আজফার হোসনের দর্শনাখ্যান: বিন্দুর মধ্যে সমুদ্র দর্শন
কামরুল আহসানপ্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২০
আজফার হোসেনের দর্শনাখ্যান বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও চিন্তার জগতে একটি নতুন সংযোজন ও অপূর্ব নিদের্শন হয়ে থাকবে আশা করি। এ ধারার গ্রন্থ বাংলাভাষায় তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যেও আমি আর দেখিনি। বইটিকে কি আমি প্রবন্ধগ্রন্থ বলব, নাকি কাব্যগ্রন্থ নাকি নানা দার্শনিক ভাবনার বিচ্ছিন্ন অনুভূতির বিস্ফোরিত প্রতিচ্ছবি তা নিয়ে আমার নিজেরই রয়েছে সন্দেহ। কোথাও কোথাও টানা গদ্যের চিন্তার পরিস্ফূটন, কোথাও-বা রয়েছে কবিতার মতো দুএকটা ইমেজ, যেন বিশাল একটা সাদা ক্যানভাসে ছোপ ছোপ দাগ। ১৫১ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটি এমন বিশাল ব্যপ্তি ধারণ করে আছে যে এই বইটি নিয়ে এক হাজার পৃষ্ঠার আরেকটি ব্যাখ্যাকারী গ্রন্থ রচনা সম্ভব। কতখানি জ্ঞান-প্রজ্ঞা, অর্ন্তদৃষ্টি ও অনুভূতির গভীরতা থাকলে এত অল্প কথায় এতগুলো বিষয় নিয়ে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আখ্যানমালা রচনা করা যায়, তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। এ বই বসলেই লেখা যায় না। কেবল অনুভূতিই যথেষ্ট নয় এমন একটি বই রচনার জন্য। এর জন্য দরকার দীর্ঘ প্রস্তুতি, অধ্যায়নের নিবিড় তপস্যা।
মুখবন্ধ
বইটিতে মোট আটটি অধ্যায়-ভাষা, নৈঃশব্দ্য, স্থান, মানচিত্র, সাবান, আখ্যান, গন্ধ এবং বিন্দু। বইটির মুখবন্ধে আজফার হোসেন জানাচ্ছেন, ‘একটি ‘তুচ্ছ’ বা ‘জরুরি’ বা ‘অস্পষ্ট’ বা ‘গভীর’ বিষয়কে কতোভাবে দেখা ও ভাবা যায়, সেই তাগিদ থেকেই লিখেছি ‘দর্শনাখ্যান’, যদিও সেটি আমার একমাত্র তাগিদ নয়। আর এই দর্শনাখ্যানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসাবে কেবল চিন্তার বিশ্লেষণী উন্মোচনই মুখ্য হয়ে থাকে না; সেখানে আরও থাকে ভাবনার উদ্ধবাসন, উন্মীলন, স্ফুরণ, এমনকি ব্যাঞ্জনাও।’ মুখবন্ধে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘...কেবল চিন্তার জন্য চিন্তা করায় নয়, বরং চিন্তার রাজনৈতিকতায় আমি বিশ্বাসী’। আর তাই তার রচনাগুলোতে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে মার্কসবাদ, শ্রেণিবৈষম্য, শোষক ও নিপীড়িত মানুষের ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার প্রশ্ন। একই ভাষা, মানচিত্র, সাবান ক্ষমতাবানের হাতে ব্যবহৃত হয় শোষণের অস্ত্র হিসেবে আবার এটাই অসহায়, নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদ ও বিপ্লবের হাতিয়ার। ক্ষমতাসীনের নৈঃশব্দ্য আর ক্ষমতাহীনের নৈঃশব্দ্য এক জিনিশ নয়। যেমন সাদাদের হাতে সাদা সাবান আর কালোদের হাতে সাদা সাবান এক জিনিশ নয়। একজন চায় সাবান দিয়ে ক্ষমতা বিস্তার করতে, আরেকজন চায় সাবান মেখে পরিষ্কার হয়ে মানুষের এই সভ্যতায় টিকে থাকতে। কিন্তু, কার সভ্যতা, কীরকম সভ্যতা, এই সভ্যতায় পরিস্কার সম্পর্কেই-বা আমাদের ধারণা কী! এখানে সাবান ভাষা, নৈঃশব্দ্য, মানচিত্র ও গন্ধের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। শেষ পর্যস্ত খুঁজলে দেখা যাবে প্রতিটা আখ্যানই একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত, একটা আরেকটার প্রতিলিপি, প্রতিশব্দ। সাবান, ভাষা, মানচিত্র, স্থান, গন্ধ, বিন্দু যেন একটাই শব্দ, একটাই মানে, একই চিহ্ন ঘুরে ঘুরে কেবল বিভিন্ন স্থানে দাগ রেখে যায়।
