অপূর্ব চৌধুরীর গদ্য ‘পথেই রাত, পথেই কাত’

প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২১

হাইকিং করতে কখনো ড্রাইভ করি না। কারণ, লঙ ডিসটেন্স হাইক করি বলে যেখান থেকে শুরু করি সেখানে ফিরে আসার পথ থাকে না। আবার লুপ হাইকিং বা বৃত্তাকার হাইকিং করলে ঝামেলা হলো, ছয় সাত ঘণ্টা হাঁটার পর ড্রাইভ করা মানে মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসা। শরীরে একবিন্দু শক্তি থাকে না। এমনকি সাইকেল নিয়েও হাইকিং যাবেন না। যখন হাইকিং করবেন, বোঝা কম নেবেন, যত রিলাক্স থাকতে পারেন। এই যেমন কাল ফেরার পথে শেষ দুর্ঘটনা— এতই ক্লান্ত ছিলাম, ঘুমের ঠেলায় ট্রেনের টেবিলে একবার, উইন্ডোতে আরেকবার মাথা বাড়ি খেয়েছে। কপাল ফুলেছে একটু, কেবল কেউ বরফ লাগিয়ে দেবার নেই। মুখ হা করে ঘুমাচ্ছিলাম, আরেকটু হলে যেখানে নামার কথা, সে স্টেশন মিস করতাম।

ভ্রমণ মানে তো কিছু ঘটনা। নাহলে কিছু মনে থাকবে না। আমি দুর্গম জায়গাগুলোতে বেশি যাই। যেখানে কাক পক্ষী যায় কম, মানুষ বসতি নেই, যেখানে যাওয়াটাও একটা মজার। কষ্ট করে কোথাও পৌঁছানোটাও ভ্রমণের আনন্দ। ভ্রমণ মানে শুধু দেখা নয়, পুরো যাত্রাপথের উপলব্ধিটাই ভ্রমণ। যেমন— কাল যাওয়ার পথ কতবার গাড়ি চেঞ্জ করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কাছের এক আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশনে হেঁটে গেলাম বিশ মিনিটে। ট্রেনে পনেরো মিনিটে বড় স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। এখন মূল ট্রেন ধরতে হবে। চেক করে দেখি, যে জায়গায় যাব তার প্রথম ট্রেন আরও দেড় ঘণ্টা পরে। ভুলটা আমার। হোম ওয়ার্ক করার সময় ট্রেনের যে টাইম চেক করেছিলাম ওটা ছিল সপ্তাহের ওয়ার্কিং ডে টাইম।

আজকে তো ছুটির দিন। এখানে ছুটির দিনে বাস ট্রেনের টাইম থেকে টিকেট পরিবর্তন হয়ে যায়। এসেই যখন পড়েছি, কী আর করা! ভোর চারটায় উঠেছিলাম। চোখে ঘুম। সোজা যাত্রী বেঞ্চিতে মাথার নিচে ব্যাগ দিয়ে লম্বা হয়ে একটা ঘুম দেয়ার চেষ্টা করলাম। আমার লজ্জা কম এসবে। দেখতে লাগছিল লঞ্চের বেঞ্চিতে ঘুমানোর মতো। পনেরো বিশ মিনিট ঘুমানোর চেষ্টার পর মনে হলো, বিকল্প আছে কিনা দেখি। পুরো ইংল্যান্ড চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে। জটিল ট্রেন রুট ভালোই চিনি। ডিসপ্লে বোর্ড থেকে বের করলাম আরেকটা রুটে সেখানে যেতে পারি। দেখলাম, দশ মিনিট পরেই সে ট্রেন। কফি আর ব্যগেট নিয়ে দৌড়ে গেলাম নির্ধারিত প্লাটফর্মে। ট্রেনে যেতে লাগলো দেড় ঘণ্টা।

