অমিতাভ পালের গদ্য ‘বিনয় মজুমদারের স্বাদ’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০২৪

২০১৮  সালের ১৬ জানুয়ারি ছাড়পত্রে এই গদ্য ছাপা হয়েছিল। ছাড়পত্রের নির্বাহী সম্পাদকের অনুরোধে গদ্যটি লিখেছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক অমিতাভ পাল। তিনি এখন আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। যাকে নিয়ে লিখেছিলেন সেই বিনয় মজুমদারও বেঁচে নেই। আজ বিনয় মজুমদারের প্রয়াণ দিবস। এই দিনটিকে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে দুই কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘বিনয় মজুমদারের স্বাদ’ গদ্যটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

বিনয় মজুমদারের সঙ্গে প্রথম যখন আমার দেখা হয়, কবিতা নিয়ে তখন খুব একটা সিরিয়াস ছিলাম না। সেসময় আমার সামনে ছড়িয়ে ছিল বিশাল এক জগৎ, যাবার অনেক জায়গা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই জীবনটাতে আমি ব্যস্ত ছিলাম ক্রিকেট খেলা, গান গাওয়া আর যখন যা ইচ্ছা হয়, তাই করার কাজে। এর মধ্যেই এক স্বভাবকবি আমার ভিতর থেকে মাঝেমাঝে ঊঁকি দিতো এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পত্রিকায় অন্যদেরকেও মুখ দেখাতো কখনো কখনো। আর অন্যের কবিতা পড়া বলতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ পারিবারিক আবহে যেসব কবিরা পঠিত হয়ে থাকেন, তাদের স্বাদই লেগেছিল আমার জিহ্বায়।
পরিস্থিতি যখন এই, সেসময়ই কোনও একদিন বাদামি মলাটে হলুদ অক্ষরে লেখা বিনয় মজুমদারের কবিতার বইটা দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখনই স্বীকৃত কবি কাজল শাহনেওয়াজের টেবিলে। শামসুল হক হলে কাজলের রুমটা ছিল একটা গণ আড্ডার জায়গা। আমরা প্রত্যেকেই যার যার জগৎ থেকে ফিরে কাজলের রুমে এসে বসতাম নিজেকে অন্য কোনও জগতে খুঁজে পাবার আশায়। সেইসব খোঁজাখুঁজির ভিতরেই দেখা দিয়েছিলেন বিনয় মজুমদার। তবে মনযোগের ভারি দিকটা তখনো টানতে পারেননি তিনি। সেটা পেরেছিলেন বেশ কয়েক বছর পরে।
এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। কবিতার ব্যাপারে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে আমার মধ্যে। ময়মনসিংহের নিশ্চিন্ত পারিবারিক জীবন ছেড়ে আমি চলে এসেছি ঢাকায়। চাকরি করেছি আবিদ আজাদের শিল্পতরুতে এবং প্রশিকা নামের একটা এনজিওর চাকরি নিয়ে চলে গেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার আগেই অবশ্য ঘন বন্ধুত্ব হয়েছে রিফাত চৌধুরীর সাথে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে বছর দুয়েক কাটিয়েছিলাম, সেটা ছিল সম্পূর্ণ কবিতা আর নেশায় জারিত। সেইসাথে এটাও বুঝেছিলাম, কবিতা আসলেই অনেকরকম। প্রত্যেকেরই নিজের কবিতা আছে। আর এটা বোঝাতে সবচেয়ে ভালো ক্লাসটা নিয়েছিলেন বিনয় মজুমদারই। ইতিমধ্যে তার সেই বাদামি মলাটের বইটা আমার শিয়রে থাকা বইগুলির মধ্যে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এদিকে আমি পৃথিবীর বস্তুজগতের মধ্যে ক্রমাগত ডুব দিয়ে বিষয়ের ঝিনুক ফেঁড়ে কবিতার মুক্তা খুঁজে চলেছি আর একটা পেয়ে গেলে জমিয়ে রাখছি কাগজে কলমে। সেসময়ই লিখে ফেলেছিলাম আমার প্রথম কবিতার বই `নতুন বাল্বের আলো`।
এনজিওর কোনও চাকরিজীবী আমার মতো জীবনযাপন করলে যা হয়, আমারও তাই হলো। চাকরিচ্যুত হয়ে আবার ফিরে এলাম ঢাকায়। তবে একটা লাভ হয়েছিল এতে, বড় লাভ, সারা জীবনের জন্য বিদায় নিয়েছিল চাকরি করে উন্নতি করার মোহ।