ভাষা
শুরুতেই তিনি ‘ভাষা’ আখ্যানে তিনি প্রশ্ন তুলছেন, ভাষা কী? কী তার ঠিকানা, কী তার সীমানা, নিশানা? ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পুরনো প্রশ্নগুলো নতুন করে জাগে। প্রশ্নের চাপ আমাদেরকে কোনো না কোনো পথ দেখিয়ে দেয়। আমরা হয়ত একটা পথেই আছি। ১, ২, ৩, ৪ এরকম ধারবাহিক ক্রমান্বয়ে ২৬ অনুচ্ছেদে তিনি ‘ভাষা’ অধ্যায়টি বিভক্ত করেছেন। ৩ নং অনুচ্ছেদে জানাচ্ছেন, ‘ভাষার দেহে উৎপাদন-সম্পর্কের ময়লা জড়ো হতে থাকে। বলা যাবে, ভাষা আগেভাগেই ময়লা হয়ে আছে।’ ভাষা যদি আগেভাগেই ময়লা হয়ে থাকে এখন তাকে পরিস্কার করার উপায় কী? ভাষা পরিস্কার করতে হবে ভাষা দিয়েই। আর ভাষার ৯৯টা নাম দেয়া সম্ভব। আগেভাগেই তিনি ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম দিয়ে নিয়েছেন, ‘মধ্যস্থতাকারী’। ভাষা মূলত ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম হলেও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ভাষার বিনিময় মূল্য আছে। ভাষা বাজারে কেনাবেচা করা যায়। ভাষিক মূল্য আকাশ থেকে পড়ে না, কিংবা ভূমি ফুঁড়ে হঠাৎ তার উপস্থিতি ঘোষণা করে না। সামাজিক স্পেসে ভাষা উৎপাদিত হয়। আধুনিক ভাষা-দর্শন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এখন তো এরকমও বলা হয় আধুনিক দর্শনের ভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ভাষাই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জীবন ও জগত। সেরকম কিছু ইঙ্গিত দিয়ে আজফার হোসেন প্রশ্ন তুলছেন, ‘তাহলে আমরা ভাষা ব্যবহার করি, নাকি ভাষাই আমাদের ব্যবহার করে?
নৈঃশব্দ্য
‘ভাষা’র পর তার দ্বিতীয় আখ্যান ‘নৈঃশব্দ্য’। নৈঃশব্দ্যের ইঙ্গিত তার ‘ভাষা’ অধ্যায়তেই নিহিত। ‘ভাষা’ আখ্যানেই তিনি বলেছেন, ‘নৈঃশব্দ্যও এক ধরণের ভাষা বটে।’ নৈঃশব্দ্য আখ্যানটি মোট ৪১ অনুচ্ছেদে বিভক্ত। তিনি বলছেন, নৈঃশব্দ্য দেখা যায়, নৈঃশব্দ্য শোনা যায়, নৈঃশব্দ্য শোঁকা যায়, নৈঃশব্দ্য ছোঁয়া যায়, নৈঃশব্দ্য চাখা যায়। অসংখ্য কবিতা, সংগীত, চিন্তার অতল ঘেঁটে দেখিয়েছেন কোথায় কীভাবে নৈঃশব্দ্য লুকিয়ে আছে। নৈঃশব্দ্য লুকিয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে আলাওলের পঙক্তি¯্রােতে। ‘পদ্মাবতীর রূপ কি কহিব মহারাজ?/ তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুভন মাঝ।’ এইভাবে আলাওল নৈঃশব্দ্যের শক্তিকে সালাম ঠুকে তার কবিতা শুরু করেন। নৈঃশব্দ্য সংগীতের অন্তর্গত। নৈঃশব্দ্য গণিতের অন্তর্গত। জীবন যেমন নৈঃশব্দ্য, মৃত্যুও তো তাই- হিমশীতল নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্য দিয়েই সে আমায় বুঝিয়ে দেয় তার ভালোবাসা, আবার মাত্র দুই মিনিটের নৈঃশব্দ্য দিয়েই কেউ কারো ভালোবাসাকে খতম করে দিতে পারে। আজফার হোসেন নৈঃশব্দ্যের গণিত খুঁজে পেয়েছেন লালনের গানে, আর মার্কসের রচনায়। তিনি জানাচ্ছেন, ‘পুঁজি যা লুকায়, মার্কস তা দেখান। আগেই তো ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, নৈঃশব্দ্যকে যেমন শোনা যায়, তেমনি তাকে দেখা যায়। মার্কস দৃশ্যমান নৈঃশব্দ্যেরই তাত্ত্বিক।’ এ অধ্যায়ের সবশেষে আছে তার অনুবাদে কালো কবি এ্যালেকসিস নিউন্দাইয়ের একটি কবিতা। ভাষার ঝনঝনানিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে কবিতাটি কেবল নৈঃশব্দ্যকেই ধারণ করে আছে ।
স্থান
স্থান অধ্যায়টি একটু জটিল, যদিও সবগুলো রচনাই তাই, তবে এটি দাবি করে আরো বাড়তি কিছু মনোযোগ, কারণ স্থানের জ্যামিতিক বিন্যাসের সঙ্গে মিশে আছে দার্শনিক ও রাজনৈতিক বোধ। মানুষ স্থানের নাম দেয়, স্থানও নাম দেয় মানুষের। স্থান কেবলই থাকে না, স্থান হয়ে উঠতে থাকে। স্থান বস্তুক। কর্তাসত্তার প্রতিদিনের পুনরুৎপাদন ঘটে স্থানেই। স্থান হারিয়ে ফেলার অর্থ হচ্ছে পরিচয় হারিয়ে ফেলা। যেমন স্থান হারাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। স্থান কারো কাছে তার মাতৃভূমি, তার ভাষাগত পরিচয়ের একমাত্র উৎস, তার সমস্ত স্মৃতিকাতরতার জায়গা। উল্টোদিকে পুঁজিবাদী, সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে স্থান শুধ্ইু ভূমি, সেই স্থান দখলের জন্য কোনো ভৌগলিক বাধাকেই সে বরদাশত করে করে না। বিচ্ছিন্নভাবে অধ্যায়টি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে দিলে এমনই দাঁড়ায় যে, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-লিখিয়ে, নগর-পরিকল্পক-প্রকৌশলী, এমন কি ভাষাবিজ্ঞানী, সামরিক কৌশলী, গেরিলা যোদ্ধা, পরিবেশ-বিজ্ঞানী, আমিন-গল্পকার-গৃহিনী প্রত্যেকেরই তাদের পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও আছে নিজস্ব স্থান। মানুষ যেমন ভাষা থেকে, নৈঃশব্দ্য থেকে মুক্তি পায় না, তেমনি মুক্তি পায় না স্থান থেকেও।
মানচিত্র
ভাষা, নৈঃশব্দ্য, স্থানের মতো আমরা সবাই যার যার মানচিত্রদ্বারাও আবদ্ধ। আমরা যা-ই বলি, যা-ই করি তার সবই কোনো না কোনো মানচিত্রের মাপে। ভূমিতে লাঙল চষা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কর্ষণ সবই আসলে কোনো না কোনো মানচিত্রবিদ্যা। তাই মানচিত্র কেবল স্থানেরই হয় না, সে হতে পারে বিষয়ের, চিন্তার, দেহের, সময়ের, এমন কি অনুপস্থিতিরও। মানচিত্র থেকে প্যালেস্টাইনকে মুছে ফেলা হয়েছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা আছে। মানচিত্র বদলে ফেলা যায়, কিন্তু, স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না। তাই মানচিত্র না থেকেও থেকে যায়। এ অধ্যায়টি তিনি শেষ করেছেন একটি কুড়িয়ে পাওয়া কবিতার কয়েটি পঙক্তি দিয়ে। কমিউনিস্টের বন্দুকের বুলেট বলে : মুক্তির চরম মূহূর্তে/ মানচিত্র সব/ উবে যায়/ উবে যায়...
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করে সংহতি। মূল্য দুশো ষাট টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন সব্যসাচী হাজরা।