`অপ্রকাশিত জীবনানন্দ` জীবনানন্দের রচনা নয়
অরণ্য সৌরভপ্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২২
‘আমি জেনেছি, মানুষের আসলে/খুব বেশি গল্প থাকে না আয়েশ করে বলার মতো।/যদি নাই থাকবে তবে কেন এত আয়োজন?’ রেজওয়ান ২ কবিতায় কবি এমন একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যেটির উত্তর বা মীমাংসা কোনোটিই নেই। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের এই ছোট জীবনে সুখকর গল্প নেই, যা খুব শখ, স্বপ্ন, তৃপ্তি বা আয়েশ নিয়ে পায়েস খাওয়ার মতো করে বলতে পারেন। আয়েশের ভেতরও কেমন যেন দুঃখবোধ, চোখের কোণে অশ্রু টলমল। এই তো মানুষ! এই তো মনুষ্য জীবন!
উপরোক্ত আলাপটুকু করা হয়েছে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা অবলম্বনে। কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘অপ্রকাশিত জীবনানন্দ’। নামটি শোনার বা দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, বইটি মূলত কবি জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত রচনা (লেখা) নিয়েই গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে। কিন্তু বইটি হাতে নিয়ে দু’এক পৃষ্ঠা বা সূচি দেখার পর সেই ভুল ভাঙবে পাঠকের। ‘অপ্রকাশিত জীবনানন্দ’ বইটি মূলত একটি কাব্যগ্রন্থ। যেটির লেখক মাহবুব মোর্শেদ। রাজীব দত্তের প্রচ্ছদে ৬৯ পৃষ্ঠার বইটিতে সর্বমোট ৪৬টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত। ৪৬টি কবিতার মধ্যে তানহা, নওশীন ও রেজওয়ান শিরোনামে রয়েছে ধারাবাহিক (সিরিজ) কয়েকটি কবিতা। মাহবুব মোর্শেদের ভাষ্যমতে, ‘নতুন গল্পের প্লট সাজাতে সাজাতে লিখে ফেলি নতুন কবিতা’।
‘অপ্রকাশিত জীবনানন্দ’ কাব্যগ্রন্থে কখনো জীবন বাবুর মতো প্রকৃতির নিঁখুত বর্ণনা, উপমা যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি খুঁজে পাওয়া যায় সমকালীন ঘটিত ঘটনার তথা সময়ের নিরিখ অবলম্বনে রচিত দুঃখগাথা, অশ্রুস্রোত, স্তব্ধতা, দ্রোহ কিংবা প্রেম ও আক্ষেপ। কবিতার শরীর বেয়ে কখনো মুগ্ধতা, মোহ চুইয়ে পড়েছে। আবার কখনো সময়ের নিরিখ বা সমসাময়িক ঘটনার প্লট বাস্তবতার নিরিখ ধরা দিয়েছে। যেমন: ‘নওশীন ১’ কবিতায় বাংলাদেশের গুম সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট, একজন মায়ের আবদ্ধ ঘরে অশ্রুস্রোতে ভেসে যাওয়ার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। সেই মায়ের সন্তান হারানোর ব্যথায় গুমড়ে কান্নার ব্যাপার একপ্রকার ভুতুড়ে হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। অশ্রুঝরা সেই ঘটনা প্রেমিকা নওশীনের সাথে আক্ষেপ নিয়ে শুনতে চাওয়ার মাধ্যমে কবি জানতে পারে। কবি যখন বলেন, ‘ওই বাসায় সারাদিন কে যেন কাঁদে। ওনাদের একটাই ছেলে। গুম হয়ে গেছে।/ছেলেটা গুম হয়ে গেছে। মা তার কাঁদে...।’ এরপর আমাদেরও (পাঠক) জবান স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরাও যেন কেঁদে উঠি সেই মায়ের সঙ্গে সঙ্গে।
