আগুনের শিঁরদাড়া: আবহমানতার ছবিসুর
নীহার লিখনপ্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২০
কবি হাদিউল ইসলাম, বাংলা কবিতার বিশেষ করে এপাড় বাংলা বলে যে ভূখণ্ডটিকে আবহমান কাল হতে নিজস্ব আবহাওয়া, মাটির গুণ-গাথা, কৃষ্টি, মনস্তত্ব এবং সর্বোপরি যে ভাব বা ভৌগলিকতাকে তার স্বতন্ত্র স্বভাব হিসেবে মোটাদাগে চিহ্নিত করতে পারি, তারই বিশুদ্ধতম ধারাটি যেন এই কবির কবিতায় প্রবাহিত থেকে যাচ্ছে। সেই ধারারই খুব বিশুদ্ধ প্রতিভু এই কবি। নিশ্চিত অর্থেই বাংলা কবিতার আইনানুগ রীতিটির যে সহজিয়া ভাবের একটা বলার ধরনটি রয়েছে, যাতে প্রায় প্রধান উপঢৌকন হিসেবে যুতসই আড়াল, উপমা, গীতময়তা বা আখ্যানধর্মিতাকে ধরা যায়, খুব সংবেদনশীল মন নিয়ে সে নির্মিতিটির ব্রতটিতে হাদিউল ইসলাম যেন খুব সচেতনেই ব্রতী থেকেছেন। অযথা অন্যের ধার করা বেগ বা আবেগের দিকে একদম অযাচিত কোনো বোঝাপড়ায় যেতে চাননি বিশেষ।
বিশেষ করে তার সময়ের অধিকাংশ কবিদের অনেকের প্রবণতায়ই যেটি ছিল এক অনন্য চকমকির অন্যতম প্রলোভন, এবং যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেন ছিল অতি-আরোপিত কোনো পরজীবী স্বভাব বা এক রকমের পরশ্রীকাতরাতাই, এবং প্রায় ক্ষেত্রেই নিছক ছল সর্বস্বতার চর্চা, যা একটি ভূখণ্ডের বোধ, বিবেচনা, দার্শনিক সত্তা, সত্য ও যাপনকে যেন একরকম রাতারাতিই খোলনচলে পাল্টে ফেলার একটা তাগাদায় মনোনিবেশিত হচ্ছিল, বা এ হওয়াটার ব্যতিরেকের সব প্রয়াসই যেন অ-আধুনিকতা আর গ্রাম্যতা, এরকম একটা উত্তর ঔপনিবেশিক মন ও মননের চর্চার বাড়বাড়ন্তির কবি ও কবিতার কালে যখন হাদিউল ইসলামের কবিতায় উঠে আসে: হেতাল গাছ, পাশের বাড়ির হাঁস, স্মৃতির প্রেম থেকে কোনো মেয়েটার গ্রামীণ শরীর, গোবরের গন্ধ ও নদী, নৌকা, ঘাট, ভাঁট, লোকগীতি পরম্পরার প্রতি সব দায় ও কথা; তখন এই কবিকে আমার খুব বেশি আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একজন বলেই মনে হয়।
বিশেষ করে তার সমসাময়িক অনেকের তুলনায়তো বটেই। এদিক থেকে তার দিকে একটি অভিযোগ হামেশাই আসতে পারে যে, এই কবি তার সময়কে সমকালিক বোধ বা বাকপ্রণালিতে ধরতে পারছেন কম যা বৈশ্বিক চিন্তাপ্রবাহের বাইরের বলেই মনে হয়, বিশেষ করে অখণ্ড যে একটি মুক্তি, ক্লেদ, যুক্তি, যুদ্ধ, ক্লেদ বা মানস যা একজন আধুনিক মানুষের জীবন তা হউক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক এসব কিছুর থেকেই এই কবি যেন খুব বিমুখ, আর উদাসীন থাকছেন বলেই মনে হয়। একথাটিকেও মনে হবে কবি হাদিউল ইসলামের ক্ষেত্রে মিথ্যা আরোপই, বরং হাদিউল ইসলাম সর্বদাই খুব বক্রোক্তির আশ্রয় নিয়েছেন খুব ইতিবাচক আর সার্থক ছলে, যে কোনো স্তরের পাঠক মাত্রই তার কবিতায় এটি আবিষ্কার করতে সমর্থ হবেন বলেই আমার মনে হয়। কারণ কবি হিসেবে হাদিউল ইসলাম খুব একটা আরোপিত কোনো দুর্বোধ্যতার নির্মাণের পথে হাঁটতে চাননি, বরং আখ্যানে বলে যেতে চেয়েছেন সকল নিগূঢ়, স্বাদেশিক আর লোকজ সকল বৈভবের পাশাপাশি যৌক্তিক যতটা সম্ভব বিস্তারিত হওয়া যায় বৈশ্বিকতায় সে প্রচেষ্টাটিও তার কাব্য প্রবণতায় একেবারে অনুপস্থিত যে না, তা তার উত্থানপর্ব থেকেই লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরের পটভূমির যে নতুন বিশ্ব, যাকে অন্যভাবে বলা যায় পুঁজিবাদের কব্জার বিশ্বের একজন সজাগ নাগরিক হিসেবে এই কবির কবিতায় প্রায়শই দেখা যায় মুক্তবাজার অর্থনীতিসহ নানান বিষয়ের বিরুদ্ধেই তার বাঁকা একটি চাহনি জারি থাকে, থাকছে।