তবে বেশিদিন চাকরির বাইরে থাকতে পারিনি সেবার। প্রশিকার মূখ্যব্যক্তি আমার ক্রিকেট দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আবার আমাকে ফিরিয়ে নেন তার প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই না, আমার একটা বিদেশ সফরেরও ব্যবস্থা হয়। সেই বিদেশ সফর থেকে ফিরেই রিফাত চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় বিনয় মজুমদারের সাথে স্বশরীরে দেখা হয় আমার।
সেটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ছেউড়িয়ার লালন উৎসবের সময়। পাতাভরা সেই অভিযানের গল্প লিখেছিলামও সমকালের কালের খেয়ায়। সেই দেখাটা ছিল বিনয় মজুমদারের সাথে আমার সখ্যের চরমতম বিন্দু। আমি টের পেয়েছিলাম এর চেয়ে বেশি আর কিছুই হতে পারে না।


বিনয় মজুমদারের প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে, দুর্লভ কবির এটা থাকে। ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ার শক্তিসহ এই কবি সহজ ভাড়াটিয়া না। বিভিন্ন মতামত ও ভাবনার বিভিন্নতা থাকতেই পারে, কবি সার্বভৌম সহজ ব্যাপার না। এমনকি অসম্ভবই। তারপরও যাদের দেখা যায় লাইটপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে, বিনয় মজুমদার তাদের মতো। লোকটা প্রেম করতে জানতো।
বিনয় মজুমদারের প্রেম ছিল মেয়েমানুষ, অঙ্ক আর কবিতার সাথে। তিন বউকে নিয়ে ঘর করা এই কবি সম্পর্ক সামলেছেন সুবিপুল দক্ষতায়। প্রেমের স্বপ্ন কিভাবে দেখতে হয়, দেখিয়েছেন বিনয় মজুমদার। তবে তার সাথে সখ্য হওয়া সত্ত্বেও তার মতো করে প্রেমটাকে শিখতে পারিনি আমি। এটা অবশ্য তারই দান, প্রত্যেকের নিজের কবিতার মতো আমার প্রেম বোধও আমারই।
বিনয় মজুমদার আমাকে চমকে দিয়েছিলেন তার উপমার শক্তি দিয়ে। এমন অভাবিত, আকস্মিক আর কাছাকাছি উপমা জীবনানন্দের পরে আর খুব একটা পাইনি। আর কি অসম্ভব সেই উপমার স্ফূরণ, আ্যানেস্থেসিয়ার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়ার পরে আমি বহুদিন অন্যদের কবিতায় মন দিতে পারতাম না। তার কবিতার স্বাচ্ছন্দও ডিস্টিলড, যেকোনও কাজে লাগানো যায় এই পরিশুদ্ধ জল।
যেকোনও কিছুই যে কবিতার বিষয় হতে পারে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন এই গণিতজ্ঞ কবি। মিরোস্লাভ হোলুব বা নিকানর পাররার মতো এই কবিও বাংলা কবিতার প্রথম অ্যান্টি পোয়েট বলে আমার মনে হয়। সেইসাথে এটাও মনে হয়, বাংলা ভাষায় বিনয় মজুমদার জীবনানন্দের মতোই দুর্লভ।
বিনয় মজুমদারের যেকোনও কবিতাই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রেখে যায় পরের কবিতাটারও ইঙ্গিত। অর্থাৎ তার সব কবিতাই একটা সিরিজের খণ্ডও যেন। প্রাণ যেমন নিজে সম্পূর্ণ এবং জীবনের বিভিন্ন ফর্মের যোগসূত্র। বিনয় মজুমদারের কবিতাও সেইরকমই। প্রাণ এবং তার আকারগত উদাহরণের মধ্যে সামন্জস্যগুলি যেমন বুঝিয়ে দেয় এরা সব একেরই বিভিন্ন প্রকাশ, তেমনি বিনয় মজুমদারের কবিতাও বলে দেয় এরা বিনয় মজুমদারেরই কবিতা। অন্য কেউ বা অন্য কিছুই নেই এর মধ্যে। কবি হিসাবে বিনয় মজুমদারের অন্যতম মহত্ত্ব এটি। ঈশ্বরের মহত্ত্বের মতো, যাতে থাকে সৃষ্টিতে নিজের ছাপ রেখে দেয়ার ক্ষমতা। কবিতার ঈশ্বর বিনয় মজুমদার তাই বোধহয় লিখতে পারেন তার ঈশ্বরীকে নিয়ে কবিতার বই।
বাংলা কবিতায় দিনপন্জীর ধরণেরও উদগাতা মনে হয় বিনয় মজুমদার। প্রতিদিনের ঘটনাকে সাধারণীকরণ করার কৌশল তিনি প্রয়োগ করেছেন এই ধরণের কবিতায়। ফলে যেকোনও ঘটনাই হয়ে পড়ে বিশ্বের ঘটনা, সমগ্রতার চিহ্ন। এটা বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট, অঙ্কের বিজ্ঞান ঘাঁটা বিনয় মজুমদার এই দানও করেছেন বাংলা কবিতায়।