‘নওশীন ২’ কবিতায় দেখি, প্রেমের কি আকুতি! কবি বলেন, ‘তাতেই একটু একটু টাল খায়/আমার ও নওশীনের হৃদয়।/অল্প বাতাসে।/হায়!/এত দূরের এত অল্প বাতাসেও/এত দোল লেগে যায়।’ ধারাবাহিক নওশীন কবিতাগুলোকে অনেকটা প্রেমের মিশ্রিত কবিতা বলা যেতে পারে। প্রেমিকার সঙ্গে কথোপকথন, আক্ষেপ, আশা-ভরসা বা নিরাশার দোলাচলে, প্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতি, বাস্তবতা এবং ব্যথাতুর গল্পের দৃশ্যই দৃশ্যায়িত হয়েছে কবিতার ফিল্ম ধরে।
‘প্লাস্টিকের ফুল’ কবিতাতে একটি জড়বস্তুর (ফুল) মাধ্যমে প্রেমিকার কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। প্লাস্টিকের ফুল তথা জড় পদার্থের মতো নওশীনের বেলকনি, ড্রয়িংরুমে পর্যন্ত বিচরণ করে যাচ্ছেন কবি। মনে হচ্ছে সব সত্য, সুন্দর এবং সজীবতায় ভরপুর। কবিতাতে কবি প্রেমিকার ড্রয়িংরুমে ফুটে থাকা ফুলের সাথে নিজেকে অভিহিত করেছেন। এই কবিতার শেষাংশে বুকের ভেতর পাথরচাপা দুঃখ, ব্যথা ও বেদন নিয়ে বলছেন, ‘গভীর বিষাদ হয়ে ফুটে আছি নওশীনের প্রেমের বাগানে।’ কবি আবার কখনো প্রেমিকা নওশীনের এলাকায় গিয়ে একবার দেখা করে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। প্রেমিকার সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় বা ছলেবলে কৌশলে ফোনে যতই বলুক আমি তোমার এলাকায়, তোমার সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু বাস্তবে কবি অফিসে। এই কথা শুনে নওশীন আঁতকে উঠলেও, বিশ্বাস করলেও দেখা যায় কবি মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন। সেইসব নিয়ে কিংবা ছোটখাটো নানান কাহিনী, ঘটনা নিয়ে রাগ-অভিমান, মন খারাপ হয় প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে। দেখা করাটাই প্রেম নয়। সুখে থাকাটাই প্রেম নয়। প্রেম তো সেই অল্পস্বল্প রাগ অভিমানেই। সেজন্য কবি ‘নওশীনের এলাকায়’ কবিতায় বলেছেন, ‘আমার জন্য তোমার যে/মন খারাপ হয়/আমার ওপর তুমি যে রাগ করো/তোমারে যে পাই না আমি/আমারে যে পাও না তুমি/শুধু শুধু ঝগড়া হয়/এইগুলাই কিন্তু প্রেম আসলে।’ এই কবিতাতেই কবি শেষাংশে বলতেছেন, যদিও তুমি অবিশ্বাস করবা, তবুও তোমার এলাকায় গেলে সত্যি সত্যিই তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব।
কাব্যগ্রন্থের কোথাও অসহায়, দুস্থ বা দুঃখী মানুষের বিশেষ করে খেতে না পারা মানুষের জন্য নিজের ভেতর ঘর নড়েচড়ে ওঠার বার্তা দিয়ে গেছেন কবি। কবির সবচেয়ে পছন্দ ও মুগ্ধকর দৃশ্য হলো কারো ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখা। তাই তো কবি বলে উঠেছেন, ‘কেউ মন ভরে ভাত খেলে আমার খুব ভালো লাগে।/মানুষের ভাত খাবার দৃশ্য আজও/পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াময়, মধুর ঘটনা।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের কয়েকটি ঘটনা ফুটে উঠেছে কয়েকটি কবিতায়। এরমধ্যে রয়েছে: ‘ফেক নিউজ’, ‘বসন্তও চলে যাচ্ছে’, ‘প্রণোদনা প্য্যাকেজ’, ‘আজকাল’, ‘স্বরস্বতীর রাজহাঁস’।