‘আগুনের শিরদাঁড়া’ এই কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, এবং প্রায় ১৫ বছরের ব্যবধানে এটি গ্রন্থিত হলো, অর্থাৎ ২০০৪ সালে প্রকাশিত `ধুলো কাল স্রোত` নামে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম বইটি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটা দীর্ঘ সময়ই বৈকি, আর এই সময়ের ব্যবধানে পৃথিবী বেশ অনেকটাই বদলে গেছে। ১৫ বছরের আগেকার সেই জীবনের সাথে তুলনা করতে গিয়ে যদি বলি, অধুনার পৃথিবীটি অর্থাৎ যে সময়ে কবি হাদিউল ইসলামের আগুনে শিরদাঁড়া বেরুলো এটা নতুন পৃথিবীতে হাদিউল ইসলামের পুনর্জন্মই যেন হলো। তাই এই বইটির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ নিয়েই এক অপেক্ষা ছিল আমার পাঠক হিসেবে, বেশ একটা আগ্রহই বলা যেতে পারে, বিশেষ করে প্রবল একটা কৌতূহল ছিল দেখার বা জানার, ঠিক কতটা বদলে গেল কবি হাদিউল ইসলামের কবিতা, কতটা ভাঙতে পারলো সে সময়ের বিবর্তনে নিজেকে। মূলত এই দুটোই ছিল প্রধান ঔৎসুক্য আমার।
তা পড়া শুরুর আগেই কাব্যটির নামটি আরও উস্কেই দিচ্ছিল যেন যেহেতু নামটি `আগুনের শিরদাঁড়া`র ‘ধুলো কাল স্রোত’ বইটির পরে এই নামে হাদিউল ইসলাম যেন আরও বেশি ধীমান ও তেজী আর দাপুটে ভাবেই আবির্ভূত হতে চাচ্ছেন, এবং সম্ভবত আরও একটু বিপ্লবীটিই বোধহয়? তাই আর কালক্ষেপণ না করে আসুন পড়ে ফেলি নাম কবিতাটি:
আগুনের শিরদাঁড়া ছাড়া
আপাতত আর কিছু ভাবতে পারছি না
কবির এ উচ্চারণ, আমার অনুমানকেই সত্য প্রমাণ করে, কিন্তু পরবর্তীতে পঙক্তিতেই যেন হাজির করে ফেলেন কিছুটা কবি সুকান্তকে, বিশেষ করে দেশলাই নামের একটি কবিতারই ভাবের অনুরণনটি কালের পরিক্রমায় বহুদিন পরে আবারও কোনো তার উত্তরকালের এক কবির কণ্ঠে উঠে আসছে, যেটা এড়াতে পারেননি বোধহয় কবি হাদিউল ইসলাম, কিংবা অবচেতনেই সে আচ্ছন্ন হয়েছেন, বা অন্যথায় বলা যায় কিছুটা প্রভাবিতই হয়েছেন বলা যায়, বিশেষ করে যখন তিনি বলেন:
দেশলাই থেকে সমস্ত কাঠি বের হয়ে
পড়েছে রাস্তায়
এখানে কবি হাদিউল ইসলামকে ঠিক অতোটা স্বপ্রণোদিত বিপ্লবীটিকে পাওয়া গেল না আগুনের মতো মৌলিক তেজে, বরং উলটো যেন কিছুটা দায় সাড়া আলগোছাভাবে তিনি টেনে আনলেন কোনো প্রবল পূর্বসুরির চোখ এবং কিছুটা ধার করেই যেন, হাদিউল ইসলাম এক্ষেত্রে কিছুটা বঞ্চিতই করলেন যেন তাকে এবং তার পাঠককে, এবং অন্যভাবে বললে বলা যায়, বাংলা কবিতায় দেশলাই নিয়ে ঠিক এই রকম কাছাকাছি ভাব ও চেতনায় লেখা কিংবদন্তিতুল্য রাজনৈতিক কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর, কালের পরিক্রমায় এতদিন পরে এই কবিতাটি যেন একটা রেপ্লিকেশনই মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে কবি হাদিউল ইসলাম হয়তো সময়ের প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং খুব অকপটেই, এটা নিঃসন্দেহে তার স্বদিচ্ছারই পরিচায়ক, বিশেষ করে কবিতার শুরুর পঙক্তিতে সেই আভাসটি বেশ স্পষ্ট, কিন্তু তার পরবর্তীতে সে যেন খুব একটা দায়িত্ব নিলেন না, যা তার প্রচেষ্টাটিকে কিছুটা হলেও খর্বই করলো বলে মনে করি।
