অরিজিৎ কুণ্ডু

অরিজিৎ কুণ্ডু

অরিজিৎ কুণ্ডুর ৮ কবিতা

প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২২

যৌনতা অথবা মৃত্যু বিষয়ক

অবগাহন
তোমার শরীরে
যেন ইতিহাসের ভার।
আমি
দু’চারটে পর্বত মালভূমি
কয়েকটা সমতল পেরিয়ে
তোমার ঠোঁটের আর্দ্রতার কাছাকাছি
আর তোমার মগ্ন বোজা চোখ
অথবা জোনাকিতে ঝিলমিল চুলে
অমোঘ মৃত্যুর গন্ধ বারবার।
ডান বুকের বৃন্তের পাশে
যে গাছ এঁকেছিলাম
এই বসন্তে সেই গাছের মৃত্যু হলো নাকি?
তোমায় ছোঁয়া আর আরও বেশি ছোঁয়া,
মনে পড়ে যায়
আগামী সাত মাস
একা থেকে একা হতে হতে
আমার শরীরে মৃত ডালপালা গজাবে
আর চড়ুইভাতি করবে শকুনেরা।
তোমার শরীরে এত মৃত্যুর সংকেত যে,
আর ভয়ও করে না।
নাভি থেকে স্তন ছোঁয়ার আনন্দে
ভুলে যাই,
দেওয়াল থেকে ঝোলা
রাই আর মহিমের শব।
চরম আদরের ফাঁকে
বুকের বাঁ দিক কেটে
তোমার কাঁচা হৃৎপিণ্ড আস্ত খেয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখি
যদি কিছুদিন আরও বেশি বাঁচি।

স্বগতোক্তি

জুলাই মাসের আলো নিভে যাওয়া রাতে
বৃষ্টির টুপুর টাপুর শব্দে
লালচে নীল চাঁদহীন আকাশ
আর জ্বলন্ত সিগারেটের ঘ্রাণে
দুচোখে ভীষণ ভয়ের প্রতিচ্ছবি দেখেছো?
মৃত্যুর ভয়, বেদনার ভয়, বিষাদের ভয়
অথবা একাকিত্ব, প্রেমহীন নির্জনতার ভয়
পেয়ে দেখেছো কিনা একবার বলো।
তুমি বলেছিলে,
তোমার জন্য সমস্ত খ্যাতির মোহ আর ঐশ্বর্য
ত্যাগ করতে পারি।
শুনে সে ছিল নীরব।
তুমি তো জানতে না তার লালসার কথা
অথবা অবাস্তব চেতনায় ভরা আস্ফালনের শহরে
কাচের মাঝে তার অবাস্তব প্রতিবিম্ব দেখার স্বপ্ন।
তুমি যে মেঘময় বিষাদ, বোদলেয়ার আর
বৃষ্টি অথবা দেওয়ালের ফাটল দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া
আলোর প্রেমিক ছিলে।
তুমি যে নির্জনতা, নিস্তব্ধতা চেয়েছিলে।
আজ দেখো,
তুমি নির্জন দ্বীপে সাধনা করছো
আর তোমার চারপাশে ঢেউয়ের শব্দে সেতারের মূর্ছনা
অথছ তোমায় বাঁচাতে
ওরা কোনো জাহাজ, এমনকি নৌকাও পাঠাবে না।

রাজনৈতিক কবিতার বিপরীতে

কৃতবিদ্বেষ, মানবজাতির কী হবে বলো তো?
ধংসোন্মুখ এ স্নেহনিলয়, জলে ভাসা শব
জলের আগাছা আগুনে পুড়ছে, ক্ষত
দ্বিগুণ বেড়েছে। রয়েছ নীরব?
             উৎপল কুমার বসু