স্টেশন থেকে বের হয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হলো বাস স্টপেজ বের করতে। আগে থেকে বাস নাম্বার জানতাম। এবার ভাগ্য অনেক প্রসন্ন। স্টপেজে আসতেই দু মিনিট পর বাস এলো। এটা মিস করলে পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা। এদেশের অনেক বাস স্টপে সিট থাকে না বসার। অন্য সময় ফুলবাবু হয়ে থাকলেও ভ্রমণের সময় আমার লজ্জা কম। দরকার পড়লে কুলিদের মতো মাটিতে বসে পড়ি যেখানে সেখানে। ভ্রমণ মানেই তো পথেই রাত, পথেই কাত। আশপাশে ইংরেজ যাত্রীগুলো তখন এমন ভাবে তাকায়, যেন লরির ভিতরে করে অবৈধভাবে এদেশে এসেছি, ঘরবাড়ি নাই, রিফিউজি। আমি মিটিমিটি হাসি।

বিশ মিনিট পর আরেকটি স্টপেজে নামতে হলো। সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের আরেকটি স্টপেজে যেতে হবে রাস্তার অপজিটে। আরেকটি বাসে উঠতে হবে। সেটা যেতে লাগবে চল্লিশ মিনিট। দুর্গম জায়গায় এই বাসটি যায়। প্রতি ঘণ্টায় একটি। বিকেল পাঁচটায় শেষ বাস। কিন্তু দিনের প্রথম বাস আসতে আরো আধা ঘণ্টা। রাস্তায় মানুষজন নেই, গাড়িও নেই। কোনো যাত্রী ছাউনী নেই। একটা ল্যাম্পপোস্ট আর একটা টাইম টেবিল দেয়া নোটিশ বোর্ড। যথারীতি আইল্যান্ডে পাছা দিয়ে বসে পড়লাম রাস্তায়। কে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে! আধা ঘণ্টা পর টাইমমতো বাস এলো। অপেক্ষমান যাত্রী একমাত্র আমি, বাসের ভেতরও একমাত্র যাত্রী আমি। গুগল ম্যাপ ব্যবহার করছিলাম কোথায় নামতে হবে সেটা বুঝতে। তখন বেল টিপতে হবে। নাহলে বাস থামবে না।

একটু ঘুম দিলাম। পথ আধাআধি যেতে ম্যাপে চোখ দিতেই দেখি, আমার হাই লাইটেড করা ম্যাপের বিপরীত গাড়ি ছুটছে। চোখ কপালে উঠলো। প্রমাদ গুনলাম। হায় হায় ভুল বাসে উঠেছি নাকি। আবার চেক করলাম, আমার রুট ম্যাপ বলছিল এটাই একমাত্র বাস। কিন্তু গন্তব্যের বিপরীত দিকে ছুটছে কেন! দৌড়ে ড্রাইভারের কাছে গেলাম। কাচের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম নেক্সট ট্রাফিকে কখন সে থামবে। জিজ্ঞেস করলাম, স্টপেজে নাম, যেখানে যাচ্ছিলাম, বাস কি সেখানেই যাচ্ছে কিনা। হাতে ফোন, স্ক্রিনে গুগল ম্যাপ, সেটার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার হাসি দিয়ে বললো, হা, ঐদিকেই যাচ্ছি, তবে ভিন্ন পথে।

নিজেই হাসলাম সিটে এসে। ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, বাস অনেক ঘুরে আরেকটি পথে সে দিকেই যাচ্ছে। অচেনা জায়গায় কিছু না জানলে পলে পলে মনে হয়, এই রে হারিয়ে গেলাম মনে হয়! অবশ্য ভ্রমণে হারাতেই আনন্দ। স্টপেজে নেমে দেখি, সামনে বিশাল বিশাল পাহাড়। কোনদিকে যাব! কোনো রাস্তা নেই। ইংল্যান্ডের একেবারে দক্ষিণের শেষ মাথা এটি। পাহাড়ের ওপারেই সমুদ্র। রুট নেভিগেশন শুরু করার স্পট সেখান থেকে আরো বিশ মিনিটের পথ। রুট তাই বলছে কিছু ডট সাইন দিয়ে। এখন এই ডট ধরে রাস্তা বের করতে হবে। কিন্তু কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। পিটি প্যারেডের মতো একবার ডানে ঘুর, আরেকবার বায়ে ঘুর করছিলাম। একটু হাঁটতে একটি ট্রেক পেলাম। ঘাসের ঝোপের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। বুঝলাম, এই পথই হবে।

ট্রেক পেয়ে খুশি। এখন আর ম্যাপ লাগবে না। শুরু করি ট্রেকিং। এক চুমুক পানি খেয়ে শুরু করলাম দিনের হাইকিং।