অলঙ্করণ: শুভময় রায়
অমিতাভ পালের গল্প ‘মাইগ্র্যান্টমঙ্গল’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার
বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে রাতে আর ঘুমাতে পারে না লোকটা। বারবার চোখে ভেসে ওঠে ছেড়ে আসার ওই রাতটার ছবি। নির্মম লোকগুলির মুখ। ঘরদোর, জিনিসপত্র, উঠান, পথ দেখানো চাঁদ আর ভয়। এই সবকিছুকে চাপা দেয়ার সাধ্য তার ঘুমের নাই। অথচ সময়তো কম গেল না, প্রায় তিরিশ বছর। ঘুমও যে বিড়ালের মতো সাথেই থাকে অথচ পোষ মানে না, সেটা কে জানতো?
দেশে থাকতে লোকটা খুব ঘুমাতো। লোডশেডিংয়েও তার এতটুকু অসুবিধা হতো না। কোথাও একটু শোবার জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়তো নিশ্চিন্তে, যেন মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছে। লোকজন তাকে খেপাতোও খুব। অবশ্য এতে তার কিছু আসতো যেত না। অথচ সেই ঘুম যে কোথায় গেল! মাঝেমাঝে মনে হয়, সে দেশে থেকে যাওয়া ছেলেবেলার বন্ধুর মতো হারিয়ে গেছে, তার সাথে আসেনি।
আশ্রয় নেয়া দেশটাতে এখন তার ভরা সংসার। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, সবাই চাকরি কিংবা ব্যবসা করে। কারো চেখে ভয় বা অস্বস্তি নাই। তার বউও বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মেয়েদের এই একটা গুণ, স্থানান্তরেও তারা গাছের মতোই বেড়ে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে। শুধু একটা ব্যাপারেই বউয়ের আপত্তি, তারা এখনো ভাড়াবাড়িতে থাকে।
এরকম এক পরিস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ছেলেমেয়েরা সিদ্ধান্ত নিল, তারা নিজেদের বাড়ি বানাবে। সেইমতো জায়গাজমি দেখে পছন্দও করে ফেললো। লোকটা অবশ্য এসব কিছুই জানতো না, তাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই জানানো হয়নি। শেষে জমি কেনার আগের এক সন্ধ্যায় পারিবারিক সভা ডাকলো বড় ছেলে এবং বাবাকে বললো জমিটার কথা।
সাথেসাথেই তীব্র আপত্তি জানালো লোকটা। স্পষ্ট জানিয়ে দিল, বাড়ি করা যাবে না। তার আপত্তিতে বউ, ছেলেমেয়ে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে শুরু করলো তর্কযুদ্ধ। লাঠির মতো সোজা হয়ে থাকা লোকটাকে তারা নোয়াতে চায়, রাজি করাতে চায় তাদের মতের সঙ্গে। কিন্তু লোকটাও যেন নাছোড়। তার চোখে কেবলি ভেসে ওঠে দেশে ফেলে আসা তাদের বাড়িঘর, জিনিসপত্র, উঠান, পথ দেখানো চাঁদ আর ভয়।
শেষে তর্ক যখন চরমে, লোকটা বলেই ফেললো তার আশঙ্কার কথা। শুনে সবাই হেসেই বাঁচে না। অহেতুক এই ভয় আর কোনোদিন তাদের কিছুই করতে পারবে না, বললো বড় ছেলে। আরেক ছেলে জানালো, এখন তারা যে দেশে আছে, সেখানকার সবাই তাদের ধর্মের লোক। এটা কখনো পাল্টাবে না। লোকটা বললো, তার দেশও তো এইরকমই ছিল। সেখানেও ঘুম ছিল, শান্তি ছিল, একইরকম লোক ছিল— কিন্তু সেটাতো বদলে গেছে। এই দেশটাও যে বদলাবে না, তা বলবে কে?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কে বড় হয়ে যাওয়া চোখে চারদিকে তাকিয়ে লোকটা ফিসফিস করে বললো, বাড়ি না বানিয়ে বরং টাকাগুলি রেখে দাও। আবার দেশ ছাড়তে গেলে জীবন আর সম্ভ্রম বাঁচাতে এগুলি কাজে লাগবে।