আখুকা
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০১৮
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব আখুকা ছিলাম। আখুকা মানে খাওয়ার পাগল। শুক্রবার আমাদের বাড়ির সামনেই জুম্মাঘরে জুম্মার নামাজের পর খিঁচুড়ি খাওয়া যেত। মিস নেই। কোনো না কোনো বাড়ি থেকে কেউ না কেউ ডিশ ভরে নিয়ে আসতো খিঁচুড়ি। মানতের।
নামাজটা শেষ হওয়ামাত্র আমরা সব পোলাপানের দল দৌড়ে গিয়ে বসে যেতাম জুম্মাঘরের সামনে লাইন দিয়ে। ফকির মিসকিনরা যেমন লাইন দিয়ে বসে, ঠিক সেভাবে। তারপর কোনো একজন আমাদের সবার সামনে রেখে যেত কলাপাতা। বেশ বড় সাইজের কলাপাতা।
আমরা সেই কলাপাতাটা সামনে নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম কখন এক চামচ খিঁচুড়ি দিয়ে যায়! অবশেষে কোনো শুক্রবার হয়তো মস্তান খাঁ চাচা আবার কোনো শুক্রবার হয়তো লতিফ খাঁ ভাইয়ের বাবা আমাদের কলাপাতায় এক চামচ খিঁচুড়ি, চামচ থেকে পড়ে কী পড়ে না, অতি কষ্টে রেখে যেতেন।
আমরা কলাপাতা চেটেচুটে সেই খিঁচুড়িটুকুই যে কী মজা করে খেতাম। আহা! একেক শুক্রবারের খিঁচুড়ির টেস্ট একেক রকম। কলাপাতায় কী শুধু খিঁচুড়িই খেতাম? খরচের খাওয়াও যে কত মজার ছিল! ড্যাগের গরুর মাংসই হোক আর খাশির মাংস, গরম গরম ভাতের সঙ্গে খাও আর ঝালে উশ আশ করো।
তবে খেলাটা জমে যেত যখন আলফু পলানের কোনো এক ছেলে আইচা ভরে ঢেলে দিয়ে যেত মাশকলুইয়ের ডাল, তখন হতো এক লাফালাফি কাণ্ড, ডাল একবার যদি ডানদিকে দৌড়োয় তো সেদিকের কলাপাতা উচিয়ে ধরলে আবার দেখো তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে পশ্চিম সীমানায়, আবার সে সীমানার কলাপাতা ধরো উঁচিয়ে।
তখন হয়তো বাচ্চু ভাই সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে, তাড়াতাড়ি চুমুক দে! চুমুক দে! আরে বাবা! চুমুকটা দেব কীভাবে— সেটা কিন্তু আর বলছে না।
সেই কলাপাতায় খাওয়াটা আমাদের গ্রাম থেকে এক রকম উঠেই গেছে বলা যায়। শুক্রবারে বোধ হয় আমাদের গ্রামের মসজিদে এখন আর খিঁচুড়ি আসে না। খরচ হলে এখন আগে আগে চলে আসে ডেকোরেটর।
শৈশবের সেই কলাপাতা দেখে এলাম ইম্ফলের রাজপথে। একজন ভদ্রমহিলা বিক্রি করছেন। হোটেলের খাওয়ায় যেমন কলাপাতা ব্যবহার হয়, তেমনি মন্দিরগুলোতেও এই কলাপাতার ব্যবহার এখনো রয়েছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক