অমিতাভ পালের গল্প ‘টান’

প্রকাশিত : মে ২৫, ২০১৯

বউকে আজকাল আর তৃপ্তিদায়ক লাগছে না। অথচ রাস্তার সব মেয়েই কত চমৎকার। কী সুন্দর তাদের হাঁটাচলা, কথাবার্তা, শরীর— আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। সব যেন মাংসের রেজালা, রোস্ট, ভুনা এবং সবাই যেন কোনো বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের রান্না— যারা শুধু রেঁধেই শেষ করে না, পরিবেশনটাও হয় জবর। ফলে মাংস আর মাংস থাকে না, সালাংকারা হয়ে ওঠে। এরকম মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে কোন পুরুষই না চাইবে!

আর আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন? একটা অপরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে অবহেলায় ফেলে রাখা একদলা মাংস যেন। এখনি যেন এই মাংস দিয়ে একটা ট্যালটেলে ঝোল রান্না করা হবে, এদিকে হয়তো আজ ছুটির দিন, দুপুরে একটু জমিয়ে খাব— কিন্তু কোথায় কি? ছুটির পুরা দিনটাই ওই ঝোলের মতো ট্যালটেলে হয়ে যায়। মেজাজ যায় গরম হয়ে। শেষে কোনোমতো কয়েক গরস ভাত খেয়ে বউয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দুপুরটা ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে? বউয়ের উৎকট ঘামের গন্ধে ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন ঢোকার সাহস পায় না। ফলে রাস্তায় দেখা কোনো একটা মেয়েকে যে স্বপ্নের ঘরে তুলে আনবো, একটু আদর সোহাগ করবো— সেটা আর হয়ে ওঠে না। বাধ্য হয়েই তাই ঘুম থেকে উঠে পড়ি এবং পাশে ঘুমিয়ে থাকা বউকে জাগিয়ে বাধ্য করি চা বানাতে। বউও আমার গরম চোখের সামনে বেশি গাইগুঁই না করে চা বানিয়ে এনে ঠকাস করে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে আমার সামনে। আর এক তপ্ত দুপুরে— যখন সবাই ভরপেট খেয়ে ঘুমাচ্ছে আরামে— আমরা দুইজনে দুইদিকে তাকিয়ে অনাবশ্যক চা গিলতে থাকি।

অথচ ওইসব রেজালা, রোস্ট বা ভুনা মাংসের মতো মেয়েগুলি— যারা কোনো বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের ঔদার্যে সালাংকারা— তারা নিশ্চয়ই এরকম কোনো দুপুর উপহার দিত না আমাকে। সেখানে ভরা পেটে জেগে ওঠা যৌনতায় আমরা মুগ্ধ করতাম পরস্পরকে। আমরা কথা বলতাম— বুকের বাক্স উপুড় করে ঢেলে দিতাম গোপনে জমানো সবকিছু। তারপর ছুঁয়ে-ছেনে-চেটে-বলে-শুনে মধুর ক্লান্তির বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সেসব কি আর আমার বউকে দিয়ে হবে? তাই রাস্তায় মেয়েদের দেখেই আমার দিন কেটে যায়। আর এক অবদমন ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে ঘুমন্ত দৈত্যের মতো।

এইভাবেই আমার দিনগুলি কাটছিল আর বাড়ছিল বউয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং রাস্তায় দেখা মেয়েদের প্রতি টান।

দুই.
তারপর একদিন কোনো এক সকালে যখন আমি অফিসে যাচ্ছিলাম আর বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম মেয়েদের— এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটা যেন নাচছিল। তার নিতম্ব যেন পৃথিবীর সব মহাসাগরের ঢেউয়ের মধ্যে তিমিদের মতো খেলছে। লোকাট কামিজের ওপর দিয়ে বেরিয়ে থাকা তার পিঠটা যেন ভোরের সূর্য— চারপাশ যেন ভরিয়ে দিয়েছে আলোয়। কোমরের ক্ষীণতায় লজ্জা পাবে যেকোনো বিউটিশিয়ানের ডায়েট চার্ট। পরিচ্ছন্ন গোড়ালির ফর্সা আলোকচিত্রে মুগ্ধ হবে যেকোনো শ্বেতাঙ্গ।

আমিও মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম— এরকম একটা মেয়ে যে পুরুষের হবে, তার আর কি চাইবার থাকবে! এমন সময় কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে এসে আমার মনযোগটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। কিন্তু কি আর করা, ভাড়াতো দিতেই হবে। ঠিক তখনি বাস থেকে কে নামতে চাওয়ায় বাসটা দাঁড়িয়ে পড়লো আর মেয়েটাও সেই ফাঁকে এগিয়ে গেল অনেকটা। যাক, ভাড়া দেবার পরও মেয়েটাকে আবার বেশ কিছুক্ষণ দেখতে পাবো। ছিন্নভিন্ন ভাবনাগুলিকে আবার জড়ো করে তৈরি করতে পারবো একটা নকশিকাঁথা। একটা সুগন্ধ মাখা পুলক যেন ছড়িয়ে পড়লো আমার সারা ভাবনায়।

আবার এলো সেই চমৎকার মূহূর্ত, আবার আমার জানালার কাছে চলে এলো সেই তিমির দল, ভোরের সূর্য আর গোড়ালির মুগ্ধতা। আমিও আবার দৃশ্যটার প্রতিটা ফ্রেম দেখতে লাগলাম চেটে চেটে।

হঠাৎ মেয়েটা যেন টের পেয়ে গেল তাকে কেউ দেখছে তীক্ষ্ণভাবে। সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে সে তাকালে আমার দিকে। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মেয়েটা আমার বউ।

তিন.
সেইদিন থেকে সমস্ত ছুটির দিনগুলিতে দুপুরে চমৎকার সব খাবার খেয়ে, বউ আমাকে এবং আমি বউকে জড়িয়ে ধরে লম্বা ঘুম ঘুমিয়ে, পড়ন্ত বিকেলে পরস্পরের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি।