অমিতাভ পালের গল্প ‘আত্মীয়স্বজন’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯

রাত নয়টার দিকে লোকটা রিসর্টে পৌঁছালো।

সে একটা দলের সঙ্গে এসেছে শহরের কোলাহলের বাইরে একটু নির্জনে কয়েকটা দিন কাটাতে। শহরগুলি আজকাল এত ঘিঞ্জি, এত জমাট হয়ে গেছে যে, দম আটকে আসতে চায়। অথচ এই শহরগুলির একটাতেই তার জন্ম, জীবনের বেশিরভাগ অংশ কাটিয়েছে আরো দুই একটায়— কিন্তু এখন আর তাদের সহ্য করতে পারে না। সবসময় ঘরের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে ইচ্ছা করে। বাইরেটা যেন বিষাক্ত, যেন অবিরাম যুদ্ধ চলছে কে কাকে পিছনে ফেলবে, গলা টিপে ধরবে— এসব নিয়ে। ভয়ে বুক ভরে বাতাস নেয়ার উপায়ও নেই— কখন কোন বিষ ঢুকে পড়ে। নিতান্ত বাধ্য হয়ে অফিস কিংবা বাজারে যেতে না হলে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া কয়েদির জীবনই কাটতো সে।

অবশ্য এই রিসর্টে সে বাধ্য হয়ে আসেনি, এসেছে ইচ্ছা করেই। অফিস কলিগরা প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরতে যায় আর ফেরে চাঙ্গা হয়ে— এই ব্যাপারটাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারপর কোনও এক শুভক্ষণে একটা প্যাকেজ ট্যুর কোম্পানির হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে সে। আর তারাই তাকে নিয়ে এসেছে এখানে, এই অবারিত ঘোর গ্রামে। কথা ছিল, বিকালবেলাতেই পৌঁছে যাবে। কিন্তু শহর কি আর সহজে ছাড়তে চায়? জ্যাম দিয়ে, স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে, ষড়যন্ত্র দিয়ে তাদের আটকে দিচ্ছিল বারবার। তবে শেষে তাদের একগুঁয়েমির কাছে হেরে রণে ভঙ্গ দিয়েছে।

রাত হয়ে গেছে বলে রাতের খাবার খেয়ে নিজের নিজের ঘর খুঁজে নিয়ে শুয়ে পড়লো সবাই। আর নির্জন গ্রামের শব্দহীন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে কখন যে তলিয়ে গেল ঘুমের ভিতরে— টেরই পেল না।

দুই.
অভ্যাসের দড়ি লোকটাকে ঘুম থেকে টেনে তুললো সকাল সাতটায়। এসময়ই সে নিয়মিত ওঠে অফিসের প্রস্তুতি নিতে। আজও ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই তার মনে হলো, অফিসের কথা। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে চেনা কিছুই যখন চোখে পড়লো না— একটু চমকে গেলেও তারপরই মনে পড়লো, সে একটা রিসর্টে এসেছে ছুটি কাটাতে। সাথেসাথেই তার আফসোস হলো এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। একটা লম্বা ঘুম, একটা বিলম্বিত সকাল, ভরপেট নাস্তা— এসবের কথাই ভেবে রেখেছিল সে এখানে আসবার সময়। অথচ এখন, নিজেকে তার মিউনিসিপালিটির ঝাড়ুদারদের মতো মনে হচ্ছে, যারা পরিষ্কারের কাজ করতে গিয়ে ভোরবেলার বাতাসটাকে আরো নোংরা করে ফেলে ধুলা আর আবর্জনা দিয়ে।

সেওতো তাই করছে, নিজের মাথার ভিতরের অজস্র অভ্যাস বিষয়ক চিন্তার ভিড়ে ভরিয়ে দিচ্ছে এই শান্ত গ্রামের সকালটাকে। তার মনে হলো, আবার ঘুমিয়ে পড়বে এবং রোদ উঠে গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে বসবে নাস্তার টেবিলে। সেইমতো চোখ বন্ধ করে শুয়েও পড়েছিল কিন্তু সকালের আলো, পাখিদের ডাক আর নির্জনতার নিঃসীম স্তব্ধতা তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দিল না আর।

উঠেই যখন পড়েছে, সে ভাবলো, হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়বে গ্রামের রাস্তায়। ঘুরে ঘুরে দেখবে চারপাশ। শরীরে মাখবে নির্জনতার গন্ধ, গাছের সবুজ আর দেশের মাটি।

তিন.
রিসর্ট থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো সে। তার দেখা হতে থাকলো ধানক্ষেতের সাথে, পাখির সাথে, গরুর সাথে— গাছগুলি পাতা দুলিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালো, বাঁশঝাড় ঝমঝম করে উঠলো। আর এসব কিছুর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল অনেকটা দূরে— একেবারে দিগন্তের কাছাকাছি।

হঠাৎ তার খেয়াল ফিরলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো যাদের ভিতরে সে আছে— তাদের কাউকেই ভালো করে চেনে না সে। চারপাশের গাছগুলির একটার নামও জানে না, পাখিরাতো আরো অচেনা। সারা জীবন সে কেবল কাক আর টবের গাছ দেখেছে। বাঁশঝাড়গুলিকে তার গহীন জঙ্গল বলে মনে হলো— মনে হলো ওগুলিতে বাঘ আছে। তার মনে হলো সে কোন অচেনা গ্রহের উঠানে দাঁড়িয়ে যেখানে পৃথিবীর কেউ নেই। এতক্ষণ যাকে নির্জনতা মনে হচ্ছিল, এখন সেখানে এত শব্দ যে, কানে তালা লেগে যাচ্ছে। শব্দগুলি যেন তাকে শাসাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, পালিয়ে যেতে বলছে। আতঙ্কে সে হতবাক হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ এভাবেই কাটলো, এই হতবাক অবস্থায়। তারপর হঠাৎই চেতনা ফিরে পেয়ে ঘুরে দৌড় লাগালো রিসর্টের দিকে। রিসর্টটার চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকতে পারলেই যেন মুক্তি মিলবে।

এমন সময় তার চোখ পড়লো রাস্তার পাশের একটা চায়ের দোকানের দিকে। যাবার সময় বেড়ার ঘরের এই দোকানটা তার নজরে পড়েনি, হয়তো অন্যমনস্কতার ফলেই কিংবা তখনো দোকানটা খোলেনি বলে। এখন সে দেখলো, দোকানের সামনে বাঁশের ফালি দিয়ে বানানো বেঞ্চে বসে আছে কয়েকজন। সে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু যেতে যেতে তার মধ্যে আবার আতঙ্কটা ফিরে এলো। সে দেখলো, লোকগুলি তার দিকে এমনভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সে ভিন্ন জগতের কেউ। তার মনে হলো, কিছুক্ষণ আগে যারা শাসাচ্ছিল, ভয় দেখাচ্ছিল— তারাই এই লোকগুলিকে পাঠিয়েছে তাকে ধরার জন্য। কথাটা মনে আসতেই সে দাঁড়িয়ে পড়লো, কিন্তু ততক্ষণে সে পৌঁছে গেছে দোকানটার একেবারে সামনে। স্বাভাবিকভাবেই সে তাকালো দোকানটার দিকে।

সাথেসাথেই স্বস্তির একটা বাতাস বয়ে গেল তার শরীরকে শীতল করে দিয়ে। দোকানটাতে দেখা যাচ্ছে চিপসের প্যাকেট, পেপসি-কোকের বোতল, কনডেন্সড মিল্কের ডাব্বা আর রকমারি সিগারেটের প্যাকেট। এরা তার খুব চেনা, তার আত্মীয়স্বজন।

আতঙ্কটা এখন আর তার মধ্যে নেই।