অমিয় রায় দীপের তিনটে খুদে গল্প

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০২৩

ভোগ ভাগ্য রূপী


পোড়া সিগারেট থেকে ধোঁয়া বের হয়। কিন্তু আমি যে পুড়ছি তা থেকে কোনো ধোঁয়া বের হচ্ছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। অনেক রাত। রাস্তায় মানুষজন নেই। কয়েকটা কুকুর রাস্তায় হাঁটছে। হাতে থাকা সিগারেটটার কথা ভুলে গিয়েছি। ছাই হয়ে পুড়ে যাচ্ছে সিগারেটটা। ধোয়াঁ জানালা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে।

 

চাঅলা মজিদের একটা কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন মজিদ বলেছিল, ভাইজান রূপ কিনতে রূপী লাগে।
একবারে চিরন্তন সত্য একটা কথা বলেছিল মজিদ। পিছনে তাকিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা অনন্যাকে দেখলাম। আমার ঘরে এই রূপ তো রূপীর জোড়েই। কিন্তু মজিদ ভাই, রূপী দিয়ে রূপ কেনা যায়, মনটাতো যায় না। ৫ মাস ১৬ দিন হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। তবে লাখ টাকা বাজি ধরে বলতে পারি, এই এতদিনের মধ্যে ৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের জন্যও অনন্যা পুরোপুরি আমার হয়নি।

 

খুব ভদ্র মেয়ে। তাই এখনো সজীবের সাথে পালিয়ে যায়নি। সজীব, অনন্যার রূপীহীন রূপের মালিক। আমি জানি, সপ্তাহে দু’তিনবার তাদের দেখা হয়। এই যে এখন ঘুমোতে যাওয়ার আগেও মোবাইলে তাদের goodnight বলা হয়েছে। আমি যে সব জানি, এটা কাউকে বলি না। সবাই জানলে তখন বলবে, আমি জেনেও কিছু করছি না কেন?

 

হ্যাঁ, সত্যিই আমি কিছুই করছি না। বাধা দিচ্ছি না অনন্যাকে। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। মনের ভেতর খুব আক্রোশ হয়। মনে হয় সজীবকে গুণ্ডা লাগিয়ে খুন করে ফেলি। অনন্যাকে কষে দুটো চড় মারি। তারপর বলি, বিয়ের পর পরপুরুষ কেন? কিন্তু আমার রাগ খুব ক্ষণস্থায়ী। একটু পরেই রাগ চলে যায়। কী দরকার মারামারি করার!

 

মেরে-ধরে আসামি হওয়া যায়, প্রেমিক কিংবা স্বামী নয়। এই ৫ মাসে একদিনও অনন্যার জন্য গোলাপ কিনে আনিনি। কারণ, তার ফুলদানিতে প্রতিদিনেই নতুন গোলাপ থাকতো। সেদিন অনেকক্ষণ অনন্যার হাতটা ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু শুধু রক্ত মাংসের হাতটাই ধরেছি, মনের স্পর্শে যাওয়া যায়নি। বিয়ের পর থেকে বন্ধুরা দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, বস্ কি খবর। আমি বলি, অস্থির। তবে যুধিষ্ঠিরের মতো আমিও একটা শব্দ খুব আস্তে উচ্চারণ করি, মনের ভেতর। যা তাদের কর্ণভেদ করতে পারে না।

 

অনন্যা আমার স্ত্রী। তার ওপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। প্রচুর হাসি পাচ্ছে কথাটা মনে হয়েই। আমি, অধিকার আর অনন্যা। সত্যিই হাস্যকর। ভাবছি, দিন কয়েকের মধ্যেই অনন্যাকে বলে দেব, তার পছন্দের রাস্তাটা বেছে নিতে। এভাবে তো আর সারা জীবন চলবে না। সোজা বলে দেব, তুমি চলে যাও। তুমি যখন আমার না তখন আমার বাড়িতে থেকে অন্ন ধ্বংস করার কোনো অধিকার তোমার নেই।

 

কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হবে। একটা কথা কি, সে আমার ভোগে ছিল কিন্তু ভাগ্যে না। যখন ভাগ্যেই নেই তখন ভোগের সুখে কি দরকার।

 

সিগারেটটা শেষের দিকে আসতেই আঙুলে আগুনের তাপটা লাগলো। সাথে সাথে চমকে উঠলাম। ভোরের আযান দিচ্ছে। ভাবছি, আজকে আর ঘুমোবো না।

 

গোধূলি

 

তুমি মিছে কথা কইছ।
এই বলে ৭ বছরের কুসুম, যতি সরকারের দোকান থেকে বের হয়ে গেল।
গত রাতে যতি সরকার, মাইনুদ্দিন আর আলম ভূঁইয়া কুসুমদের বাড়িতে এলো। তিনজনেই খুব টলছিল। কুসুমকে দেখে যতি সরকার বললো, তোর মা কই?
কুসুম বললো, ঘরে। কেরে কাকা।
এটার কোনো উত্তর না দিয়ে তিনজনেই ঘরে ঢুকে গেল। বাঁশের বেড়া আর ছনে ছাওয়া একটা ঘর। সামনে একটা ছোট বারান্দা আর ছোট্ট একটা উঠোন। বারান্দার পাশেই একটা চুলা।

 

৪-৫ মাস আগে কুসুমের বাবা মারা গেছে। তিনজনকে দেখেই কুসুমের মা সবিতা চিৎকারের স্বরে বললো, আপনেরা ঘরে।
এই কথা বলার সাথে সাথেই আরেকটা চিৎকার দিলো সবিতা। বারান্দা থেকে কুসুম চিৎকার দিয়ে ঘরে ঢুকলো, মা কি হইছে। কুসুম ঘরে ঢুকে দেখে তার মা মাটিতে পড়ে আছে, মাথা থেকে রক্ত পড়ছে।

 

কুসুম মা`র কাছে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করছে, মা`র কি হইছে মা কথা কয় না কেরে।
মাইনুদ্দিন বললো, তোর মা পইড়া গিয়া মাথা ফাইট্টা গেছে।
আলম ভূঁইয়া বললো, তোর মা`রে হাসপাতালে নিতে হইবো। এই বলে তিনজনে ধরাধরি করে সবিতাকে তুললো।
কুসুম বললো, কাকা আমিও হাসপাতালে যাইয়াম।
যতি সরকার বললো, তুই বাইচ্চা মানুষ হাসপাতালে গিয়া কি করবি। বাড়িত থাক্, খালি বাড়ি পাইয়া আবার চোর আইয়া পড়বো।
মাইনুদ্দিন বললো, পাড়ার কেউরে এই কথা কইছ না, মাথা ফাডার খবর পাড়ার মানুষ জানন ভালা না।

 

এই বলে সবিতাকে নিয়ে তিনজন চলে গেল। উঠোনের শেষ মাথা পর্যন্ত কুসুম এলো। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে যতটুক দেখা যায় দেখে কুসুম ঘরে ফিরে এসে কাঁদতে লাগলো।
পরদিন সকাল থেকে কুসুম মা`কে খুঁজছে। হাসপাতালে একটু উঁকি দিয়ে ভয়ে চলে এলো। ওই তিনজনের কাউকেও খুঁজে পাচ্ছে না। আশেপাশের কাউকে বলতেও ভয় পাচ্ছে। হঠাৎ আলম ভূঁইয়ার দেখা পেতেই সে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো।
আলম বললো,তার মা বাড়ি ফিরে গেছে। কুসুম দৌঁড়ে বাড়ি এলো। কিন্তু মাকে পেল না। কুসুম খুঁজতে খুঁজতে যতি সরকারের দোকানে গেল। যতি সরকারকে দেখে মায়ের কথা বলতেই সেও বললো, বাড়ি চলে গেছে। তখন কুসুম বললো, তুমি মিছে কথা কইছ। সারাদিন চলে গেল কুসুম মা`কে খুঁজে পেল না।

 

গোধূলি বেলা সূর্য ডুবকে বসেছে। কুসুম পুকুর পাড় দিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ কুসুম দেখে পুকুর পাড়ের শেষ মাথার বেলগাছটায় কি যেন ঝুলছে। প্রথমে একটু ভয় পেল তারপর এগিয়ে গেল কুসুম বেলগাছটার দিকে। দড়িতে ফাঁসি দিয়ে ঝুলছে সবিতা। একেবারে ছেঁড়া কাপড়। বিধবার সাদা শাড়ি লাল রক্তে ভেজা।

 