বিনয় মজুমদারের কবিতার আশেপাশে দুই ধরণের মানুষের উপস্থিতি বেশি করে চোখে পড়ে। একদল ব্যস্ত তার ব্যক্তিজীবনকে মিথে মহিমান্বিত করার কাজে। আর আরেকদল খুঁজছে জীবনানন্দের এক অনুকারকের ছায়া। ফলে স্পষ্টতই বিনয় মজুমদারের কবিতা রয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট। অবশ্য এর জন্য দায়ী আমাদের অবিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা। আমরা জীবনের সবক্ষেত্রেই অবলীলায় বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে পারি কিন্তু মনে থেকে যায় ভাববাদের মহিমা। আর বিশেষত কবিতার মধ্যে বিজ্ঞানের ছায়া দেখলেও বিরক্ত হই। সেসময় অদ্ভুত ধরণের এক ঐতিহ্যবোধ ঢুকে পড়ে আমাদের মাথার মধ্যে। হয়তো এর মূল খুঁজলে পুরানো ছেড়ে নতুনকে মেনে নেয়ার দ্বন্দ্বের একটা গন্ধ পাওয়া যেতেও পারে। জীবনযাপনের সবখানে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া আমরা বোধহয় কবিতাকে আগলে রেখে এভাবেই একটুখানি পাপমোচনের চেষ্টা করছি।
দেশের ধারণা করা হয়েছিল মূলত যেখানে যে বাস করে, তার একটা চরিত্র চিত্রণ ও ক্ষমতার সীমা তৈরির প্রয়োজনে। সেই প্রয়োজনীয় দিনগুলির পরে আরো কত দিন এসেছে ধারণাসমূহের নতুনতর অভিঘাত নিয়ে! ফলে প্রয়োজনের যেসব সমাধান তৈরি হয়েছিল একদা, তাদের দূর্নিরীক্ষ দিগন্তও এসে গেছে হাতের কাছে। জাতীয়তাবাদ এরপরেও থেমে নেই। সে হতে চাইছে বুল ডোজার। থামিয়ে দিতে চাইছে নতুনকে।
কবিতাতেও একটা কল্পিত দেশকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখতে চান কেউ কেউ। বোঝাতে চান তিনি কোথায় আছেন, সেটা কবিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ পৃথিবীর কোনও দেশের কবিতা বুঝতে সেই দেশের নাগরিক হতে হয় না। ফলে কবিতার যে কোনও দেশ নেই, সেটা সোজাসুজিই বলে দেয়া যায়। একটা অঞ্চলের বৈশিষ্ট তাকে বিশিষ্ট করে তোলে বড়জোর। সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার অর্থ হলো বাইরের লোকের সামনে না দাঁড়ানোর সামর্থকে এড়াতে ঘরে বঊয়ের কাছে `ব্যাডাগিরি` ফলানো। এই ধরণের মানুষের কাছে শুধু বিনয় মজুমদার না, জীবনানন্দও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন।

জাতীয়তাবাদের এই মাস্তানিসুলভ দাপটে নতুনতর এলাকার দিকে ধাবিত বাংলা কবিতার ধারাটা এখন বেশ সংখ্যালঘু। তবে পাশাপাশি এটাও বলা যায় যে, বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্বের লিস্টে যেভাবে ঢুকে পড়ছে বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও বর্ণের মানুষ, তাতে দেশের ধারণা তো পাল্টাচ্ছেই, কবিতার দেশও এই ছোঁয়াচে রোগের হাত থেকে বেঁচে থাকতে পারবে না। বিভিন্নতার প্রভাবের ধকল তাকে পোহাতে হবেই। মানুষের ভ্রাম্যমাণতার প্রভাবে কবিতাও হয়ে উঠবে এই গ্রহের টুরিস্ট অ্যাট্রাকশনের আকর।
আমাদের এখন ভাবা দরকার বিশ্ব সংকলনে বাংলা কবিতার স্থান নিয়ে। আর সেটা ভাবতে গেলে আমাদেরকে ভাবতে হবে বাংলা বিশ্বের কবিতার কথা। বিনয় মজুমদারের মতোই যেকোনও স্থানীয় ঘটনাকে দেখতে হবে বিশ্বের ঘটনা হিসাবে। কবি নিজেও মহাসময়ের কথা ভাবেন। আর মহাসময়ের গ্রাফে মানববোধ সারাক্ষণ লাফালাফি করে। কখনো মাটি ছোঁয় তো কখনো আকাশ। এর মাঝখান দিয়েই কবির পথচলা। সকল কবির সকল কবিতার। এর ফলে স্থানীয় বর্তমান যেমন এদের স্পর্শ করে, অতীত এবং ভবিষ্যতও এদের নাগাল জুড়েই থাকে। তাই খণ্ডের মুক্তি মিললেও পূর্ণের মতো কবির মুক্তি নাই। কবিতাই তাকে বারবার দাঁড় করায় বিভিন্ন উচ্চতায়।
বিনয় মজুমদারের কবিতাকেও এইভাবে বারবার দাঁড়াতে হবে বিভিন্ন উচ্চতায়। পরীক্ষিত হবে, উজ্জ্বল হবে, মলিন হবে। কিন্তু উঠতে থাকবে একঘেঁয়ে এবং বেহায়া সূর্যের মতো। আলো দিতেই থাকবে, দেখাতেই থাকবে তার যা দেখানোর।