক্ষার সূচনা হয়েছিল, হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ও পরবর্তী নবিদের সূত্রে মানবজাতি আসমানি যে বিধানপ্রাপ্ত হয়েছিল তারই চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গতম রূপ জগদ্বাসীকে দান করা হয়েছে শেষ নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। ইসলামের এ পূর্ণতম ও পূর্ণাঙ্গতম রূপটিই কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয়।
আখেরি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা মানবতার নবি, গোটা জগতের রহমত। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপর নাযিলকৃত আসমানি কিতাব কুরআন গোটা মানবতার জন্য আসমানি হিদায়াতের সূত্র। কুরআন-সুন্নাহ্র দ্বীন ইসলাম গোটা মানবজাতির জন্য আল্লাহ্র মনোনীত দ্বীন ও নাজাতের একমাত্র উপায়।
এ কারণেই যে কোনো ভূখণ্ডের যে কোনো ভাষার বা যে কোনো জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে তার নামই মুসলিম। আর যে কোনো ভাষার, ভূখণ্ডের জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এ আদর্শ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে তার নাম অমুসলিম। সুতরাং ইসলাম কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, আদর্শিক পরিচয়। এ কারণে কুরআন মজীদ মুসলিমদেরও আদেশ করে, হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইসলামে প্রবেশ করো পূর্ণরূপে। শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। সূরা বাকারা ২০৮
তাই ঈমান ও ইসলামের পরিচয়ের কারণে আমরা যখন গর্ববোধ করি তখন নিজেদের জীবন ও কর্ম এবং চেতনা ও বিশ্বাসকে পূর্ণ মুসলিম বানানোর চিন্তা করাও কর্তব্য। এই চিন্তা ও প্রয়াস হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলার এ নেয়ামতের শোকরগোযারির অন্যতম উপায়। ইসলাম যেমন সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয় তেমনি এতে সাম্প্রদায়িকতার অবকাশও নেই। কিন্তু বর্তমান যুগের অসত্য-চর্চার ভয়াবহ দিক হচ্ছে, আদর্শকে সাম্প্রদায়িকতা আর সাম্প্রদায়িকতাকে আদর্শ সাব্যস্ত করা।
এ কারণে বর্তমান মুসলিম সমাজেও ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের বিশেষণ জঙ্গি, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক। আর ইসলাম বিদ্বেষী চরম বর্ণবাদী গোষ্ঠীর উপাধি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা ইসলামে সুস্পষ্ট। আর তা হচ্ছে, শুধু নিজ গোত্র বা গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার কারণে কারো অন্যায়কে সমর্থন ও সহযোগিতা করা।
এ সুস্পষ্ট মানদণ্ড দ্বারা বর্তমান যুগের সাম্প্রদায়িক আচরণ ও উচ্চারণগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। মানব সমাজে ভাষা ও ভূখণ্ড এবং বর্ণ ও গোত্রগত যে বিভিন্নতা এ তো মহান আল্লাহ্র শক্তি ও ক্ষমতার নিদর্শন। ‘তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে আছে নিদর্শনাবলি জ্ঞানীদের জন্য।’ সূরা রূম ২২
তেমনি এসব বিভিন্নতা হচ্ছে পরিচিত হওয়ার উপায়। এগুলোর কোনোটিই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া এমন এক শব্দ যা ইসলামের সকল করণীয়-বর্জনীয়কে শামিল করে। কুরআন মদিদের সুস্পষ্ট ইরশাদ, হে লোকসকল, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে এবং তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রের বানিয়েছি যেন পরস্পর পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যে তাকওয়ায় শ্রেষ্ঠ সেই আল্লাহ্র কাছে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ্ তো সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত। সূরা যুমার ১৩
তাই এ সকল বৈচিত্র্যকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা এবং এগুলোকেই শত্রুতা ও মিত্রতার মানদণ্ড বানানো ইসলামের দৃষ্টিতে জাহেলিয়াত ও সাম্প্রদায়িকতা, যা জ্ঞান ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামে পরস্পর সহযোগিতার মানদণ্ড হচ্ছে, আল বির্ বা কল্যাণকামিতা ও আত তাকওয়া বা খোদাভীতি। ইরশাদ হয়েছে, নেকি ও পরহেযগারীতে একে অন্যের সাহায্য করো। পাপকাজ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করো না। সূরা মায়িদা ২
অমুসলিমদের প্রতিও জুলুম-অবিচার করা ইসলামে নিষেধ। কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের ইনসাফ ত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ করো। এটা খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। সূরা মায়িদা ৮
এ সুমহান দ্বীন ও সমুচ্চ আদর্শ লাভের পর যারা জাহেলিয়াতের চেতনা লালন করে এবং মুসলিম সমাজে জাহেলিয়াত ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাতে চায় তারা আল্লাহ্র কাছে চরম ঘৃণিত ও কৃতঘ্ন। তিন শ্রেণির মানুষ আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত: হে হরমের সীমায় পাপাচারে লিপ্ত হয়, যে ইসলামে এসে জাহেলিয়াতের রীতি-নীতি অন্বেষণ করে, আর যে নিরপরাধ মানুষের রক্তপাতে প্রয়াসী হয়। বুখারি ৬৮৮২
বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা সমগ্র থেকে, পৃষ্ঠা ৩৫৯