আসুন এবার আরেকটা কবিতায় যাই, যেখানে খুব চেনা সেই হাদিউল ইসলামকে পাওয়া যায়, সেই মাপা পর্বে, ছন্দে আর বাকপ্রতিমায়:
আমার পাথেয় নেই, পুরনো সে টানে
সর্বদা উজ্বল আমি, পাখিদের গানে।
এভাবে শুরু করে এক হেঁয়ালির মতো বলায় হাদিউল ইসলাম শেষ করেন এক বিবাগী রহস্যের সুন্দরে, মরমীর মতো, চিরায়ত ঘোর আর উদাসীনতায়, যা বাংলা কবিতার এক অতি নিজস্ব প্রবণতারই সারোৎসার।
আমার পাথেয় নেই, অন্য কিছু আছে
দু`পায়ের তলে পথ, বিনোদিনী নাচে
খুব ঝর ঝরে দুটো পর্বের বিন্যাসের প১ক্তিতে হাদিউল অন্ত্যমিলে বাংলা কবিতার আবহমান স্বভাবেই বিরাজ করছেন,এবং এই কবি প্রচলিত প্রকরণের অক্ষরবৃত্ত, বিশেষ করে পয়ার ছন্দ, এবং মিশ্র ছন্দেও বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তার পূর্বের বইটিতে, এই কাব্যগ্রন্থেও তার একটু ছটা এই কবিতায় লক্ষ্যনীয়। আগেই বলেছি কবি হাদিউল ইসলাম তার সমসমায়িক কবিদের তুলনায় এসথেটিকালি খুবই প্রথাগতই, নিজেকে খুব একটা নিরীক্ষাপ্রবণতায় শামিল করেননি, বরং তার মানসে ছিল অন্য একটি মনিষা, যাকে বলা যায় শ্বাশত, অন্ত্যজ বোধ, রূপক, চিত্রকল্পের সাথে লোকজ উপমা সহ প্রেম ও নারী তার কবিতায় পেয়েছে চিরায়ত সুন্দরের মর্যাদা, যেমন মেঘদূত কবিতায় কবি মেঘদূত, পাড়া, বৃষ্টিকে একটা সূতায় গেঁথে দেখাতে চান, যুগ যকের সত্য কোনো যাপনের মালা
বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে
মেয়েটি মথুরা-বৃন্দাবন করছে ঘর-বারান্দায়
ছেলেটি দূর জানালা, দেখে এইসব লক্ষ্যভেদী পুষ্পশর
বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘদূত পাঠ হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়
বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘদূত ভিজে যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়
হাদিউল ইসলামের খুব একটি দিক আছে, সেটি হচ্ছে খুব সাবলীল বোধহয় বক্রোক্তিতে, এবং অনেকটাই যেন হাল্কা চালে তা বলে ফেলতে পারেম তিনি, যেমন মফস্বল কবিতায় তিনি উগরে দিলেন যেন তার সব ক্ষোভ কী নিপুণ বক্রতার আশ্রয় নিয়ে।
কদমও পার্লারে যায় না
কবরী উজ্জ্বল করে তবু কারো
মফস্বল রাধা-গোপিনী হাজারো
এরকম অনেক কবিতা ক্রম দিয়েই সাজানো কবি হাদিউল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আগুনের শিরদাঁড়া’ পাঠককে মিশ্র একটা মনোভাবের সম্মুখীন করবে বলেই আমার অভিমত, তবে পরিশেষে আমার যা মনে হয়েছে, দীর্ঘ ১৫ বছর অপেক্ষার পর কবি হাদিউল ইসলামের পাঠককুল হয়তো আরও একটু নতুনভাবে হাদিউল ইসলামকে পাবার প্রত্যাশা করতেই পারে, আর সেই প্রত্যাশা তাদের খুব একটা যে পূরণ করতে পারবে এই বইয়ের কবিতাগুলো তা আমার মনে হচ্ছে না, এবং কেন যানি মনে হচ্ছে কবি এখানে আরও একটু দায় নিতে পারতেন, ভাবতে পারতেন আরেকটু নির্মোহ মন নিয়ে পাঠককে নতুন ভাবনা ও পরিবেশনার স্বাদ দিতে। যেহতু ১৫টি বছর গত হয়ে এক দীর্ঘ গেছে অপেক্ষায়।
আগুনের শিরদাড়া বইটি ২০১৯ সালে প্রকাশ করে প্রিন্ট পোয়েট্রি।