আগরতলায় মানিক সরকার ও গৌতমদার সঙ্গে
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০১৯
গত উনিশ তারিখ ত্রিপুরা বেড়াতে গিয়ে প্রথম উদয়পুরে লিটল ড্রামা গ্রুপের নাট্য উৎসবে যোগ দেই। সেখানে মলয় ভৌমিকের বুদের কুপে পড়া নাটকটা দেখি বিশে ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। বক্তব্য প্রধান নাটক। সমসাময়িক ঘটনাবলিকে ঘিরে হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে নাটকের বক্তব্য বলা হয়েছে। দর্শকরা খুব উপভোগ করেছেন নাটকটি। দর্শক হিসেবে আমিও উপভোগ করেছি। মলয় ভৌমিকের এ নাটকটি যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে। মলয় ভৌমিকদের দল রাজশাহীর অনুশীলনের সঙ্গেই আমি ত্রিপুরা গিয়েছিলাম। দলের সবাই বাংলাদেশে ফিরে আসেন ডিসেম্বরের একুশ তারিখে। কিন্তু আমি একদিনের জন্য আগরতলায় থেকে যাই। অধ্যাপক মলয় ভৌমিক এবং তার দলের সকলকে আগরতলায় বিদায় জানিয়ে আমি সেখানকার ‘হোটেল ওয়েলকাম প্যালেস’-এ আবস্থান করি। আগরতলায় থেকে যাবার প্রধান একটি কারণ সেদিন রাতে ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার আর দলের সম্পাদক গৌতম বাবুর সঙ্গে দেখা করা। ওনাদের সঙ্গে যে দেখা করবো সেটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল।
দুপুরের দিকে আমি আগরতলায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতে ফোনে খবর পেয়ে সুভাষদা আর সমীরদা আমার হোটেল চলে আসেন। সুভাষদা নাট্যকার, সরকারি আমলা ছিলেন। ‘আরশিনগর’ নামে চমৎকার একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পদনা করেন। সমীরদা বহুবছর ধরে আজকাল পত্রিকার ত্রিপুরার দায়িত্বে আছেন। তিনি লেখক এবং গায়ক। বহুদিনের ঘনিষ্ঠজন তাঁরা দুজনেই। যে হোটেলে আমি থাকবো সে হোটেলের মালিক আবার সুভাষদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুপুরে চা খাওয়া আর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর ঠিক হলো, সন্ধ্যায় আবার দেখা হবে আমাদের অক্ষর পাবলিকেশনে। মানিক বাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে ত্রিপুরা সম্পর্কে কিছু বইপত্র কিনবো সুভষদা আর সমীরদাকে সঙ্গে নিয়ে।
সন্ধ্যায় বই কেনা হলো বেশ কিছু অক্ষর প্রকাশনী আর জ্ঞান বিচিত্রা থেকে। দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা সেদিন ত্রিপুরার বাইরে ছিলেন। অক্ষর পাবলিকেশনের মালিকের সঙ্গে ফোনে কথা হলো, তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন দেখা হলো না বলে। জ্ঞান বিচিত্রার দেবানন্দদা অবশ্য রাতেই আগরতলা ফিরবেন আর পরদিন আড্ডা দিতে আসবেন হোটেলে। জ্ঞান বিচিত্রায় গিয়ে সেদিন শুধু বই কেনা হলো না, চা বিস্কুট সন্দেশ আর মুড়ি-চানাচুর খাওয়া হলো। বৌদি আর অন্যরা ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে সব আয়োজন করেছিলেন। কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটলো সেখানে।
বইকেনা শেষে বামফ্রণ্ট অফিসে গেলাম সুভাষদা, সমীরদার সঙ্গে। তখন দলের সভা চলছিল, আমরা একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অতিথি আপ্যায়ন কক্ষে বসে চা বিস্কুট খেলাম। পরে সভাকক্ষেই মিলিত হলাম মানিকবাবু আর গৌতমদার সঙ্গে। গৌতমদার সঙ্গে অনেকদিন পর আবার দেখা। খুবই চমৎকার মানুষ গৌতমদা। আর মানিকবাবুকে শেষবার দেখেছিলাম কলকাতার সল্টলেকের ত্রিপুরা ভবনে। দিল্লি থেকে সভা শেষ করে ত্রিপুরা ফেরার পথে তিনি সেখানে ছিলেন এক রাত। সেদিন রাতে আমিও সল্টলেকের ত্রিপুরা ভবনেই ছিলাম। মানিকবাবুর কক্ষটা ছিল ঠিক আমার মুখোমুখি। তিনি ছিলেন ভিআইপি এক নম্বর কক্ষে আর আমি ভিআইপি ছয় নম্বরে। সেবার কলকাতার ত্রিপুরা ভবনে দু-রাত অবস্থান করে পরদিন হায়দারাবাদ গিয়েছিলাম । মুখমন্ত্রী হিসেবে মানিকবাবু যে কতো সাধারণ জীবনযাপন করতেন তার প্রমাণ সেদিন পেয়েছিলাম ত্রিপুরা ভবনেই।
গত ডিসেম্বরের একুশ তারিখে মানিকবাবুর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। গৌতমদার সঙ্গেও। মানিকবাবু, গৌতমদা, সুভাষদা, সমীরদা সবাই আমরা অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে খোলাখুলি কথা বললাম। আমার লেখা ‘স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক বিচার ব্যবস্থা’ আর ‘রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার স্বরূপ’ বই দুটি উপহার দিলাম। মানিকবাবু নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলেন আমার প্রশ্নের জবাবে। মানিকবাবু বামফ্রণ্টের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া নিয়ে বললেন, এটা আমাদের নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। জানালেন এর ভিতর দিয়ে নিজেদের অনেক ঘাটতি তাঁরা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। তিনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন আর বলেন খুব ধীরে ধীরে। আগরতলায় খুব ঠাণ্ডা ছিল সেদিন। তিনি মাথায় টুপি পরে ছিলেন। তিনি অসম্ভব রকম মূল্যবান কথা বলছিলেন ক্ষমতায় থাকার দিনগুলি নিয়ে। কথার মধ্যে যা ছিল না, তাহলো নিজেদের সাফল্য নিয়ে সামান্যতম অহংকার। কখনো নিজেদের সাফল্য ছিল কি ছিল না, তা বলার জন্য ব্যস্ত হননি। খুব মনোযোগ দিয়ে আমি সেটা খেয়াল করেছি।
ত্রিপুরার উন্নতির জন্য তাঁরা কতো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন তা যেমন বললেন না, নিজেদের শাসনকাল নিয়ে গর্ব করার সামান্য প্রচেষ্টা লক্ষ্য করলাম না। নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা তাঁর মুখে শুনলামই না। নিজেরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, জনগণের স্বার্থে কী কী করেছেন, কখনো তা নিয়ে কিছু বলার আগ্রহই লক্ষ্য করা যায়নি। বরং নিজেদের ছোটখাট ভুলগুলির কথাই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছেন। যখন আমি নিজে সারা ভারতের বামফ্রণ্টের কিছু কিছু ত্রুটি নিয়ে কথা বলেছি, তিনি তার সঙ্গে একমত হয়েছেন। নিজের মতো করে তা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বরং সেসব নিয়েই কথাবার্তা বেশি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিছু কিছু প্রসঙ্গে কথা হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মেলাঘর হাসপাতালের কথা উঠতেই ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সম্পর্কে মানিকবাবু জানতে চাইলেন, ‘ডাক্তারবাবু কেমন আছেন?’ জাফরুল্লাহ ভাইর বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে জানালাম।
যখন আলাপ আলোচনা শেষ হলো, তখন রাত সাড়ে নয়টার বেশি। সুভাষদা সে রাতে আমাকে আর সমীরদাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাতের খাবারে অন্যান্য কিছুর সঙ্গে ইলিশ মাছ ছিল। রাত সাড়ে এগারোটায় সে আড্ডার সমাপ্তি ঘটলো। পরদিন সকালে আবার ঘরোয়া আড্ডা আছে আগরতলার নাট্যকার, সাংবাদিক, প্রকাশক, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে।