অমিতাভ পালের গল্প ‘স্ক্রিপ্ট’

প্রকাশিত : জুলাই ১৭, ২০২০

হুট করেই বিয়েটা করে ফেলেছিলাম।

হয়েছে কি, এক সন্ধ্যায় আমার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিলাম রিকশা দিয়ে। পার্কের পাশের রাস্তাটা ছিল নির্জন। দোকানপাটের বালাই ছিল না, কেবল ফুটপাথে বসতো ফেরিঅলারা। তারাও সন্ধ্যার পর খুব একটা থাকতো না। রাস্তার লাইটপোস্টগুলিও মাঝেমাঝেই অভিমান করে মুখ কালো করে রাখতো। ফলে একটা নির্জন, আধো আলো আধো অন্ধকারের নকশাবোনা রাস্তার সন্ধ্যা যেকোনো যুবককেই যে কিছুটা প্রগলভ করে ফেলবে— এতে আর আশ্চর্য কি!

আমাকেও করেছিল। রিকশায় একটা জলজ্যান্ত মেয়ে— যে এই পৃথিবীতে প্রতিদিন থাকলেও মনে হয় অন্য কোনো গ্রহের মতো সুদূর, আবার খুব আপনও— তার গন্ধ, তার স্পর্শ— সব এত চেনা অথচ অচেনা এবং খুব চিনতে ইচ্ছা করে— তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে আগ্রহ না জাগলেই বরং চিন্তার। আমিও ওই চিন্তাটাকে জেগে ওঠার সুযোগ না দিয়ে আবহমান পুরুষদের মতোই জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিলাম তাকে এবং সেই ঘোর সম্মোহনে কখন যে তার স্তনেও হাত দিয়ে এক অনাস্বাদিত স্পর্শসৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম— সেটা আর মনেই ছিল না। তারপর হঠাৎ একসময় চমক ভাঙার পরে একটা অসম্ভব লজ্জার জাল এসে ধরে ফেলেছিল আমাকে এবং আমি আর চোখ তুলে তাকাতেই পারছিলাম না ওই মেয়েটার দিকে। আর মেয়েটাও চুপচাপ বসেছিল মাথা নিচু করে।

সেইদিনের পর থেকে মেয়েটার সামনে আর যেতে পারছিলাম না আমি। মেয়েটা অবশ্য ফোন করেছিল বারকয়েক কিন্তু অনুশোচনা আর অধোবদন আমাকে ওই ফোনগুলি ধরতে দেয়নি। এইভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক যখন কেটে গেছে, তখন এক নতুন অনুভূতি আমাকে চেপে ধরলো কুস্তিগীরদের মতো। সে এমন চাপ যে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো গতিই থাকে না। অনুভূতিটা সারাক্ষণ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো, মেয়েটার স্তনে হাত দিয়ে এখন তুমি পালিয়ে যেতে চাইছো? সর্বস্ব লুট হওয়া মেয়েটা এখন কোথায় যাবে, বলো তো? যৌবনের এইসব প্রোজ্জ্বল নীতি এমন এক আলোর নিচে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিতো যে, নিজেকে কুৎসিত, নগ্ন, শয়তান, লম্পট— এসব ছাড়া ভাবতেই পারতাম না। শেষে সব দায় নিজের মাথায় নিয়ে মেয়েটাকেই আমার বউ করে ফেললাম।

বিয়ের পর এক নতুন সমস্যা এসে জুটলো আমার জীবনে। স্বামী কে, তার চরিত্র কেমন, সংসারে সে কিভাবে থাকে, বউয়ের সঙ্গেই বা কি কি কথা বলতে হয় তাকে— এসব কিছুই জানি না বলে সারাক্ষণ চুপ করে বসে থাকতাম আর চিন্তার জগত উল্টেপাল্টে খুঁজতাম আমার আগেই যারা স্বামী হয়ে গেছে— তাদের বাণী অথবা মহদাশয় ব্যক্তিদের চরিত্র ব্যাখ্যা করা মহদোক্তিগুলি। এরমধ্যে শেক্সপিয়ারের একটা কথা খুব মনে ধরলো, পৃথিবী একটা নাট্যশালা আর জীবন তার অভিনেতা। হয়তো হুবহু এভাবে তিনি বলেননি কিন্তু সমস্যাসঙ্কুল একটা মস্তিষ্ক যে এই ভাবানুবাদটুকু বের করতে পেরেছে প্রয়োজনের সময়— সেটাই বা কম কি! আমিও ঠিক করলাম অভিনেতা হবো, স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করবো। তাতে অন্তত একটা বড় সমস্যা আমাকে আর ঘায়েল করতে পারবে না। সেটা হলো, নিজে কথা না বলতে পারার অশান্তি। নাটকে তো দেখেছি, রচয়িতার দেয়া সংলাপ আউড়ে দিয়ে অভিনেতারা খালাস। কোনো ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, শুধু মুখস্ত করো আর বলো। আমিও ঠিক তাই করবো ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে বিমর্ষ চিন্তাগুলিকে তাড়ালাম জঞ্জালের মতো।

কিন্তু করবো বললেই কি করা যায়? অভিনয়ের জন্য একটা স্ক্রিপ্টের তো দরকার। সেইসঙ্গে দরকার চরিত্রের সঙ্গে মানানসই সংলাপও। এগুলি কোথায় পাই? গোপনে দুইএকটা বইয়ের দোকানে ঘুরেও এলাম কিন্তু আমি যা চাইছি, সেরকম জিনিস কোথাও পেলাম না। এত দেখি মহাসমস্যা। এখন কি করি? এদিকে দিনদিন আমার চুপ করে থাকা ভূমিকায় বউ খুব অসন্তুষ্ট। তাকে সান্ত্বনা দিতে হু হা জাতীয় শব্দগুলিকেই আমার ভাষা, আমার দোভাষী, আমার প্রতিনিধি ইত্যাদি যাবতীয় আমি বানিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম আর গোপনে খুঁজতে থাকলাম আমার মনমতো স্ক্রিপ্ট এবং সংলাপ।

এভাবেই দিন কাটছিল আর কাটতে কাটতে পেরিয়ে যাচ্ছিল একটা দুইটা করে বছরের পর বছর।

দুই.
আমাদের দ্বাদশ বিবাহবার্ষিকীতে রাতের ভোজন সেরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আলোর ঝলকানি আর সাথে সাথেই বিরাট শব্দে পড়লো একটা বাজ। ভয়ে এক পা পিছিয়ে দরজার দিকে যেই গেছি অমনি ঠিক তখনি দরজা পেরিয়ে ব্যালকনিতে আসতে থাকা বউয়ের সঙ্গে লাগলো একটা ধাক্কা। দেখলাম দুজনেই খুব সহজে পরস্পরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ধাক্কা লাগায় আমাদের কারণগুলি বলতে শুরু করেছি জড়তাহীনভাবে এবং দুজনেই দুজনকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সাথে সাথেই আমি টের পেলাম, অভিজ্ঞতাই স্ক্রিপ্ট এবং কথাপ্রসঙ্গে বলা কথাগুলিই সংলাপ।

এখন আমি স্বামীর ভূমিকায় বেশ ভালোই অভিনয় করি।