দূরপাল্লার ট্রেনের জেনারেল কামড়ায় রোকেয়া
স্বপ্ন দেখলো,
গ্রামে তার খোকন কাঁদছে।
এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে দেখে
পনেরো ষোলো বছর বয়সী মেহেনাজের কোলে
এক দুধের শিশুর বিচ্ছিরি কান্না,
লজ্জায় মেহেনাজ ব্লাউজ খুলে দুধ খাওয়াতে ভীত
আর ওপরের বাঙ্কারে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে
মেহেনাজের কালো ভুঁড়িঅলা দ্বিগুণ বয়সী স্বামী।
সারাদিন হাওড়া স্টেশনে কুলিগিরি করার পর
বদ্রীনাথ ব্রিজের নিচে বসে বিড়ি খেতে খেতে ফ্যালফ্যাল অবুঝ চোখে
বড়বাজারের গতিবিধি দেখে আর বিহারে ফেলে আসা গ্রামে
তার মা, মৃত বাবা, স্ত্রী আর ফুটফুটে মেয়ের সযত্নে রক্ষিত স্মৃতির
জাবর কাটে।

শিউলির শিয়ালদহের কাছে এক নোংরা খালের ধারে বসবাস।
সাইকেলে করে কিশোরী চারপাশ ঘোরে গাছ দেখবে বলে।
কিন্তু শুধু গাছ, আগাছা, বন্ধ্যা ডুমুর আর
কখনও সখনও জংলি ফুল।
আপসোস শিউলির যে, সে কখনও শিউলি, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পাতাবাহার দেখেনি।
এসব দেখি আমি।
আমি শহরের ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিপ্লবীদেরও দেখি,
এক দলের সাথে আরেক দলের বিরোধিতা নৈকট্য গসিপ দেখি, যা হয়
সুরক্ষিত কলেজ স্ট্রীটের এক কেবিনে বা যাদবপুর ইউনিভারসিটির লিবারাল বেড়ার মধ্যে
আর তাদের তত্ত্ব চিবোনো, নিস্ফল মিটিং মিছিল, স্লোগান দেখি-শুনি।
অবশ্য একশো শতাংশের এক শতাংশ কাজ তারা করে না, এমনটাও নয়।
তাদের ফেসবুক বিপ্লবের মৃত এলিট বিপ্লবচর্চা দেখি হামেশাই,
তাই ধুয়ে ফেলেছি মস্তিষ্কের কোটরে কুক্ষিগত সমস্ত সাম্যবাদের আশা
আর রুমির কথা মেনে
অল্পবয়সের পৃথিবী পালটানোর আশা ছেড়ে
আজ নিজের আত্মার পরিশুদ্ধিতে প্রস্তুত হয়েছি।

চলে গেলে তাই

সেদিন চারপাশ তোমায় আমায় মেলাবার ষড়যন্ত্র করছিল,
গাছের ফাঁকে পড়ন্ত বিকেলের আলো,
উতল হাওয়ায় শিরীষ মহুয়ার পরশ,
সেদিন শুধু তোমার কথা আর ছিল লাল চাঁদর।
এতদূর থেকে কি কিছু শোনা যায়?
শুধু চিৎকার, শুধু আস্ফালনের শব্দ
কোনো দেওয়া-নেওয়া কি আদৌ হয়?
নাকি শুধু ‘আমি আমি’ ‘তুমি তুমি’ কলরব?
তোমার গলায় গানগুলো হারিয়ে গেল কী করে?
বুঝি না কীভাবে হারিয়ে গেল আমাদের গল্প,
এতদূর থেকেও হয়তো শোনা যেত,
বড় বেশি নিয়ন স্যাটেলাইট দূরাভাষ এসে গেছে মাঝে।

অদৃশ্য স্পর্শ

মুহূর্তে লীন অনন্তকে ছুঁতে পারো?
পাতার পড়ায় যে গল্প লেখা থাকে
সে গল্প চেষ্টা করো পড়ার।
গ্রীষ্মের দুপুরে কলকল বয়ে যায় নদী,
শুকিয়ে গেছে অনেকটা তার,
তবু কলকল শব্দ থামে না।
সে শব্দে প্রেমিকার বিরহ,
সে নদী কান্নার জলে তৈরি
সেই প্রেমিকার দিঘল চোখ দেখতে পাও?
প্রাত্যহিক দুনিয়ার বাইরে
আরেক দুনিয়া আছে
যেখানে শালবনে দোল খায় রাই,
চলো লালমাটিতে শুয়ে গল্প করি।