কুসুম চিৎকার করে মায়ের পা ধরে কাঁদছে,বুঝতে পারছে না ঠিক কি হলো। হঠাৎ মায়ের ঝুলন্ত লাশের পেছনে দেখে যতি, মাইনুদ্দিন, আলম। যতি নিজের জামার বোতাম খুলছে আর কুসুমের দিকে একটু একটু এগোচ্ছে। মাইনুদ্দিন বললো, কি যতি মাইয়ারেও। যতি বললো, মা গেল মাইয়া ছাড়ি কেমনে। ছাইড়া দিলে পাপ হইবো যে।

 

ভাগের মা

 

উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়েছে অর্ক। একটু খুশি খুশি লাগছে মনে হয়। রাস্তার চায়ের দোকানে গিয়ে একটা চায়ের অর্ডার করলো। ছোট ভাই অনুর সাথে বাবার তিন শতাংশ জমি নিয়ে মামলা। অর্কর দাবি সে দুই শতাংশ নেবে। তাদের বাবা বছর দেড়েক আগে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে কোনো কিছু দলিল করে যেতে পারেননি।
পরশুদিন মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। অর্কর উকিল আশ্বাস দিয়েছে, এই কেস জেতা তার জন্য তিন দিনের অপেক্ষা মাত্র। চা খেতে খেতে অর্ক ভাবছে, জমিটা হাতে পেলে বিক্রি করে দেবে। দুজনের সাথে কথাও বলে রেখেছে সে, ভালো দাম পাওয়া যাবে। যদি তিন শতাংশ পুরোটাই পাওয়া যেত, তবে ব্যাপারটাই অন্যরকম হতো।

 

কি আর করা ঘরে শত্রু থাকলে যা হয় আরকি। যাই হোক, যে ফ্ল্যাটটা দেখে এসেছে সেটা কিনে নেবে। মামলা জেতা জমি হাতে পাওয়া বিক্রি করা তারপর ফ্ল্যাট, এই তো শুধু সময়ের অপেক্ষা। তুলি মানে অর্কর স্ত্রী, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে এবার ফ্ল্যাট না কিনলে আবার কোর্টে যেতে হবে, তবে সেটা ডিভোর্সের জন্য। আর কতদিন অন্যের বাসায়।

 

চায়ের বিলটা দিয়ে রাস্তা হাঁটা দিলো অর্ক। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কথা ভেসে এলো অর্কর কানে, উকিলের কাছ থেকে এলে বুঝি। অর্ক পেছনে তাকিয়ে দেখে অনু দাঁড়ানো। অর্ক অনুর আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বললো-তোর ও তো মনে হয় সেরকম জায়গা থেকেই আসা অনু- নাহ্, সে উকিল আমার বাড়ি আসে আমি তার কাছে যাই না অর্ক- বাব্বাহ্ তা এতো বড় ব্যক্তি এইটুকু জমির জন্য লড়ছিস অনু- ভাগের জিনিস, ছেড়ে দিলে সে পাপ হবে অর্ক- পাপ পূণ্যি সে তো অনেক পরে। কিন্তু এখন যে তোর মন ভাঙবে ভাই।
কেন অর্ক- মামলটা যে আমিই জিতছি, তখন তোর মন কষ্ট হবে, মন ভাঙবে না বল অনু- হাসালে দাদা।

এখনো কাঁঠালের গাছটাও লাগালে না, গোঁফটাও উঠলো না আর তেল খুঁজতে শুরু করে দিলে অর্ক- তোকে আরেকটা কথা শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি, মাকে কি তুই নিবি অনু- কি বলে, তুমি বড় ছেলে তুমিই নিচ্ছো না আমি কোন দুক্ষে অর্ক- আমি একটা জিনিস চিন্তা করেছি, মাকে কাকার বাসা থেকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো অনু- কোন জায়গায় অর্ক- দু-এক জায়গায় কথা বলেছি দেখি কোথায় কি সুবিধা হয়।

 

আচ্ছা,আর বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাটা দিও, মা তো আর তোমার একার না। আমারও তো গিয়ে দেখে আসতে হবে।
আচ্ছা, জানিয়ে দেব।
আজ চললাম পরশুদিন কোর্টে দেখা হচ্ছে। এই বলে অনু চলে গেল। অর্কও আগের মত হাঁটা দিলো। অর্কর তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। আজকে আবার তুলিকে নিয়ে ডিনারে যেতে হবে। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। কোনো কাচঘেরা ঠাণ্ডা ঘরওয়ালা রেস্টুরেন্টে।