বিভিন্ন কবিতার কয়েকটি পঙক্তি
‘তোমাকে তবুও আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই।/ভুলে যে গিয়েছি সেকথা মনে করে করে কেবলই ভুলে যেতে থাকি।/.../ভুলে যাই। ভুলে যেতে যেতে। নিঃশব্দে, নিভৃতে-/আমি যেন তোমার ভেতর বয়ে যাচ্ছি নদীর মতন।/তুমি যেন আমার ভেতর বয়ে যাচ্ছো নদীর মতন।’ (বিষ্মরণের নদী)
‘কেঁপে কেঁপে ওঠে পাতারা গাছের/নীড় থেকে জেগে ওঠে পাখি।/কোনো কারণ নেই/তবু মেয়েটা তার মানুষকে বলেে/আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি।’ (সময়)
‘বর্ষায় তোমার মন/সারারাত দুধে ভেজানো/চিতই পিঠার মতন/নরম হয়ে থাকে।’ (টানা বৃষ্টির কবিতা)
‘শত শত কবিতার প্রেরণা হতে হতে হয়তো সে এত দিনে একটা খরস্রোতা নদী হয়ে গেছে।’ (তানহা ২)
‘তানহাকে নক দেই/কথা বলি।/হৃদয় কেঁপে ওঠে/যদি কথা না বলে।/বিজি থাকে?/কথা বলি না।/তবু তানহা আমার জীবনে/গভীর রেখাপাত করে যায়।/তানহাকে আমি অনেক/দূর থেকে ভালোবাসি।/মানুষের জীবনে কতকিছু থাকে।/তানহা দূরে আছে,/এরকমও ভালো লাগে মাঝে মাঝে।’ (তানহা ১)
‘তখনো তোমার স্বর হালকা হালকা কানে আসে। যেন কোনো দুপুরে কয়েক বাড়ি পরে বেজে চলেছে একটা মিহি টেলিভিশন।’ (তানহা ৫)
‘আমার কললিস্টে তোমার নাম/যত্ন করে রাখা আছে/তোমার কললিস্টে আমার নাম নেই।/জরুরি কোনো দরকারও নেই/তোমার আমার/তবু আমাদের জীবনে আমরা দুরকম।/তোমার জীবনে আমি/হারিয়ে যাই/আমার জীবনে তুমি জেগে থাকো/সারাক্ষণ।’ (রেজওয়ান ১)
গ্রন্থটির কয়েকটি কবিতায় বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোনোটা প্রয়োগ হয়েছে আমাদের নিত্যদিনের কথাবার্তায় ব্যবহারের আচরণ অনুযায়ী। ‘বিস্মরণের নদী’ কবিতায় বোটসম্যান, ডিপ্রেশন; ‘তানহা ১’ কবিতায় ডিপ্রেশন, ফোর্টনাইট, স্রেফ, স্রেফ; ‘তানহা ৩’ কবিতায় ক্যালেন্ডার; ‘তানহা ৪’ কবিতায় স্নাইপার, ল্যান্ডস্কেপ, টার্গেট; ‘তানহা ৫’ কবিতায় লাইভ, প্লিজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কখনো কখনো কোনো কোনো কবিতা হালকা মেজাজের মনে হতে পারে। কখনো বা গভীর প্রোথিত অর্থবহ। খুব সাধারণ সব শব্দের গাঁথুনিতে অসাধারণ করে তোলার চেষ্টায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। কবিতায় আছে বৈচিত্র, ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট, স্বতন্ত্র। সবগুলো কবিতা সবাইকে মুগ্ধ না করলে, বেশ কয়েকটি মুগ্ধ করে কাক চিন্তা বক ধ্যানের মতন বসিয়ে রাখবে পৃষ্টায় পৃষ্ঠায়।