অ্যাস্ট্রোনটের প্রেম

মহাকাশ পানে চেয়ে কী দেখিস?
তোর পাশে ঘাসের আড়ালে
ঝোড়ো হাওয়ায় যার চুল ওড়ে
সেই কিশোরীকে দ্যাখ।
কিশোরীর হৃদয় ভাঙা ঠিক নয়,
কিশোরীর ছোট্ট বুকে অমর প্রেমগাথা,
বুকের ওঠানামায় ভয় আর প্রেম
মিলেমিশে ঘাসের ওপর তোকে চায়।
যখন রাতবিরেতে তারায় তারায় ভ্রমণ করিস,
ওর চোখে অপলক তোর আনাগোনা,
যখন ব্ল্যাকহোলে ডুবে যাবি,
ওই পারবে ফিরিয়ে আনতে তোকে।
আজ ঝোড়ো হাওয়ায় সব ভুলে যা,
ফেলে দে পেন বইখাতা,
ফেলে দিয়ে সব জ্ঞানের জঞ্জাল,
কিশোরীর বুকে ঠাঁই নে।

বিপ্লবের মুহূর্তে

বিপ্লবের মুহূর্তে দুই হিজড়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দ্যাখে,
বেয়নেটের সামনে আলিঙ্গন তীব্র হয়ে ওঠে,
প্রেমিকদের প্রেমিকারা অজানা আরও আরও প্রেমিকের চুমুতে স্নাত হয়।
বিপ্লবের মুহূর্তে দেশভাগের রিক্ত পরিহাসের কাঁটাতারে
মায়ের সাদা লালপাড় শাড়ি ঝুলতে থাকে,
শীর্ণ বিবস্ত্র মা শক্ত কোলে নবজাতককে নিয়ে
সপ্তসিন্ধু পার হয়,
চুমু আর ফসলের দিব্যি খেয়ে গান গাইতে গাইতে
অস্ত্র তুলে নেয় নিষ্পাপ পাহাড়িকন্যা।
বিপ্লবের মুহূর্তে লাশের গন্ধ তীব্রতর,
ক্ষয়ে যাওয়া জীর্ণ পুঁজ থেকে একদলা মাংস,
রক্ত আর জলের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য থাকে না,
পার্থক্য থাকে না সঙ্গমে আর খুনে।
বিপ্লবের মুহূর্তে তোমাতে আমাতে ষড়যন্ত্র হয়
ঝড়ে চিকন পাতা দোলাবার,
ষড়যন্ত্র হয় তারায় তারায়
চিরবিচ্ছিন্ন দুই গ্রহাণুপুঞ্জকে মেলাবার।
বিপ্লবের মুহূর্তে স্লোগান দিয়ে প্রেমনিবেদন হয়,
প্রেমিকারা প্রেমিকদের কমরেড বলে ডাকে,
সব কবিতা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক,
সব প্যামফ্লেট হয়ে ওঠে কবিতা।

বিরহ আলাপ

একদিন হাওয়া হয়ে যাব
কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে চিৎকার করবো, তুমি ছাড়া গন্তব্যই বা কী!
আর পথই বা কেন! তুমি ছাড়া চলমান ছবি একরাশ লাশ হয়ে
পড়ে থাক কবরে।

তবু এসব কিছুই শুনতে পাবে না তুমি,
তুমি তোমার প্রাত্যহিক মুখরতায়
দৈনন্দিন আলুথালু বেশে
থাকবে বেশ।
যখন দুর্ভিক্ষ এসে কড়া নাড়বে তোমার দরজায়
তুমি থাকবে মগ্ন
মেঘের আড়ালে প্রেমিকের লীলাখেলায়,
চুপটি করে যখন দেখবে বৃষ্টির কড়ানাড়া
তখন হয়তো আমি উন্মাদ হতে চলেছি,
পিষে গলে মরতে চলেছে সহস্র সহোদর তোমার।
একবারও ভেবেছো প্রিয়তমা
কী এসে যায়?
কী এসে যায়
যে তোমাকে চায় তাকে কাছে টেনে নিলে
শিউলির স্তবক দিয়ে তার স্বপ্ন ভরিয়ে দিলে
মৃতপ্রায় মানুষকে আশা এনে দিলে,
একবারও কী ভেবেছো
হে প্রিয়তমা?