আত্মদীপের খুদেগল্প ‘ধূসর জানালা’
প্রকাশিত : আগস্ট ১৬, ২০১৮
পাড়াটা এখন মধ্যবিত্ত। আগে ছিল বনেদি সব পরিবারের বাস। বাড়িগুলোর রঙ ধূসর, ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তারা বেরিয়ে এসেছে। বড় বড় জানালার খিলানে মাকড়সার সুখি সংসার। জল ধোঁয়া বিবর্ণ লাইটপোস্টের আনাচে-কানাচে জট পাকিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানায় প্রতিবেশী ইলেকট্রিক তার।
প্রতি সন্ধ্যায় জানালাতে এসে চুল বাঁধতে বসে নলিনী। মিত্র বাড়ির বড় বউ। ওই একফালি আকাশটার দিকে ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। চাঁদ ওঠে... ওঠে না... আকাশ মেঘলা থাকে... কিন্তু লক্ষ্য করলে ঠিক জানা যাবে, নলিনী রোজ আকাশের দিকে ওই সময় চেয়ে বসে আছে।
রোজ সন্ধেবেলা গা ধুয়ে এসে জানালাটা হাট করে খুলে চুল বাঁধতে বসে মাঝবয়সি নলিনী। বিয়ের পর প্রায় নয় নয় করে আঠাশ বছর কাটল। এই জানালাটার মতো বন্ধু কেউ হয়নি। রান্নাঘরের ঘাম, ছেলেমেয়েদের চিৎকার থেকে পালিয়ে এই একবার বসতেই হয় ওকে।
এখানে বসেই প্রথম বুঝেছিল, এ মাসে আসেনি জোয়ার। বুঝেছিল, মেনে নেয়াটাই সব। মানিয়ে নেয়া বড়-ছোট কথা। বুঝেছিল, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। বুঝেছিল, কালো চুলের ফাঁকে কয়েকটা চুল কেমন যেন না জানিয়ে সাদা হয়ে গেছে!
সেই নলিনী কাল গেল স্বামীর সাথে হরিদ্বারে। আজ আর কেউ বসেনি জানালার সামনে। ওর যে খুব ইচ্ছা ছিল, তেমন নয়। তবু পতি পরম গুরু। তার বুড়ো বয়সের আবদারে গদগদ হয়ে ওঠে সুযোগ্য ছেলে। আর অনিচ্ছাকৃত ছেলের মাকে পিছনে যেতে হয়।
কেবলমাত্র একটা দিন গেছে, জানালাটা যেন নলিনী কে কতদিন দ্যাখেনি! ...ও সই, তুমিও কী এমনই ভাবছ? জানালা বোঝে, হরিদ্বারের দূরত্বে হার মানছে তার আকূলতা। হয়তোবা নলিনীরও..
এরই মধ্যে পিতার সেই সুযোগ্য ছেলেটি বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসে তার ইন্টারিয়ার ডেকরেটার বন্ধুকে। সে বাড়ির অনেক বদল বাতলে দিয়েছে। বিশেষ করে ওই বড় জানালাটা তার ভারি অপছন্দ। ছেলেটিও একমত, কেমন যেন বেঢপ আর সেকেলে!
ওটা হটাতে হবে, কাল থেকে কাজ শুরু! জানালা আরো বুঝতে পারে, এই দূরত্ব আর শেষ হবার নয়, আর দেখা হবে না সই!
আর নলিনী... কে শোনে তার কথা...