অরুণ মিত্রর তিনটি কবিতা
প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২১
কবি অরুণ মিত্রর আজ মৃত্যুদিন। ২০০০ সালের ২২ আগস্ট তিনি মারা যান। ১৯০৯ সালের ২ নভেম্বর যশোরে তার জন্ম। পিতা হীরালাল মিত্র, মা যামিনীবালা দেবী। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা তিনটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
গোপনতা
নানা গোপনতার মধ্যে আমি বাস করি
আমার পায়ের আঙুলে লেলে নুড়ি বাজলে আমি শুনি ঝর্ণা
সে আওয়াজ কি আর কারো কাছে পৌঁছয়?
একটা ঝিঁঝির ডাক যেই ওঠে, সারা বন অন্ধকারে দুলতে থাকে
আর সারা শূন্য গাছপালার কথা চালাচালিতে ভরে যায়,
ছড়িয়ে পড়ে অরণ্যের ছায়া তারপর কাঁকরমাটির সবুজ
পাহাড় আঁকড়ে-ধরা শেকড়ের খবর আসে,
আমি তা বুকে চেপে রাখি। কেউ কি তা জানে?
কেই-বা জানে আমার রাজ্য-সমাচার?
অনেক গোপনতা ধরে রাখার ফন্দিও আমার অনেক,
যখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে শিরাতন্তু থেকে
আমি হোহো হাসিতে চমকে দিচ্ছি আকাশ,
দ্যাখো দ্যাখো কী ফূর্তিবাজ বলে কত হাততালি জোটে
তখন আমি যেন জয়গর্বে আরো ফূর্তিবাজ হয়ে উঠি,
আমি যে সময়ের চকচকে ধারের উপর পা রেখে হাঁটছি
আমি যে এগিয়ে যাচ্ছি প্রকাণ্ড পাথরচাঙের ফাঁকে
সে-কথা কাওকে আমি জানতে দিই না। কেন দেব?
আমি তো জীবনমরণ খেলায় কাউকে আমার শরিক করিনি।
আমার গোপনতা নিয়ে আমি আছি
সবাই দেখছে চিকচিক চোখের কোণ ঠোঁটের বাঁকা টান
আর আমি দেখছি মুহুর্মুহু মেঘবিদ্যুৎ
বুকের মধ্যে শুনছি সমস্ত ওলটপালটের বাজনা
গোপনতায় আমি বুঁদ হয়ে আছি।
আর এক আরম্ভের জন্যে
আমি বিষের পাত্র ঠেলে দিয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি হাসি আর কান্নার পেছনে আমার প্রথম স্বপ্নকে ছুঁয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি অরণ্যের কাছে গিয়ে ঘাসের ফুলের উপর নত হয়েছি
অবাক হয়ে পূবের দিকে তাকিয়েছি
অবাক হয়ে ঝর্ণায় সোনার রং দেখেছি
আমার আশ্চর্য হওয়ার উপহার তুলে ধরেছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি সূর্যের নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি
প্রত্যেক রোমকূপ দিয়ে শুষে নিয়েছি রোদের বিন্দু
আর চৈত্র থেকে আষাঢ়ে আমাকে এগিয়ে দিয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি হাটে হাটে ভেসে এসে থেমেছি
মাটিতে পা গেড়ে দিয়েছি
ফুসফুসে ভরে নিয়েছি মহুয়ার আর ধানের বাতাস
আমের বোলের বাতাস
মনের মধ্যে এঁকে রেখেছি অঙ্কুর আর কিছু নয়
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি জনতার মধ্যে শিশুর কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি
আমি কোলাহলের খরজে আমাকে বেঁধে নিয়েছি
এই তো নিঃশ্বাস নেয়ার মতো উচ্চারণ করেছি মানুষ
আমি তোমার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে পেরেছি
তুমি প্রসন্ন হও।
অমরতার কথা
বাসনগুলো একসময় জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠবে। তার ঢেউ দেয়াল ছাপিয়ে পৃথিবীকে ঘিরে ফেলবে। তখন হয়ত এই ঘরের চিহ্ন পাওয়া যাবে না । তবু আশ্চর্যকে জেনো। জেনো এইখানেই আমার হাহাকারের বুকে গাঢ় গুঞ্জন ছিল।
আমার বদ্ধ বাতাসে যে-গান পাষাণ হয়ে থাকে তা ভেঙে ছিটিয়ে পড়ুক, কল্পনার স্বর সমুদ্র হোক এই আশায় আমি অথৈ। অবিশ্রাম অনুরণনে পাঁচিল ধসে যাবে, কলরোলে ভিটেমাটি তলাবে। তখন ঘূর্ণির পাকে বুঝে নিয়ো কোথায় সেই বিন্দু যেখান থেকে জীবন ছড়িয়ে পড়ল মৃত্যুর গহ্বরে।
কাঠকুটো আসবাব আবার বন্য হয়ে উঠবে। ওরা কচি পাতার ঝিলিমিলি মুড়ে ঝিমোয়, ভিতরে ভিতরে কোথায় হারিয়ে থাকে অঙ্কুরের ঝাপটানি। তবু সূর্য ডুবলে আমার চোখে বারবার ঘনিয়ে আসে বন।
ওরা আবার বন্য হয়ে উঠবে। আমার ছাদ দেয়াল মেঝের শূন্যতা ভরে অরণ্য জাগবে। সবুজের প্রতাপে এই শুকনো কাঠামো চূর্ণ হবে। সেই ধ্বংসের গহনে খুঁজে নিয়ো আমার বসতি, সেখানে পোড়ামাটি-ইটের ভিতরে রস ছিল অমৃতের মতো।